রোববার সূর্যোদয়ের পর থেকে নাচে-গানে, কথনে-পংক্তিতে বসন্ত বন্দনার পাশাপাশি
রাজধানীবাসী মেতে উঠেছেন ভালোবাসার উদযাপনে।
ইংরেজি ১৪০০ শতকে ইংরেজ সাহিত্যিক চসারের লেখায় ভ্যালেনটাইনস ডে’র সঙ্গে
রোমান্টিক আবহ যুক্ত হয় এবং পরে এটি প্রেমিক-প্রেমিকাদের দিবস হিসেবে পালিত হওয়া শুরু
হয়।
ঊনবিংশ শতকে ইউরোপে ভ্যালেনটাইন দিবসে প্রিয়জনকে চিঠি, কার্ড ও উপহার দেওয়ার
চল শুরু হয়। বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার জন্যও দিনটি জনপ্রিয় হতে থাকে।
ভ্যালেনটাইনস ডে’র প্রতীক হলো এমেথিস্ট পাথর, লাল গোলাপ, কিউপিডের প্রতিকৃতি।
কথিত আছে সেন্ট ভ্যালেনটাইনের হাতে অ্যামেথিস্ট পাথর বসানো একটি আংটি ছিল এবং সেই পাথর
ভালোবাসা লাভে সাহায্য করে।

বাংলাদেশে নব্বইয়ের দশক থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভালোবাসা দিবস নামে উদযাপিত
হতে থাকে। ১৩ ফেব্রুয়ারি পহেলা ফাল্গুনের বসন্ত বরণ এবং ১৪ ফেব্রুয়ারিতে ভালোবাসা দিবস
পালনের রীতি চলে আসছে প্রায় ২৫ বছর ধরে।
বাংলা একাডেমি বাংলা বর্ষপঞ্জিতে পরিবর্তন আনায় গত বছর থেকে পহেলা ফাল্গুন
উদযাপিত হচ্ছে ১৪ ফেব্রুয়ারি, একই দিনে হচ্ছে ভ্যালেনটাইনস ডে’র উদযাপন।
মহামারীর কারণে গতবছর মার্চের পর বাংলাদেশে কোনো উৎসবই আর সেই উৎসবের আমেজ
থাকেনি। গত এক বছরে করোনাভাইরাস বাংলাদেশে ৮ হাজারের বেশি মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে।
এবারের ভালোবাসা দিবসে তাই প্রিয়জন হারানোর বেদনাও অনেকের সঙ্গী।
বসন্ত উৎসব আর ভালোবাসা দিবসে সকাল থেকেই অনেকে জড়ো হতে শুরু করেন রমনা
পার্ক অথবা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে।
যে বসন্তে ফুলে ফুলে রঙিন হয়ে ওঠে রমনা পার্ক; সেখানে এবার উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের
কারণে ধুলোর রাজত্ব। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পাশে চলছে মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজ। সেই
ধুলো পার্কে আসা কপোত-কপোতিদের বড্ড জ্বালিয়েছে। তবে কোনো কিছুই ভালোবাসার উদযাপনে
বাধা হতে পারেনি।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বসন্ত উৎসবের অনুষ্ঠান শেষে কথা হয় উত্তরার ৪ নম্বর
সেক্টর থেকে আসা দম্পতি রাহাতুল ইসলাম ও কনিকার সঙ্গে।
রাহাত বললেন, “প্রেমের জন্য ধরাবাধা কোনো নিয়ম, দিন কি থাকে! তবুও এ দিনটি বসন্তের প্রথম দিন। মহামারীর একটি
বছর ঘরবন্দি জীবনে সব রঙই তো হারিয়ে গেল জীবন থেকে। কী দুঃসহ দিন গেছে আমাদের। সেই
করোনাভাইরাস এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। তাই স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে বসন্ত উৎসবে যোগ দিয়েছি।”
বসন্ত উৎসবের আয়োজন শেষ হয়ে যায় বেলা সাড়ে ১০টার কিছু পর। তারপর সোহরাওয়ার্দী
উদ্যান মুখরিত হয়ে উঠে রঙিন মানুষের আনাগোণায়।
হাবিবুল হকও স্ত্রীকে নিয়ে উদযাপনে যোগ দিতে এসেছিলেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বললেন, “প্রতি বছরই বসন্ত উৎসব ও ভ্যালেন্টাইনস ডেতে
আমরা দিনভর ঘুরে বেড়াই। ক্যাম্পাস লাইফের দিনগুলোর কথা মনে করি।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মুক্তমঞ্চে রোববার সকালে বসন্ত উৎসবে নৃত্য পরিবেশনা। ছবি: মাহমুদ জামান অভি
“আমাদের বিয়েটা প্রেমের। ১৩ বছর আগের ক্যাম্পাস জীবনের উত্তাল প্রেমের
দিনগুলো এখানে এসে একটু মনে করি। বন্ধুরাও স্ত্রীদের নিয়ে চলে আসে। একটা জম্পেশ আড্ডাও
হয়ে যায়।”
তিন বছর অপেক্ষার পর তবেই নাকি পৃথা সায় দিয়েছেন সঞ্জয়ের প্রেম প্রস্তাবে!
এই বসন্ত তাই তার কাছে ‘ভীষণ দামী’।
পেশায় প্রকৌশলী সঞ্জয় দেবনাথ বলেন, “অনুপমের গানের কথায় বলি, আমার কাছে
এই বসন্ত ভীষণ দামী। আজ দুজন ঘুরব, সিনেমা দেখব, আর বন্ধুদের সঙ্গে বৈকালিক আড্ডা তো
আছেই।”
শাহবাগের ফুলের দোকানগুলোতে এখন দারুণ ব্যস্ততা। গাঁদা, গোলাপ, রজনীগন্ধা
থেকে শুরু করে দেশি বিদেশি নানা জাতের ফুলের ভীষণ চাহিদা। গত কয়েক বছর ধরেই এসব দিনে
নারীদের পছন্দের আভরণ হয়ে উঠেছে ফুলের মুকুট, সঙ্গে চিরায়ত ঢঙে খোঁপায় রঙিন ফুলের সাজ
তো আছেই।

বসন্তে ফুটেছে পলাশ শিমুলসহ হরেক রকম ফুল। চট্টগ্রাম টাইগারপাস এলাকায় শিমুল গাছে পাখিদের আনাগোনা বাড়ছে প্রতি মুহূর্তে। ছবি: সুমন বাবু
করোনাভাইরাসের প্রকোপ অনেকটা কমে এলেও মাস্ক পড়ার নির্দেশনা এখনও জারি
আছে। কিন্তু কোথায় সেই নিয়ম! সোহরাওয়ার্দী বা রমনায় আনন্দ আড্ডায় মাস্ক পরার কথা যেন
ভুলেই গেছেন সবাই।
ভালোবাসার দিন কি কেবল প্রেমিক-প্রেমিকার? রায়েরবাজারের বাসিন্দা আফসানা
হক জানালেন, তিনি সারাটি দিন কাটাবেন তার মায়ের সঙ্গে।
পেশায় কলেজ শিক্ষক আফসানার মায়ের সঙ্গে দেখা করার ফুরসত মেলে কালেভদ্রে।
তাই তিনি দুই সন্তান নিয়ে চলেছেন গাজীপুরের কালিগঞ্জে।
“গ্রামের বাড়িতে মা প্রায় সারাটি দিন একাই থাকেন। আমরা ভাইবোনরা সব যে
যার কাজে মহাব্যস্ত। মাকে সময় দেওয়ার সময় কোথায়? আমাদের ভালোবাসার সবটুকু জুড়েই তো
মা। মার সঙ্গে দুটো দিন কাটিয়ে ফিরব শহরে।”
জোড়া উদযাপনের এই রঙিন দিনটি সবার জন্য হয়ত লাল, হলুদ, গোলাপী বা উজ্জ্বল
কমলা নয়। সবকিছু ছাপিয়ে কারও কারও হৃদয় আজ বেদনায় নীল।

চট্টগ্রামের সিআরবি এলাকায় শনিবার বিকালে বসন্ত ও ভালোবাসার সাজ নিয়ে সেলফি তুলতে দেখা যায় অনেককে। ছবি: সুমন বাবু
করোনাভাইরাস মহামারীতে প্রিয়জনের বিয়োগ ব্যথা সইতে হয়েছে বহু মানুষকে।
শাহবাগ মোড়ে ফুলের দোকানে কথা হল তাদেরই একজনের সঙ্গে।
একগুচ্ছ অর্কিড নিয়ে সেই তরুণ চললেন জুরাইন কবরস্থানে। ক্যাম্পাসের উত্তাল
প্রেমের দিনগুলো পেরিয়ে এসে গত বছরের পৌষে তিনি বুনতে শুরু করেছিলেন সংসারের স্বপ্ন।
কিন্তু গত বসন্তের শেষভাগে বাংলাদেশে হানা দেয় করোনাভাইরাস। সেই মহামারীই কেড়ে নিয়েছে
এ তরুণের প্রস্ফুটিত প্রেম।
ভালোবাসার দিনে ফুল হাতে প্রেমিকার কবরের পথে এই তরুণের কাছে রঙিন বসন্ত
তাই মর্মন্তুদ।