বিচারিক আদালতের রায়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া ১০ আসামির ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের শুনানি গত ১ ফেব্রুয়ারি শেষ হয়।
এরপর বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি মো. বদরুজ্জামানের ভার্চুয়াল হাই কোর্ট বেঞ্চ রায় ঘোষণার তারিখ নির্ধারণ করে দেয়। আদালত বলে দিয়েছে, রায়টি বাংলায় ঘোষণা করা হবে।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. বশির উল্লাহ।
এছাড়া সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মিজানুর রহমান খান শাহিন, মোহাম্মদ শাহিন আহমেদ, মো. সাফায়েত জামিল, মো. আশিকুজ্জামান বাবু, সাদিয়া সুলতানা রত্নাও শুনানিতে অংশ নেন।
আসামিপক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী এস এম শাহজাহান, মোহাম্মদ আহসান, মো. নাসিরউদ্দিন। এছাড়া পলাতক আসামির পক্ষে রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী ছিলেন আমূল্য কুমার সরকার।
২০১৮ সালের ২ এপ্রিল এ মামলার ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ডের রায়ের অনুমোদন) ও আপিলের উপর শুনানি শুরু হয়েছিল।
হরকাতুল জিহাদের শীর্ষনেতা মুফতি আবদুল হান্নান এই মামলায় মূল আসামি ছিলেন। অন্য মামলায় তার ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় তার নাম মামলা থেকে বাদ দেওয়া হয়।
রায়ের দিন ঘোষণার পর অ্যাটর্নি জেনারেল সাংবাদিকদের বলেন, রমনা বটমূলে বোমা হামলার ঘটনায় ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছিলেন মুফতি হান্নান। সে জবানবন্দিতে তিনি কোটালীপাড়ায় বোমা পুঁতে রাখা এবং কী ধরনের ষড়যন্ত্র হয়েছিল, তার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন।
“কিন্তু মুফতি হান্নানের ওই স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির বিষয়ে আসামিপক্ষের যুক্তি ছিল মুফতি হান্নানের এই জবানবন্দি স্বেচ্ছাপ্রণোদিত ছিল না। অথচ সিলেটে ব্রিটিশ হাই কমিশনার আনোয়ার চৌধুরী হত্যাচেষ্টা মামলায় এই জবানবন্দি ব্যবহার করা হয়েছে। সে জবানবন্দি গ্রহণ করে প্রথমে হাই কোর্ট ও পরে আপিল বিভাগ ওই মামলায় বিচারিক আদালতের দেওয়া শাস্তি বহাল রাখে। ফলে এ মামলায় এই জবানবন্দি নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই।”
আমিন উদ্দিন বলেন, “আপিল শুনানিতে ষড়যন্ত্র নিয়ে এই উপমহাদেশে যত মামলা আছে তার সব উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরে বলেছি, ষড়যন্ত্রের সরাসরি কোনো প্রমাণ লাগে না। ষড়যন্ত্র হয়েছে কিনা সেটা ঘটনার পরম্পরা দিয়ে বিচার করতে হয়।
“আমরা শুনানিতে দেখিয়েছি, এ মামলায় দণ্ডিতরা সকলেই জড়িত ছিল। আমরা এ মামলাটি পুরোপুরি প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি। ফলে আদালতের কাছে আমরা আরজি জানিয়েছি বিচারিক আদালতের রায়টি বহাল রাখতে। ডেথ রেফারেন্স গ্রহণ করে আসামিদের আপিল খারজি করার আরজিও জানিয়েছি।”
বিচারিক আদালতের রায়ে প্রাণদণ্ড পাওয়া আসামি শেখ ফরিদ ওরফে মাওলানা শওকত ওসমানের আইনজীবী এসএম শাহজাহান সাংবাদিকদের বলেন,“মুফতি হান্নান রমনা বটমূলের মামলায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছিলেন। সে জবানবন্দিতে শেখ ফরিদের নাম এসেছে। এর ভিত্তিতে তাকে আসামি করা হয়েছে। এছাড়া তার বিরুদ্ধে আর কোনো প্রমাণ নাই।
“তাছাড়া অন্য মামলায় দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি এই মামলায় ব্যবহার করে তাকে সাজা দেওয়া যুক্তিযুক্ত নয়। ফলে তার খালাস চাওয়া হয়েছে।”
২০০০ সালের ২০ জুলাই কোটালীপাড়ায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশস্থলের পাশে ৭৬ কেজি ওজনের বোমা পুঁতে রাখা হয়।
শেখ লুৎফর রহমান মহাবিদ্যালয়ের উত্তর পাশের একটি চায়ের দোকানের পেছনে এ বোমা বিস্ফোরণের মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়েছিল।
এ ঘটনায় কোটালীপাড়া থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) নূর হোসেন মামলা দায়ের করেন। ২০০১ সালের ৮ এপ্রিল ১৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।
পরবর্তীকালে ২০০৯ সালের ২৯ জুন আরও নয়জনকে আসামি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। এরপর ২০১০ সালে মামলাটি নিষ্পত্তির জন্য ঢাকা-২ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইবুনালে পাঠানো হয়।
২০১৭ সালের ২০ অগাস্ট ট্রাইব্যুনালের বিচারক মমতাজ বেগম রায়ে ১০ জঙ্গির প্রাণদণ্ড দেন।
গুলি করে প্রত্যেকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আদেশ দেন বিচারক। এছাড়া চার আসামিকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেন।
হাসিনাকে হত্যাচেষ্টা: ফায়ারিং স্কোয়াডে ১০ জনের প্রাণদণ্ড
রায়ের চার দিনের মাথায় মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের জন্য এ মামলার রায়সহ সব নথি হাই কোর্টে পাঠানো হয়; যা ডেথ রেফারেন্স হিসেবে পরিচিত।
এরপর প্রধান বিচারপতির কাছে নথি উপস্থাপন করা হলে তিনি জরুরিভিত্তিতে পেপারবুক তৈরির নির্দেশ দেন।
বিচারিক আদালতের রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন- ওয়াশিম আখতার ওরফে তারেক হোসেন, মো. রাশেদ ড্রাইভার ওরফে আবুল কালাম, মো. ইউসুফ ওরফে আবু মুসা হারুন, শেখ ফরিদ ওরফে মাওলানা শওকত ওসমান, হাফেজ জাহাঙ্গীর আলম বদর, মাওলানা আবু বক্কর, হাফেজ মাওলানা ইয়াহিয়া, মুফতি শফিকুর রহমান, মুফতি আবদুল হাই এবং মাওলানা আবদুর রউফ ওরফে আবু ওমর।
এছাড়া মেহেদি হাসান ওরফে আবদুল ওয়াদুদকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।
আসামি আনিসুল ওরফে আনিস, মো. মহিবুল্লাহ ওরফে মফিজুর রহমান এবং সরোয়ার হোসেন মিয়াকে ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অনাদায়ে আরও এক বছরের দণ্ড দেওয়া হয়।