আমি লন্ডনে দুইবার ‘বাংলাদেশ শেয়ার বাজার মেলার’ আয়োজক। কেবল নিজে একজন প্রবাসী বিনিয়োগকারী নই, বহু প্রবাসীদেরও এ বাজারে বিনিয়োগে উৎসাহিত করেছি। যুক্তরাজ্যে ‘বাংলাদেশ ক্যাপিটাল মার্কেট ফেয়ার’ অর্থ্যাৎ শেয়ার বাজার মেলা করতে গিয়ে ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের সদস্য, ব্রোকার হাউস, মার্চেন্ট ব্যাংকার এবং উচ্চপদস্থ র্কমর্কতাদের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়েছে।
গর্বের সঙ্গে বলতে পারি এ মেলার সুবাদে বহু প্রবাসীদের এবং প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগে শেয়ার বাজারে উৎসাহিত করতে পেরেছি। শেয়ার মার্কেটের উচ্চপদস্থ কর্মকতার্দের লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জের সঙ্গে যৌথ সভার আয়োজন করে দিয়েছি। এতে বাংলাদেশে বিনিয়োগের ব্যাপারে তারা মতবিনিময় করেছেন।
‘ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে’ (ডিএসই) এর তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রকিবুর রহমানের বাংলাদেশের শেয়ার বাজারে প্রবাসীদের বিনিয়োগ আকৃষ্টকরণে আন্তরিকতার অভাব দেখতে পাইনি। আমাদের আয়োজিত ডিনারে রকিবুর রহমান দেশি- বিদেশি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলেছেন এবং বাংলাদেশে বিনিয়োগের সুফল তুলে ধরেছেন। এখানকার ব্যবসায়িক সংগঠনগুলোর সঙ্গেও আলাদাভাবে মিটিং করেন। পরপর দুটি মেলায় প্রায় ১০ হাজার সাধারণ প্রবাসী বিনিয়োগ-উৎসাহী মানুষ যোগ দেন। বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৩০টি ব্রোকার হাউস ও ব্যাংক এ মেলায় অংশগ্রহণ করে। যা হোক, র্দীঘ ৯-১০ বছর অতিবাহিত হবার পর শেয়ার বাজারকে ঢেলে সাজানোর ব্যাপারে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন দেখে ভাল লাগছে।
এখন শুনছি প্রবাসীদের টার্গেট করে কিছু ডিজিটাল আউটলেট চালু করার ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। শেয়ার বাজারের যেসব দুর্বলতা ছিল সেগুলো পরিবর্তনেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এসব সত্যি ভাল খবর। বাংলাদেশে ডিজিটাল শব্দটির অনেক অপব্যবহার হয়েছে। ডিজিটাল আউটলেট বলতে শেয়ার বাজার রেগুলেটর কী বোঝাতে চাচ্ছেন অনেকেই তা বুঝতে পারবে না। আমরা যারা লেখালেখি করি তারা আবার বাংলাদেশে ডিজিটাল শব্দের অতি ব্যবহারে ভীত হয়ে আছি। কারণ ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ নামের একটি বিধি আছে যাকে অনেক সাংবাদিক ও সংবাদপত্র ‘কালো আইন’ বলে থাকেন।
শেয়ার বাজার রেগুলেটর সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশনের অতীতে নানা কারণে ইমেজ সংকট হয়েছে। এখন ঢাকাই সিনেমার বদমাশ চরিত্র থেকে দরবেশ ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনতে অনেক সময় লাগবে। শেয়ার বাজারের পূর্ববর্তী ধ্বসের কারণে যেসব কমিশন গঠন করা হয়েছিল এর নির্দেশনাগুলোর কিছুটা হলেও বাস্তবায়ন অপরিহার্য, এতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে কিছুটা হলেও আস্থা ফিরে আসবে।
প্রবাসীদের বিনিয়োগের ব্যাপারে অনেকগুলো সংকট দূর করতে হবে। প্রবাসীদের বিনিয়োগে প্রতিষ্ঠিত ইউনাইটেড এয়ারলাইন্স শেয়ার বাজারে যাবার পর বর্তমানে অনেক প্রবাসী ব্যাপকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন। এর কী হবে? কোন সুরাহা দেখা যাচ্ছে না!
প্রবাসীদের নামে অনেকগুলো ব্যাংক হয়েছে। আশার কথা এ ব্যাংকগুলোকে বাজারে আনা হবে। তার আগে কি ব্যাংকিং ব্যবসায় আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য ঢেলে সাজানোর প্রয়োজন নেই! ডিরেক্টরদের অন্তর্দ্বন্দ্ব, খেলাপী ঋণ, লুটপাট আর নানা রকমের কীর্তিকলাপের খবরাখবর সাধারণ মানুষের অজানা নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের নাকের ডগায় অনেক কিছুই হচ্ছে। পিকে হালদারের মতো ব্যক্তিরা কীভাবে শত শত কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেন এটা নতুন কোন জিজ্ঞাসা নয়। প্রবাসীদের মনে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগবে ব্যাংকিং ব্যবস্থার বিষয়গুলো সুরাহা না করে নতুন করে শেয়ার বাজারে আমাদের বিনিয়োগ নিয়ে লুটপাটের এটি কোন দুরভিসন্ধি নয়তো?
প্রবাসে প্রতিষ্ঠিত ডিজিটাল আউটলেট থেকে সরাসরি প্রবাসীদের বিনিয়োগের যেসব কথা বলা হচ্ছে তা কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে! বৈদেশিক মুদ্রায় নাকি নিটা অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে! নিটা অ্যাকাউন্ট খোলা যে কঠিন ব্যাপার যে কসরত করতে হয় শুধু ভুক্তভোগীরাই তা জানেন। তারপরও আশাবাদী রেগুলেটর হয়তো ভেবেচিন্তে এবং অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে এর একটি সমাধান বের করেছেন।
এখানে একটি কথা না বলে পারছি না, আমাদের আত্মসম্মানবোধে লাগে জাতি হিসেবে বাংলাদেশের একমাত্র ব্যাংক সোনালী ব্যাংকটিও এখানে লন্ডনে বন্ধ হয়ে গেছে। বাংলাদেশের একটি ব্যাংকও এখানে নেই যা সম্পূর্ণ বিলেতি আইনকানুন মেনে পুরোপুরি ব্যাংক হিসেবে চলে। সোনালী ব্যাংক এখন শুধু একটি রেমিট্যান্স হাউস যা কিছু সীমিত সেবা প্রদান করে থাকে। অতীতে ব্যাংক থাকাকালীন নানা জালিয়াতির অভিযোগে অভিযুক্ত হয় ব্যাংকটি।
অথচ কম্পলায়েন্সের নামে লক্ষ লক্ষ পাউন্ড বেতনের অফিসাররা থাকা অবস্থায় কীভাবে ব্যাংক তার মযার্দা হারায়, কীভাবে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তার স্বপদে বহাল থাকেন এ নিয়ে পত্রপত্রিকায় খবর বের হলেও কোন সুরাহা হয়নি। জানা গেছে রেমিট্যান্স হাউস হয়ে ডাউনগ্রেড হয়েও ভূত ঘাড় থেকে নামেনি। সুতরাং ডিজিটাল আউটলেট নিয়ে প্রবাসীদের মধ্যে ‘ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়’ এমন বিষয়টি থেকেই যায়।
যাই হোক, এতো কিছু লেখার পরও বাংলাদেশের শেয়ার বাজার নিয়ে আমি ব্যক্তিগতভাবে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করি। মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি এটি প্রবাসীদের বিনিয়োগের একটি যথাযথ মাধ্যম। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ভেবেচিন্তে বিনিয়োগ করতে হবে। প্রবাসীদের কোটি কোটি টাকা ব্যাংকে অলস না রেখে বিশেষজ্ঞ মার্চেন্ট ব্যাংকারদের পরামর্শ নিয়ে বিনিয়োগ করলে দীর্ঘমেয়াদী মুনাফার সম্ভাবনা রয়েছে। এটি এখন সিলেটের অজপাড়াগায়ে বিশাল দালানকোঠা বা শপিং কমপ্লেক্সে বিনিয়োগের চেয়ে অনেক উত্তম।
গত দশকের প্রথম দিকে একটি বিষয় আমরা খুব লক্ষ করেছি। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, মধ্যপ্রাচ্য, সিঙ্গাপুর ইত্যাদি দেশে ‘রোড শো’ করছেন বাংলাদেশি কর্মকতার্রা। বিনিয়োগ আকৃষ্টের নামে এসব রোড শো ও কর্মকতার্দের বিদেশ ভ্রমণ হচ্ছে। রোড শো শুনলেই আমাদের মধ্যে এমন একটি বিরক্তিকর প্রতিক্রিয়া হতো, ‘আবার এসে গেছে আরেকটি’। শুনেছি শেয়ার বাজারের রেগুলেটরি একটি দল বিভিন্ন দেশে প্রবাসীদের বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে সফরে বেরিয়েছেন। খুব ভাল কথা। তাদের উচিত হবে সত্যিকারভাবে সাধারণ প্রবাসী বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে মতবিনিময়, তাদের উদ্বেগ উৎসাহের কথা শোনা।
সাধারণত অনেক সময় দেখা যায় বিনিয়োগ বিষয়ক কারণে প্রতিনিধি দল সফরে আসলে দূতাবাসের সহায়তায় অনেক কিছুই হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় কিছু চেনা মুখ, সরকার দলীয় কিছু রাজনৈতিক কর্মী, গতানুগতিক কিছু ব্যবসায়ী ও সংগঠনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। এতে কাজের কাজ কতটুকু হয় সন্দেহ রয়েছে। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে অনেকগুলো বাংলা সংবাদ মাধ্যম রয়েছে। প্রয়োজনে এসব সংবাদ মাধ্যমে একটি নিয়মিত ক্যাম্পেইন পরিচালনা করে প্রকৃত আগ্রহী যারা তাদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করা হোক।
আর তা না হলে কর্মকতার্দের সফর তালিকায় আরেকটি বিদেশ সফরের চিহ্ন সংযুক্ত হবে, এটি শেয়ার বাজারের কর্মকতার্দের ‘ভ্রমণ বিলাস’ হিসেবেই থেকে যাবে।
লেখক: প্রবাসী সাংবাদিক ও বাংলাদেশে বিনিয়োগকারী
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |