প্রতিদিন সকালে উঠে বাড়ির বড়দের সঙ্গে ক্ষেতে চলে যেতাম, তারপর সারাদিন ক্ষেতে কাটিয়ে আবার বাড়িতে ফিরে আসতাম। মাটির প্রকার অনুযায়ী বিভিন্ন ক্ষেতে বিভিন্ন রকমের সবজি আবাদ করা হতো। কোনটাতে উচ্ছে বা পটল বা মরিচ, আবার কোনটাতে বাঙ্গি বা তরমুজ বা ধুন্দল। প্রত্যেকটা ক্ষেত ছিলো আলাদাভাবে সুন্দর।
বীজ থেকে ছোট গাছ, তারপর একসময় ফুল, সেখান থেকে ফল। বাংগির ক্ষেতে বাংগি পাকা শুরু করলে অনেক দূর থেকে সেই ঘ্রাণ পাওয়া যেতো। আর পটলের গাছ হতো পটলের শাখা থেকে। সেটা হাট থেকে কিনে নিয়ে এসে বিশেষ প্রক্রিয়ায় সংরক্ষণ করে মাটিতে লাগানো হতো। প্রত্যেকটা ব্যাপার ছিলো আমাদের সাদামাটা শৈশবে উত্তেজনার উপকরণ।
গাছের জন্য তৈরি করা হচ্ছে মাচা
আর মাঝে মধ্যে আমি নিজে ক্ষেত পাহারা দেওয়া লোকেদের সঙ্গে কুঁড়ের মধ্যে থাকার বায়না ধরতাম। সেটা ছিলো একটা অনন্য অভিজ্ঞতা। কুঁড়ের মধ্যে শুয়ে রূপকথার গল্প শুনতে শুনতে আর তারা গুণতে গুণতে একসময় গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতাম। এরপর একসময় শহরতলিতে বসবাস শুরু করলেও সেইসব স্মৃতি মস্তিষ্ক খুব সযতনে তুলে রেখেছিলো। তাই যখন নিজে সন্তানের পিতা হলাম তখন স্বাভাবিকভাবে মাথার মধ্যে এমন একটা চিন্তা কাজ করছিলো যে ওদেরকে আমার শৈশবের কিঞ্চিৎ হলেও সেই ছোঁয়া দিয়ে বড় করবো।
কিন্তু অস্ট্রেলিয়াতে এই ক্ষেত আমি কোথায় পাবো! আমি যে ক্ষেতের সন্ধান করছি এটা আমার পরিচিত সবাই জানতো। এমনই একজন পরিচিত মানুষ ‘রামিন ফার্মের’ সন্ধান দিলেন। গিন্নিকে বলার সঙ্গে সঙ্গে উনি রাজি হয়ে গেলেন। বললেন ভালোই হবে কিছু তরতাজা শাক সবজি কিনে আনা যাবে। যেই ভাবা সেই কাজ। একদিন শনিবার সকালে তাহিয়া আর রায়ানকে নিয়ে ‘রামিন ফার্মে’ হাজির হলাম।
কলের লাঙল দিয়ে চলছে হালচাষ
তাহিয়া আর রায়ান খোলা জায়গা পেলে খুশি হয়, তার উপর এখানে ভাগ ভাগ করে বিভিন্ন প্লটের মধ্যে বিভিন্ন শস্য দেখে খুশিতে দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিলো। আমি পরিচিত হলাম ‘রামিন ফার্মের’ মালিক হারুন ভাইয়ের সঙ্গে। হারুন ভাইয়ের মুখে সারাক্ষণ হাসি লেগে থাকে, ঠিক যেমন বাংলাদেশের কৃষকের মুখে হাসি লেগে থাকে সুখে দুঃখে সারাক্ষণ। হারুন ভাই বাংলাদেশের টাঙ্গাইলের মানুষ। অস্ট্রেলিয়া এসে ইউনিভার্সিটি অব ওলোংগং থেকে ম্যানেজমেন্টে অনার্স-মাস্টার্স করে পেইন্টার হিসেবে কাজ করেন।
শখের বসে ২০১৬ সালে উনি এবং দুজন বন্ধু মিলে সাড়ে চার একর জমির উপর ফার্মটা শুরু করেন। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন অস্ট্রেলিয়ার খুব কম মাটি চাষাবাদের উপযোগী, বেশিরভাগ মাটি পাথুরে। শুরু করার পর একটা বছর তখন পেরিয়ে গেছে, কিন্তু লাভের কোন প্রকার দেখা নেই। উল্টো ঘরের থেকে পয়সা খরচ করে ফার্মের দেখাশোনা করতে হয়, তাই সংগত কারণেই উনার সঙ্গের সবাই ফার্মের ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেললেন। কিন্তু হারুন ভাই লেগে থাকলেন, কারণ উনি ফার্মের সময়টা খুবই উপভোগ করেন। তাই ভাবির কষ্ট হলেও হারুন ভাইয়ের এই ব্যাপারটা মেনে নিলেন। অস্ট্রেলিয়াতে সাপ্তাহিক দিনগুলোতে মানুষ এত ব্যস্ত থাকে যে নিশ্বাস ফেলার সময় থাকে না, তাই সবাই সপ্তাহান্তের দিনগুলো পরিবার ও বাচ্চাদের সঙ্গে কাটায়, কিন্তু হারুন ভাই সেটা না করে সেই সাত সকালে ক্ষেতে এসে হাজির হোন।
সবজি হাতে হারুন ভাই
ভাবি দুই বাচ্চা নিয়ে হিমসিম খাওয়া শুরু করলেন, তার উপর তখন উনার গর্ভে বেড়ে উঠছে উনাদের তৃতীয় সন্তান। তবু ভাবি দাঁতে দাঁত চেপে হারুন ভাইয়ের সমস্ত পাগলামি মেনে নিয়েছিলেন। হারুন ভাই সেই সকালে অবার্ন থেকে লেপিংটনে ফার্মের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়ে দেন। অবার্ন থেকে লেপিংটনে যেতে প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা ড্রাইভ করতে হয়, তবু উনি হার মানার পাত্র নন। ইতোমধ্যে উনি পাশে পেয়েছেন আরও কিছু বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষী যারা বিভিন্নভাবে সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। যেমন একবার দেশে উনার বাবা অসুস্থ হলে উনাকে বেশ কিছুদিনের জন্য দেশে যেতে হয়েছিলো, তখন তারা ক্ষেতে পানি দেয়ার কাজটা করে দিয়েছিলো।
‘রামিন ফার্মের’ জায়গাটা আমাদের পরিবারের সবারই খুব পছন্দ হয়ে গেলো আর সেইসঙ্গে হারুন ভাইয়ের মিষ্টি ব্যবহার। সবমিলিয়ে ‘রামিন ফার্মে’ গেলে আমাদের মনটা ভালো হয়ে যায়। আমি ক্ষেতের প্রত্যেকটা প্লট দেখি আর নিজের শৈশবে হারিয়ে যায়। ‘রামিন ফার্মের’ মাঝ বরাবর একটা পায়ে হাঁটার রাস্তা, তার দুপাশে বিভিন্ন সবজির প্লট। সেখানে কাঁচামরিচ, লালশাক, পুঁইশাক, কচুশাক, উচ্ছে, বেগুন, ধুন্দল, চিচিংগা, মিষ্টি কুমড়া, টোম্যাটো, বাংগি আর আছে লাউয়ের মাচা।
লাউয়ের কথা আলাদাভাবে বলতে হবে, কারণ সিডনির প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছে উনার ক্ষেতের লাউ এখন একটা অবশ্যম্ভাবী সবজি। দুপাশের ক্ষেত পার হয়ে একদম শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেলে সেখানে রয়েছে একটা খাল। সেই খালে সারাবছর কম বেশি পানি প্রবাহ থাকে। সেই খালে আমি সিডনিতে প্রথমবারের মতো ক্ষুদে পানা দেখতে পেলাম আর হোগলার বন। সেখান থেকে সেচের বেশিরভাগ পানির যোগান আসে বলে হারুন ভাই জানালেন।
প্রবাস জীবনে শিশুরা পাচ্ছে শেকড়ের ছোঁয়া
‘রামিন ফার্মে’ গেলে সবচেয়ে খুশি হয় রায়ান, কারণ সেখানে অবিরত সেচ দেয়ার ফলে মাটি থাকে নরম। সেই নরম মাটিতে হেঁটে বেড়ানো রায়ানের সবচেয়ে পছন্দের একটি কাজ। একটু পর রায়ানের জুতা মাটিতে ভারি হয়ে যায়, তখন সেটা খুলে দিলে সে আরো খুশি মনে কাদার মধ্যে হাঁটা শুরু করে। রায়ানের কর্মকাণ্ড দেখে আমি হারুন ভাইকে বলেছি উনি যেন রায়ানকে উনার ক্ষেতে নিয়োগ দিয়ে দেন। তার বিনিময়ে আমাকে কোটি টাকা পয়সা দিতে হবে না, শুধু ওকে তিনবেলা খেতে দিলেই হবে। তাও অন্তত ওর জ্বালাতন থেকে আমরা রেহাই পাবো।
হারুন ভাই বলেন, আমার ছোট ছেলেটাও রায়ানের বয়সি। নাম রাকিন। সেও ঠিক একইরকম দুষ্টু।
অবশ্য উনার বড় ছেলে যার নাম এই ফার্মের নামকরণ সে কিছুটা শান্ত আর সবার ছোট মেয়ে আইজা বেশ শান্ত স্বভাবের। রামিন, রাকিন সুযোগ পেলেই হারুন ভাইয়ের সঙ্গে ক্ষেতে চলে এসে বাবার সঙ্গে কাজে লেগে পরে। তাহিয়াও খুশি হয়, কারণ সে আমার সঙ্গে মাঝেমধ্যে ক্ষেতে নেমে পরে লালশাক, পুঁইশাক তুলতে। আমি কেটে দিই আর ও সেটা ওর হাতে ধরা পলিথিনে রাখে। এছাড়া আমি গ্রামের ছেলে বলে ক্ষেতের মধ্যে আগাছা হিসেবে হওয়া আরও কিছু শাক আবিষ্কার করেছি- যেমন বৈথার শাক, নোনতা শাক ইত্যাদি।
‘রামিন ফার্ম’ নিয়ে আমাদের উচ্ছ্বাসের শেষ নেই। শনিবার এলে তাহিয়া জিজ্ঞেস করতে থাকে আমরা আজ ‘রামিন ফার্মে’ যাবো কিনা। কারণ ‘রামিন ফার্ম’ সাধারণত শনিবার সকালের সময়টা খোলা থাকে। আপনিও যদি তরতাজা সবজি একেবারে ক্ষেত থেকে সঠিক দামে পেতে চান তাহলে চলে যান লেপিংটনের ‘রামিন ফার্মে’। ‘রামিন ফার্মে’ গিয়ে আমি বেশ কিছু মানুষের সঙ্গে পরিচত হয়েছি যারা আমাদের মা-বাবার বয়সী। উনারা এসে ক্ষেতের মধ্যে বসে পড়েন ধুলো ময়লার পরোয়া না করে। দৃশ্যটার মধ্যে এমন একটা অকৃত্রিমতা আছে যে আমি আর চোখ ফেরাতে পারি না।
তবে ‘রামিন ফার্মে’ গেলে ক্ষেতে ঢোকার আগে হারুন ভাইয়ের অনুমতি নিয়ে নেয়া ভালো। কারণ ক্ষেতের মধ্যে আমি বিছুটি গাছ দেখেছি যেটা আপনার গায়ে লাগলে ভয়ংকর চুলকানি শুরু হবে। আর হারুন ভাই বললেন, উনি একদিন একটা বড় সাপও দেখেছেন।
কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com । সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না! |