ক্যাটাগরি

উচ্ছেদের আগে পুনর্বাসন চান লালদিয়ার চরের বাসিন্দারা

শনিবার বিকালে পতেঙ্গার লালদিয়ার চর এলাকায় পুনর্বাসনের দাবিতে মানববন্ধন করেন তারা। তাদের দাবির প্রতি একাত্মতা জানিয়েছেন স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও রাজনৈতিক নেতারা।

গত বছরের ৮ ডিসেম্বর ‘জরিপ অনুযায়ী’ বন্দর এলাকার লালদিয়ার চরে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে আদালতের নির্দেশনা দুই মাসের মধ্যে বাস্তবায়নের নির্দেশ দেয় হাই কোর্ট।

১৯৭২ সালে বিমান ঘাঁটি সম্প্রসারণের কাজের কারণে ঘাঁটি সংলগ্ন এলাকা ছেড়ে আসা বাসিন্দারা লালদিয়ার চরে বসতি স্থাপন করেন; স্থায়ী বন্দোবস্তের কথা থাকলেও তা না পাওয়ায় এখন উচ্চ আদালতের নির্দেশে উচ্ছেদের উদ্যোগ নেওয়ায় শনিবার পুনর্বাসনের দাবিতে মানববন্ধন করেন চরের বাসিন্দারা। ছবি: সুমন বাবু

চট্টগ্রামের পুলিশ কমিশনার, জেলা প্রশাসক, র‌্যাব কমান্ডার, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) চেয়ারম্যান ও সিটি করপোরেশনের প্রশাসকসহ সব বিবাদীদের রায় বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশনার পাশাপাশি সেবা সংস্থাগুলোকেও (ওয়াসা, বিদ্যুৎ ও গ্যাস কর্তৃপক্ষ) এ সময়ের মধ্যে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেয় আদালত।

এরপর ১৭ ফেব্রুয়ারি পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ জানায়, হাই কোর্টের আদেশ অনুসারে সহসাই অবৈধ দখলদারদের বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে উচ্ছেদ করা হবে।

সব ‘অবৈধ দখলদারদের’ অবিলম্বে ওই জায়গা ছেড়ে দেওয়ারও অনুরোধ করা হয় ওই বিজ্ঞপ্তিতে।

১৯৭২ সালে বিমান ঘাঁটি সম্প্রসারণের কাজের কারণে ঘাঁটি সংলগ্ন এলাকা ছেড়ে আসা বাসিন্দারা লালদিয়ার চরে বসতি স্থাপন করেন; স্থায়ী বন্দোবস্তের কথা থাকলেও তা না পাওয়ায় এখন উচ্চ আদালতের নির্দেশে উচ্ছেদের উদ্যোগ নেওয়ায় শনিবার পুনর্বাসনের দাবিতে মানববন্ধন করেন চরের বাসিন্দারা। ছবি: সুমন বাবু

সবশেষ বৃহস্পতিবার রাতে লালদিয়ার চরে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয় বলে জানান সেখানকার বাসিন্দারা।

বিকেলে কর্মসূচিতে লালদিয়ার চর উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি আলমগীর হাসান বলেন, “এখানকার ২৩০০ পরিবারের ১৪ হাজার বাসিন্দা পুনর্বাসন চায়। বুলডোজার দিয়ে উচ্ছেদ না করে আগে আমাদের পুনর্বাসন করা হোক।

“উচ্চ আদালতের নির্দেশ আমাদের জন্য নয়, যারা নদীর ২০ ফুটের মধ্যে দখলকারী তাদের জন্য। আদেশের সুযোগে বন্দর চালাকির আশ্রয় নিয়েছে। আমরা নদী থেকে ৫০০ ফুট দূরে বসবাস করি। ২০১৯ সালে জেটি করবে বলে ২০ একর ভূমি থেকে আমাদের উচ্ছেদ করা হয়। এখন বাকিটাও উচ্ছেদের আয়োজন করা হচ্ছে। বন্দর কর্তৃপক্ষ এই জমি ইজারা দেওয়ার পাঁয়তারা করছে।”

চট্টগ্রামের লালদিয়ার চরের বাসিন্দাদের উচ্ছেদের উদ্যোগ নেওয়ায় শনিবার পুনর্বাসনের দাবিতে মানববন্ধন করেন তারা। ছবি: সুমন বাবু

সমাবেশে ৪১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ছালেহ আহমদ চৌধুরী বলেন, “প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন এই মুজিববর্ষে ৫০ হাজার গৃহহীন ঘর পাবে। তাহলে লালদিয়ার চরের মানুষ কেন পাবে না? জননেত্রীর কাছে আবেদন এদের পুনর্বাসন করা হোক। আমরা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করছি।”

নগর আওয়ামী লীগ নেতা রোটারিয়ান মোহাম্মদ ইলিয়াস বলেন, “১৯৭২ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিমান বাহিনীর ঘাঁটি সম্প্রসারণের প্রকল্প নিলে তখন লালদিয়ার চর গ্রামের বাসিন্দা নিজেদের পৈত্রিক বসতভিটা ছেড়ে এখানে এসেছিল। তারা এখন উচ্ছেদ আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে।

“মানবতার মা প্রধানমন্ত্রী আশ্রয়ের খোঁজে আসা রোহিঙ্গাদেরও ঠাঁই দিয়েছেন। এই উচ্ছেদে হতভাগ্য ১৪ হাজার মানুষ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? তাদের মাথা গোঁজার ব্যবস্থা করা হোক।”

চট্টগ্রামের লালদিয়ার চরের বাসিন্দাদের উচ্ছেদের উদ্যোগ নেওয়ায় শনিবার পুনর্বাসনের দাবিতে মানববন্ধন করেন তারা। ছবি: সুমন বাবু

নগর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম রনি বলেন, “নিপীড়িত মানুষের পাশে আমাদের অবস্থান। স্বাধীনতার পর এই জনপদের মানুষ নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে এখানে আশ্রয় নিয়েছিল। কোনো ক্ষতিপূরণ না দিয়ে, কোনো পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করে উচ্ছেদের প্রক্রিয়া আমরা প্রত্যাখ্যান করি। ক্ষতিপূরণ বা পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করলে চট্টগ্রামের মানুষ এই উদ্যোগ মেনে নেবে না।”

কর্মসূচিতে বক্তব্য রাখেন ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জিয়াউল হক সুমন, নারী কাউন্সিলর শাহানুর বেগম, নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া দস্তগীর প্রমুখ।

শনিবার ১২ নম্বর ঘাট এলাকা থেকে বিজয় নগর পর্যন্ত প্রায় দেড় কিলোমিটার দীর্ঘ মানববন্ধনে হাজার খানেক বাসিন্দা অংশ নেন।

সি ব্লক এলাকায় মানববন্ধনকারীদের পাশে ফুটপাতে ক্র্যাচ নিয়ে বসে থাকা দিদারুল আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পায়ের সমস্যার কারণে আমি ব্যাটারি রিকশা চালাই। আর কিছু করতে পারি না। এখানে ২০ বছর ধরে থাকি। তুলে দিলে কোথায় যাব?”

আবদুস শুক্কুর নামে ৮০ বছরের এক বৃদ্ধ ভোটার আইডি কার্ড দেখিয়ে বলেন, “৪৯ বছর ধরে আছি। এই ঠিকানায় ভোটার। বাড়িঘর সব এখানে। পরশু রাত থেকে বিদ্যুৎ নেই। উচ্ছেদ করলে যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। সরকারের জমি লাগলে নিবে। কিন্তু আমাদের আগে ঘর দিক।”

১৯৭২ সালে বিমান ঘাঁটি সম্প্রসারণের কাজের কারণে ঘাঁটি সংলগ্ন এলাকা ছেড়ে আসা বাসিন্দারা লালদিয়ার চরে বসতি স্থাপন করেন; স্থায়ী বন্দোবস্তের কথা থাকলেও তা না পাওয়ায় এখন উচ্চ আদালতের নির্দেশে উচ্ছেদের উদ্যোগ নেওয়ায় শনিবার পুনর্বাসনের দাবিতে মানববন্ধন করেন চরের বাসিন্দারা। ছবি: সুমন বাবু

ইকবাল হোসেন নামের এক তরুণ বলেন, “একটা বেসরকারি স্কুলে পড়াতাম। করোনায় চাকরি চলে গেছে। কোনো রকমে দিন পার করছি। প্রধানমন্ত্রী আমাদের ঘর দিক, তাহলে চলে যাব।”

পাঁচ দশকের বসতি

লালদিয়ার চরে বসতি শুরু হয় ১৯৭২ সালে। সে সময় বিমান ঘাঁটি সম্প্রসারণের জন্য স্থানীয়দের তুলে দেওয়া হলে তারা ঠাঁই নেন লালদিয়ার চরে।

১৩৮০ বাংলা সনে (১৯৭৩-১৯৭৪ সালে) জেলা প্রশাসন এখানকার বাসিন্দাদের এক সনা বন্দোবস্ত দেন।

সে সময় এখানে লালদিয়ার চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি নির্মিত হয়। ১৯৭৪ সালে জলোচ্ছ্বাস থেকে চর রক্ষায় সরকার বেড়িবাঁধ নির্মাণ করে।

আলমগীর হাসান বলেন, “বঙ্গবন্ধুর শাহাদাত বরণের পর স্থানীয় প্রভাবশালী আবুল হাশেম ও আবুল কাশেম লালদিয়ার চরের বন্দোবস্তের বিরুদ্ধে মামলা করলে জেলা প্রশাসন বঙ্গবন্ধুর প্রতিশ্রুত স্থায়ী বন্দোবস্ত আর আমাদের দেয়নি।

“জিয়া ও এরশাদ সরকারের সময়ে এই জমি বিএস জরিপে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের নামে লিপিবদ্ধ করা হয়। এর ভিত্তিতে বন্দর আমাদের বেআইনি দখলদার বলে উচ্ছেদের ষড়যন্ত্র শুরু করে।”

২০০৫ সালের ১২ জুলাই প্রথমবার লালদিয়ার চরের ৫০০ পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়। ওই অংশে একটি বেসরকারি অফডককে বন্দর ইজারা দেয় বলে জানান আলমগীর।

তিনি বলেন, “বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে জেলা প্রশাসন আমাদের বন্দবস্ত দিয়েছিল। অথচ তাদের কাছেও আমরা আজ দখলদার।

“আমরা জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, মন্ত্রী-সাংসদ, জেলা প্রশাসক, সাবেক ও বর্তমান মেয়র সবার সাথে যোগাযোগ করেছি। সবাই আমাদের বিষয়টি জানেন। আমরা মানবিক সমাধান চাই।”

উচ্চ আদালতের নির্দেশে ২০১৯ সালের ২২ জুলাই ২৫০ স্থাপনা উচ্ছেদ করে প্রায় ২০ একর জমি দখলমুক্ত করে বন্দর কর্তৃপক্ষ।

১৯৭২ সালে বিমান ঘাঁটি সম্প্রসারণের কাজের কারণে ঘাঁটি সংলগ্ন এলাকা ছেড়ে আসা বাসিন্দারা লালদিয়ার চরে বসতি স্থাপন করেন; স্থায়ী বন্দোবস্তের কথা থাকলেও তা না পাওয়ায় এখন উচ্চ আদালতের নির্দেশে উচ্ছেদের উদ্যোগ নেওয়ায় শনিবার পুনর্বাসনের দাবিতে মানববন্ধন করেন চরের বাসিন্দারা। ছবি: সুমন বাবু

আদালতের নির্দেশে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন ২০১৪ সালের ৯ নভেম্বর কর্ণফুলীর দুই তীরে সীমানা নির্ধারণের কাজ শুরু করে। নেভাল অ্যাকাডেমি সংলগ্ন নদীর মোহনা থেকে মোহরা এলাকা পর্যন্ত অংশে ২০১৫ সালে জরিপের কাজ শেষ হয়।

সেই জরিপে নদীর দুই তীরে প্রায় আড়াই হাজার অবৈধ স্থাপনা চিহ্নিত করে জেলা প্রশাসন। প্রতিবেদনটি ২০১৫ সালের ৯ নভেম্বর উচ্চ আদালতে দাখিল করা হয়।

এরপর ২০১৬ সালের ১৬ অগাস্ট হাই কোর্টের একটি বেঞ্চ কর্ণফুলীর দুই তীরে গড়ে ওঠা স্থাপনা সরাতে ৯০ দিনের সময় বেঁধে দেয়।