চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তীরবর্তী লালদিয়ার চরের ৫২ একর জমিতে সোমবার সকাল থেকে বন্দর কর্তৃপক্ষের উচ্ছেদ অভিযান শুরু হয়। চরের বাসিন্দারা গত কিছু দিন ধরে উচ্ছেদ শুরুর আগে পুনর্বাসনের দাবি জানিয়ে এলেও কারও কোনো প্রতিশ্রুতি তারা পাননি।
কর্তৃপক্ষের অনড় অবস্থানের কারণে শনি ও রোববার চরের বাসিন্দাদের অনেকেই ঘরবাড়ি ছাড়েন। বাকিরা সোমবার সকাল ও দুপুরে ঘর ছেড়েছেন।
এসব একতলা আধা পাকা ও কাঁচা ঘর ভেঙে নিয়ে যাচ্ছিলেন বাসিন্দাদের কেউ কেউ। অধিকাংশই এসব কাঠামো বিক্রি করে দিয়েছেন সস্তায়।
৫৯ বছর বয়সী আলী নূর এসবের কিছুই করেননি। ঘরের মালপত্র বের করেছেন। কিন্তু কোথায় যাবেন, জানা নেই।
আলী নূর জানান, ৯ বছর বয়সে বর্তমান বিমান ঘাঁটি এলাকার বাড়িঘর ছেড়ে বাবা কালা মিয়ার সাথে তারা এসেছিলেন লালদিয়ার চরে। এরপর এখানেই বেড়ে ওঠা, ঘর-সংসার সব। এখানেই জন্ম হয় তার দুই ছেলে ও এক মেয়ের।
“ক্যান্সারে বড় ছেলেটা মরি গেছে। ছোট ছেলেটা ১২ নম্বর খালের পাশে চা দোকান দিছিল। মেয়ের নামে নাম দিছিলাম ‘শিউলি ঝাল বিতান’। ওই দোকানও ভেঙে দিছে। এখন আর কোনো রুজির ব্যবস্থা নাই। চাইর বছর আগে সাড়ে চাইর লাখ টাকা খরচ করে এই ঘর করছি। ঘর ভাঙি কোথায় নিব? কোথায় যাব সেটাই জানি না।”
নিজেদের ঘরের দেয়াল নিজেদেরই ভাঙতে হল ইউনুস মিয়ার পরিবারকে।
আলী নূর বলেন, “আমাদের বাপ-দাদারা সহজ সরল মানুষ আছিল। … বলছিল, তাদের এখানে জমি দিবে। তাই তারা চলে আসছিল। আমরাও ৪৯ বছর ধরে আছি। এরকম হবে ভাবিনি। এত বড় দেশে কোথাও আমাদের জায়গা হল না।
“নেতাদের বলছিলাম আমারে একটা গুলি দেন। আর তাইলে কষ্ট করতে হবে না। খেটে খাওয়ার মত বয়সও আমার নাই।”
লালদিয়ার চরের বাসিন্দা নূর আকতারের স্বামী শামসুল আলম মাস চারেক ধরে অসুস্থ। তিন ছেলে, দুই মেয়ে আর নাতি-নাতনি নিয়ে তার সংসার।
সেই সংসারে সোমবার দুপুর পর্যন্ত চুলা জ্বলেনি। শামসুল আলম এ ব্লকের গলির ভেতর এ মাথা ও মাথা হাঁটতে হাঁটতে কাঁদছেন।
নূর আকতার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ১২ নম্বর খালের মুখে আমার স্বামীর দোকান ছিল। ২০১৯ সালে উচ্ছেদের সময় ওই দোকান ভেঙে দেয়। চার মাস আগে স্ট্রোক করে। এরপর লোকজন চাঁদা তুলে ডাক্তারের কাছে পাঠায়। মানুষের কাছে চেয়ে চিন্তে দিন চলে।
“ঘর ভাঙার লোক যোগাড় করতে পারিনি। নিজেরা মালপত্র সরাচ্ছি। আপনাদের বলে কি হবে? মিডিয়ায় তো আমাদের কথা দেখায় না।”
নিজের ঘরের দেয়াল নিজেই হাতুড়ি দিয়ে ভাঙছিলেন ইউনুস মিয়া। ছেলে আবদুর রহিম ছোটাছুটি করছিলেন গাড়ি ভাড়া যোগাড়ের চেষ্টায়।
আবদুর রহিমের স্ত্রী নূর ফানা আক্তার রূপা বলেন, “আমাদের আল্লাহ ছাড়া কেউ নাই। নিজের ঘর নিজে ভাঙা মানে নিজের কলিজা নিজে টেনে টেনে ছিঁড়া।
“আমার শ্বশুর দিনমজুরি করে। ১৫ নম্বরে দুইটা ঘর সাত হাজার টাকায় ভাড়া করছে আমার শ্বশুর। মালপত্র নিয়ে যে যাব, টাকার অভাবে গাড়ি ভাড়া করতে পারিনি। এখন ছেলেমেয়ে কোথায় গিয়ে কোন স্কুলে পড়বে তাও জানি না।”
ইউনুস মিয়া ১৯৭২ সালে বাবা-মা ভাইবোনদের সাথে লালদিয়ার চরে আসেন। এখন পাঁচ ছেলে, এক মেয়ে আর নাতি-নাতনি মিলিয়ে ২০ জনের সংসার। উচ্ছেদের খবরে চার ছেলে এক মেয়ে আগেই লালদিয়ার চর ছেড়ে চলে গেছেন।
তিনি বলেন, “আমরা যারা ভিটেমাটি ছেড়ে আসছিলাম, শুধু আমাদের পুনর্বাসন চেয়েছিলাম। আর কিছু না। এখন এই ঘরটা বিক্রি করতে চাচ্ছি। যারা ভেঙে নিয়ে যাবে তারা দুই দিন আগে ২০ হাজার বলছিল। এখন নিতেও চাচ্ছে না।”
রশিদুল ইসলাম নামে চরের এক বাসিন্দা বলেন, “রোহিঙ্গাদের আমাদের চোখের সামনে এই কর্ণফুলী নদী দিয়ে কত সুন্দর করে ভাসানচর নেওয়া হল। আমাদের কোথাও ঠাঁই হল না।
“আদালত নাকি রায় দিয়েছে। আমাদের অবস্থাটা আদালতে জানাতে পারলে এরকম রায় দিত না। আমাদের কেউ নাই। নেতারাও আন্দোলন করছে কয়দিন। তারপর বলে, চলে যাও। ২০১৯ সালে উচ্ছেদের পর মসজিদে এসে এমপি (এমএ লতিফ) কথা দিছিলেন, আর উচ্ছেদ হবে না। এই জমিতে বড় বড় মানুষের নজর পড়ছে। যারা এরকম করল, তাদের বিচার আল্লাহ করবে।”
মো. ইব্রাহিম ৩২ বছর বয়সী এক তরুণ বলেন, “আমার দাদু নূর মিয়া এখানে আসছিল। এই ভিটায় আমার জন্ম। এখানে দাদা-দাদির কবর। দুই ছেলে, বাবা-মা, স্ত্রী নিয়ে থাকি। কম্পিউটারের দোকান করতাম। জেলা প্রশাসনের কাছে, পুলিশের কাছে, বন্দরের কাছে লেখা সব চিঠি আমি টাইপ করছি। কিছুই হইল না। আমার দোকানটাও ভেঙে দিছে। ভিটামাটি ছেড়ে যাওয়া মরণের সমান।”
বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান সোমবার সকালে চরের অদূরে বোট ক্লাবে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন।
তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে লালদিয়ার চরে ‘অবৈধ বসবাসকারীরা’ ছিল। আদালতের রায় বন্দরের পক্ষে এসেছে। আদালতের নির্দেশনা মেনে দখলদারদের ‘পর্যাপ্ত সময়’ দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় নেতাদের অনুরোধে উচ্ছেদের সময় দুই দফা পেছানো হয়েছে।
ঘর ভেঙে জিনিসপত্র সরিয়ে নিচ্ছে একটি পরিবার
“যদিও তারা অবৈধ দখলদার, তাদের যেতে যেন অসুবিধা না হয়। তাদের প্রতি যেন অমানবিক আচরণ না হয়। কোনো বুলডোজার, লং বুম, এক্সক্যাভেটর নিতে হয়নি। কোনো প্রতিরোধ করেনি। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটা একমাত্র শান্তিপূর্ণ উচ্ছেদ। কোনো বল প্রয়োগ করতে হয়নি। তারা স্বেচ্ছায় চলে যাচ্ছেন।”
এই জমিতে পরে কী করা হবে জানতে চাইলে বন্দর চেয়ারম্যান বলেন, “পাশে পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনাল হচ্ছে। এটার ইয়ার্ডের প্রয়োজন হবে। এটা আমরা পরে দেখব। স্ট্র্যাটেজিক মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী যেসব স্থাপনা করার কথা, সেসব আমরা করব।”
১৯৭২ সালে বিমান ঘাঁটি সম্প্রসারণের জন্য ১৩০টি পরিবারকে তাদের বসতি থেকে সরিয়ে লালদিয়ার চরে নিয়ে আসা হয়। তখন স্থায়ী বন্দোবস্তির আশ্বাসে তারা এসেছিলেন।
এরপর ১৯৭৩-৭৪ সালে ওই জমি এক বছরের জন্য বন্দোবস্তও দেওয়া হয়। পরে জিয়া ও এরশাদের আমলে এই জমি বন্দরের নামে বিএস খতিয়ানভুক্ত হয়।
উচ্ছেদ শুরুর পাশাপাশি চরের বিমানবন্দর সড়ক সংলগ্ন অংশে বাঁশ পুঁতে কাঁটাতার টানার কাজও শুরু হয়েছে
২০০৫ সালে লালদিয়ার চরের একাংশ উচ্ছেদ করা হয়। সেখানে বর্তমানে একটি বেসরকারি কন্টেইনার ডিপো আছে। ২০১৯ সালের জুলাইয়ে ১২ ও ১৩ নম্বর খাল সংলগ্ন এলাকায় উচ্ছেদ চালিয়ে চরের ২০ একর জমি নিজেদের দখলে নেয় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ।
কর্ণফুলী নদীর দুই পাড় দখলমুক্ত করতে করা এক রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে গত বছরের ডিসেম্বরে উচ্চ আদালত লালদিয়ার চরের স্থাপনা সরাতে দুই মাসের সময় বেঁধে দেয়।
এরপর ফেব্রুয়ারি মাসে বন্দর উচ্ছেদের উদ্যোগ নিলে আন্দোলনে নামে চরের মানুষ। সবশেষ এই চরে ২ হাজার ৩০০ পরিবারের ১৪ হাজার মানুষের বসতি ছিল।
নৌ প্রতিমন্ত্রী উচ্ছেদের বিষয়ে অনড় অবস্থানের কথা জানালে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ, বিএনপি, স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর, শ্রমিক লীগ ও ছাত্রলীগ নেতারা চরের বাসিন্দাদের পুনর্বাসনের দাবি জানান।
উচ্ছেদ শুরুর পাশাপাশি চরের বিমানবন্দর সড়ক সংলগ্ন অংশে বাঁশ পুঁতে কাঁটাতার টানার কাজও শুরু হয়েছে
এরপর জেলা প্রশাসক সরকারের উচ্চ পর্যায়ে চিঠি লিখে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের চিহ্নিত করে পুনর্বাসনের জন্য সময় চেয়ে আবেদন করেন। কিন্তু কোনো সুখবর চরের মানুষ পায়নি।
এরপর শনিবার চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে এক বৈঠকে উচ্ছেদে অনড় অবস্থানের কথা জানিয়ে দেন। তখন থেকেই এলাকা ছাড়তে শুরু করেন চরের বাসিন্দারা। চরের বিমানবন্দর সড়ক সংলগ্ন অংশে বাঁশ পুঁতে কাঁটাতার টানার কাজ শুরু হয় সোমবার সকাল থেকে।
বেলা ২টার দিকে রোকেয়া আক্তার নামের এক বৃদ্ধা বিদায়ের ক্ষণে প্রতিবেশীকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। ততক্ষণে কাঁটাতার ঘিরে ফেলেছে তার সারাজীবনের ঘর-বসতির সীমানা।
পুরনো খবর-
চট্টগ্রামের লালদিয়ার চরে উচ্ছেদ শুরু
লালদিয়ার চরে উচ্ছেদ অভিযানে অনড় নৌ প্রতিমন্ত্রী
পুনর্বাসন ছাড়া লালদিয়ার চর ‘ছাড়বেন না’ বাসিন্দারা
লালদিয়ার চরবাসীর পুনর্বাসন চান সুজনও
উচ্ছেদের আগে পুনর্বাসন চান লালদিয়ার চরের বাসিন্দারা