ক্যাটাগরি

কিশোর এবার জামিন পাবেন? জানা যাবে বুধবার

তার জামিন আবেদনের ওপর শুনানি শেষে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের ভার্চুয়াল হাই কোর্ট বেঞ্চ সোমবার শুনানি ও আদেশের জন্য এই দিন ঠিক করে দেন।

আদালতে কিশোরের জামিন আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সারওয়ার হোসেন বাপ্পী।

এ মামলায় কারাগারে থাকা অবস্থায় গত ২৫ ফেব্রুয়ারি রাতে লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যু হয়। আহমেদ কবির কিশোরের পাশাপাশি মুশতাক আহমেদের জন্যও হাই কোর্টে জামিন চাওয়া হয়েছিল।

শুনানিতে আইনজীবী জ্যেতির্ময় বড়ুয়া বলেন, “দুজন আসামির জামিন আবেদন করেছিলাম। এক নম্বর আবেদনকারী হলেন আহমেদ কবির কিশোর। আর দুই নম্বর আবেদনকারী হলেন মুশতাক আহমেদ।

“এই মুশতাক আহমেদ গত ২৫ ফেব্রুয়ারি হাই সিকিউরিটি জেলে মৃত্যুবরণ করেছেন। আমি এক নম্বর আবেদনকারী আহমেদ কবির কিশোরের পক্ষে জামিন আবেদনটা উপস্থাপন করছি।”

মুশতাক আহমেদ

তখন বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক এম. ইনায়েতুর রহিম বলেন, “এটা হলফনামা করে বললে ভালো ছিল জনাব জ্যেতির্ময় বড়ুয়া। এটা (মুশতাক আহমেদের জামিন আবেদন) তো উত্থাপিত হয়নি মর্মে খারিজ করা ঠিক হবে না। আ্যবেট (বাতিল) হয়ে গেছে বললে আমরা পত্রিকার তথ্য কতটুকু নিতে পারব। হলফনামা করে বললে আমার মনে হয় বেটার ছিল।”

জ্যেতির্ময় বড়ুয়া বলেন, “তার মৃত্যুর কারণ নিয়ে আমার সাবমিশন আছে।”

বিচারপতি ইনায়েতুর রহিম তখন বলেন, “সে তো ভিন্ন কথা। মৃত্যুর কারণ যাই হোক। স্বাভাবিক মৃত্যু হোক বা দুর্ঘটনাজনিত হোক- সেটা তো আলাদা বিষয়। যেহেতু উনি নাই, সে কারণে আবেদনটি উত্থাপিত হয়নি মর্মে খারিজের কোনো সুযোগ নাই।”

ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সারওয়ার হোসেনও তখন বলেন, মৃত্যুর বিষয়টি হলফনামা করে বললে আবেদনটি বাতিল হয়ে যাবে।

বিচারপতি ইনায়েতুর রহিম বলেন, “অ্যাবেট যেহেতু হয়ে যাচ্ছে, তাই এর রেকর্ড থাকা দরকার। যে কারণে হলফনামা করে বলতে হবে। আমরা পরশু আদেশের জন্য রাখছি। সেদিন আপনি (জ্যেতির্ময় বড়ুয়া) একটি হলফনামা নিয়ে আসেন।”

জামিন শুনানিতে আইনজীবী জ্যেতির্ময় বড়ুয়া বলেন, কিশোরের বিরুদ্ধে অভিযোগটা ছিল ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২১, ২৫, ৩১ এবং ৩৫ ধারায়। তাদের দুজনকেই (মুশতাক আহমেদ ও আহমেদ কবির কিশোর) গত বছর ৫ মে গ্রেপ্তার করা হয়।

কিশোরকে কাকরাইলের বাসা থেকে গ্রেপ্তার এবং তার বাসা থেকে মোবাইল, কম্পিউটার, হার্ডডিস্ক জব্দের বর্ণনা মামলার এজাহার থেকে তুলে ধরেন এ আইনজীবী।

তিনি বলেন, “তিনি কীভাবে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটালেন, এফআইআরের কোথাও তার উল্লেখ নাই। বিভ্রান্তি সৃষ্টি কীভাবে করলেন, তারও কোনো রকম বর্ণনা এই এফআইআর-এ নাই।”

জ্যেতির্ময় বলেন, “কিশোর একজন কার্টুনিস্ট। কার্টুনিস্ট কী করেন? সারা পৃথিবীতে সরকারে যারা থাকেন, তাদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করা, তাদের বিভিন্ন রকমের কার্টুন আঁকা- এটা তো আজকে নতুন কোনো কিছু না।

“এই কার্টুনের জন্যই যে তিনি কেবল পরিচিত, তা না। তিনি একজন মানবাধিকার কর্মী হিসেবে, প্রান্তিক জনগণের অধিকার কর্মী হিসেবে বিশেষ করে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের মুখপাত্র হিসেবে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় পুরস্কৃত হয়েছেন। জেলে থাকা অবস্থায়ও একজন সেরা কার্টুনিস্ট হিসেবে আন্তর্জাতিক পুরস্কার তাকে দেওয়া হয়েছে।”

বন্দি মুশতাকের মৃত্যুর দায় এড়াবার নয়: মানবাধিকার কমিশন
 

কারাগারে মুশতাক আহমেদের মৃত্যু, শুক্রবার পুলিশের লাঠিপেটার প্রতিবাদ এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবিতে শনিবার শাহবাগ মোড়ে প্ল্যাকার্ড হাতে দুই নারী আন্দোলনকারী। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

আইনজীবী বলেন, “একজন কার্টুনিস্টকে ধরলেন এবং ধরার পরে তার মোবাইল ফোন, হার্ডডিস্ক সবগুলো থেকেই তারা তথ্যগুলো উদ্ধার করলেন। তার আগে কিছুই জানতেন না। কথাটা এই কারণে বলছি, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় টেকনিক্যাল কতগুলো টার্ম আছে।

“আইনের ধারাগুলোর ভাষাগত গাঁথুনিই এরকম যে, ‘যদি এমন কিছু প্রকাশ করেন’ বা ‘এমন কিছু তথ্য সম্প্রচার করেন’। অর্থাৎ যেটি ইতোমধ্যে প্রচার প্রকাশ হয়ে গেছে…। তার মানে হচ্ছে আহমেদ কবির কিশোর তথ্য প্রকাশ করেছেন, এমন কিছু বিষয় সম্প্রচার করেছেন, যেটা রাষ্ট্রবিরোধী, মাহামারী করোনাভাইরাস সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে বিভ্রান্তিকর, বা সরকার দলীয় বিভিন্ন নেতার বিষয়ে গুজব ছড়ানো হতে পারে।

“যিনি অভিযোগ করছেন, তার কাছে ইতোমধ্যে এগুলো আছে। আমার ঘরে গিয়ে আমার কম্পিউটারের হার্ডডিস্ক থেকে তথ্যগুলো পাবেন, তারপর সেটা নিয়ে আমার বিরুদ্ধে মামলা করবেন- বিষয়টা সেরকম না। আইনটিই সেরকম না। তৃতীয় পক্ষের কাছে যখন এসব অ্যাভিডেন্স চলে গেছে, যখন তথ্যগুলো সব তাদের কাছে আছে, তখন সেটি দিয়ে মামলা করতে হবে।”

বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক বলেন, “এজাহারে বলো হচ্ছে, কতগুলো অ্যাপ থেকে আসামিরা চ্যাট করেছেন, ফেইসবুকেও দিয়েছেন।”

জ্যেতির্ময় বড়ুয়া বলেন, “হোয়াটস অ্যাপ দিয়ে আমি চ্যাট করি আর ফেইসবুকে দিই, সেটা তো আগে তাদের কাছে থাকতে হবে। উনারা সাইবার টহল দিয়েছেন। সাইবার টহল দিয়ে উনারা জানতে পেরেছেন।”

বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম বলেন, “জানি না, হয়ত ফেইসবুকে দেখার পরে চিহ্নিত করে তার কাছে গেছে। আমাদের দেশে তো এটা নতুন আইন। সবারই ধারণা কম। প্রশিক্ষিত লোকের অভাব, প্রশিক্ষিত তদন্তকারীর অভাব। এগুলো তো আছেই।”

তখন জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, “আমি আপনার সাথে শতভাগ একমত। কিন্তু এর সুবিধা তো পুলিশ পাবে না, আসামি পাবে।”

বিচারের মুখে কিশোর-মুশতাক-দিদার, মিনহাজ-তাসনিম খলিলরা অভিযোগপত্রে বাদ

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কার্টুনিস্ট গ্রেপ্তার
 

এ আইনজীবী বলেন, “গত ৫ মে মামলা হল। ৪০ ধারা অনুযায়ী তাদের ৬০ দিনের মধ্যে অভিযোগপত্র দেওয়ার কথা। না হলে আরও ১৫ দিন। তাও না হলে সাইবার ট্রাইব্যুনালের কাছ থেকে অতিরিক্তি ৩০ দিন সময় নিয়ে তারা ১০৫ দিনের মধ্যে তদন্ত সম্পন্ন করার কথা।

“আসামি দিদারুল আলম; যাকে আপনারা জামিন দিয়েছেন, প্রয়াত মুশতাক আহমেদ এবং আহমেদ কবির কিশোর। এই তিনজনের বিরুদ্ধে উনারা ১৫ জানুয়ারি অভিযোগপত্র দাখিল করেছেন।”

জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, “ট্রাইব্যুনাল সেই অভিযোগপত্র গ্রহণ করেননি। না করে তিনি আবার তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। সেই রিপোর্ট ২৩ ফেব্রুয়ারি জমা দেওয়ার কথা ছিল। সেদিন আসামি মুশতাক আহমেদ ও আহমেদ কবির কিশোরকে মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করা হয়।

“হাজির করার পর কিশোর আমাদের জানিয়েছেন, তাকে কাস্টডিতে শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে। নির্যাতনের কারণে তার ডান কান প্রায় অকেজো হয়ে পড়েছে। নির্যাতনের কারণে বাঁ পায়ে ক্ষত সৃষ্টি হয়ে, সেটা এখন ঘাঁয়ের পর্যয়ে চলে গেছে।”

আইনজীবী বলেন, এসব বিষয় মহানগর দায়রা জজ আদালতে জামিন শুনানির সময়ও মৌখিকভাবে বলা হয়েছে। কিন্তু জামিন হয়নি।

“একজন আসামি মারাই গেলেন অসুস্থতার কারণে। একজন স্বনামধন্য কার্টুনিস্ট, তার যথেষ্ট অবস্থান আছে। তার চাইতেও বড় কথা তিনি চরমভাবে অসুস্থ। তার মধ্যেও গতকাল রিমান্ডের আবেদন করা হয়েছিল। চার্জশিট দাখিল করার পর কোন আইনে তারা রিমান্ড আবেদন করেছেন, জানি না।”

ওই রিমান্ড আবেদন নামঞ্জুর হয়েছে জানিয়ে জ্যোতির্ময় বলেন, রিমান্ডের আবেদন করলে আসমিকে হাজির করতে হয়। কিন্তু আসামিকে হাজির না করেই শুনানি হয়েছে।

“আমি ধরে নিয়েছিলাম আসামিকে হাজির করা হবে। তাই আসামির তরফ থেকে একটি আবেদন ছিল যে, ২০১৩ সালের ‘নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩ অনুযায়ী পুলিশ কাস্টডিতে তাকে (কিশোর) নির্যাতন করা হয়, সেটা ফৌজদারি অপরাধ। কিন্তু যেহেতু তাকে জেলখানা থেকে আনেনি, ফলে ওই আবেদনটি আর উত্থাপন করার সুযোগ পাইনি।”

বিচারপতি ইনায়েতুর রহিম তখন বলেন, “ওইটার সাথে এই আবেদনের কোনো সম্পর্ক নাই।”

আইনজীবী বলেন, “যেহেতু আমি অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে জামিন আবেদন করেছি, তাই বিষয়টা জানিয়ে রাখলাম।” 

পরে আদালত বুধবার শুনানি এবং আদেশের জন্য দিন রেখে শুনানি শেষ করে।

কার্টুনিস্ট কিশোরকে রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন নাকচ

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বন্দি মুশতাকের কারাগারে মৃত্যু

কার্টুনিস্ট কিশোর পেলেন ‘রবার্ট রাসেল কারেজ অ্যাওয়ার্ড’
 

প্রেক্ষাপট

করোনাভাইরাস সঙ্কটের মধ্যে গতবছর ৫ মে কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর এবং অনলাইনে লেখালেখিতে সক্রিয় ব্যবসায়ী মুশতাক আহমেদকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। পরে তাদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয়।

পরদিন ‘সরকারবিরোধী প্রচার ও গুজব ছড়ানোর’ অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তাদের বিরুদ্ধে রমনা থানায় মামলা করা হয়।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা রমনা থানার এসআই জামশেদুল ইসলাম তখন বলেছিলেন, কার্টুনিস্ট কিশোর তার ‘আমি কিশোর’ নামের ফেইসবুক একাউন্টে করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে সরকারের ভূমিকা নিয়ে বিভিন্ন সমালোচনামূলক কার্টুন-পোস্টার পোস্ট করতেন। আর মুশতাক তার ফেইসবুক অ্যাকাউন্টে কিশোরের সেসব পোস্টের কয়েকটি শেয়ার করেন।

র‌্যাব-৩ এর ডিএডি আবু বকর সিদ্দিকের করা এই মামলায় রাষ্ট্রচিন্তার সংগঠন দিদারুল ভূইয়া এবং ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাবেক পরিচালক মিনহাজ মান্নানকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তবে পরে এ দুজন জামিনে মুক্তি পান।

মুশতাক ও কিশোরের পক্ষে এর আগে বেশ কয়েকবার জামিনের আবেদন হলেও তা আদালতে নামঞ্জুর হয়।

এই মামলায় আসামির তালিকায় মুশতাক, কিশোর, দিদার, মিনহাজের সঙ্গে আরও ছিলেন নেত্র নিউজের সম্পাদক সুইডেন প্রবাসী তাসনিম খলিল, জার্মানিতে থাকা ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিন, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সাংবাদিক শাহেদ আলম, হাঙ্গেরি প্রবাসী জুলকারনাইন সায়ের খান (আল জাজিরার প্রতিবেদনের স্যামি), আশিক ইমরান, স্বপন ওয়াহিদ ও ফিলিপ শুমাখার।

তবে তদন্তের পর শুধু মুশতাক, কিশোর ও দিদারকে আসামি করে গত জানুয়ারিতে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় রমনা থানা পুলিশ। বাকি আট আসামিকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন করেন তদন্ত কর্মকর্তা।

এরপর রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনে গত ১০ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক আসসামছ জগলুল হোসেন এ মামলায় অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন।

সেই দায়িত্ব পাওয়ার পর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) উপপরিদর্শক ও মামলার নতুন তদন্ত কর্মকর্তা মো. আফছর আহমেদ গত ২৩ ফেব্রুয়ারি কিশোর ও লেখক মুশতাক আহমেদের তিন দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেছিলেন।

সে বিষয়ে শুনানি করে ঢাকার একজন মহানগর হাকিম রোববার কিশেরকে রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন নাকচ করে দেন। আর এ শুনানির আগেই ২৫ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে বন্দি অবস্থায় মুশতাকের মৃত্যু হয়।

মুশতাকের মৃত্যুতে প্রতিবাদ হচ্ছে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবি নতুন করে জোরালো হয়ে উঠেছে। কারাগারে বন্দি অবস্থায় মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর ঘটনাকে ‘মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন’ হিসেবে বর্ণনা করেছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন।