রোববার
এ উপলক্ষে আয়োজিত বিএনপির অনুষ্ঠানে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অভিযোগ
করেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তরুণ প্রজন্মকে ‘ভ্রান্ত’ ইতিহাস জানাচ্ছে।
জনগণের
ভোটে নির্বাচিত বঙ্গবন্ধুকে ক্ষমতা দিতে পশ্চিম পাকিস্তানিরা যখন ষড়যন্ত্র শুরু করেছিল,
তখন ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ আসে বঙ্গবন্ধুর বজ্রঘোষণা – ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির
সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’।
রেসকোর্স
ময়দানে লাখো জনতার সমাবেশে সেই ভাষণের পর থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান কার্যত বঙ্গবন্ধুর
নির্দেশেই পরিচালিত হতে থাকে। এরপর সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়।
এবার
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনে বিএনপি বিভিন্ন দিন ধরে নানা কর্মসূচি পালন করেছেন।
জাতির পিতার ঐতিহাসিক ভাষণ দেওয়ার দিনও পালন করছে দলটি। বিএনপির এই কর্মসূচিকে ‘ভণ্ডামি’ বলে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
বিএনপির
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন জাতীয় কমিটির উদ্যোগে রোববার জাতীয় প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে
আয়োজিত আলোচনা সভার ব্যানারে লেখা ছিল- ‘৭ মার্চ উপলক্ষে আলোচনা সভা’।
ব্যানারের
একদিকে ছিল ওই সময়ে উত্তোলিত মানচিত্র সম্বলিত লাল-সবুজ পতাকা এবং অন্যদিকে ছিল জিয়াউর
রহমান, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের ছবি।
দিনটি
পালনের ব্যাখ্যায় আলোচনার সভার সভাপতি এবং বিএনপির জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক খন্দকার মোশাররফ
হোসেন বলেন, তারা জনগণের কাছে ‘প্রকৃত ইতিহাস’ তুলে ধরার জন্য এই আলোচনা অনুষ্ঠান আয়োজন
করেছেন।
“আমরা
সুবর্ণজয়ন্তীর একটি দিন হিসেবে ৭ মার্চ পালন করছি। আমরা প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরতে এই
দিনটি পালন করছি।”
খন্দকার
মোশাররফ একাত্তরের অগ্নিঝরা ১ মার্চ, ২ মার্চ, ৩ মার্চ পালনের কথাও বলেন।
৭ মার্চ
নিয়ে তিনি বলেন, “এই দিন মানুষ আশা করেছিল স্বাধীনতার ঘোষণা আসবে। আমি তখন উচ্চ শিক্ষার্থে
বিদেশে ছিলাম। লন্ডনে থেকে আমরা ছাত্ররা বাংলাদেশের সংগ্রামী ছাত্র সমাজ নাম দিয়ে একটি
সংগঠন করেছিলাম, যার আহ্বায়ক ছিলাম আমি। আমরাও মনে করেছি ৭ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা
হবে। তখন আমরা লন্ডনে আওয়ামী লীগ, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন… যৌথভাবে
সমাবেশ ডেকেছিলাম। স্বাধীনতার ঘোষণার জন্য বাংলাদেশের ছাত্র সমাজ দেশ-বিদেশে যে প্রত্যাশা
করেছিল, সেই প্রত্যাশা পূরণ হয় নাই।”
খন্দকার
মোশাররফ বলেন, “এটা আমরা অস্বীকার করতে চাই না, ওই বক্তব্যের পেছনে সেই সময়ের অবিসংবাদিত
নেতা জনাব শেখ মুজিবুর রহমান। এটাও আমরা অস্বীকার করি না। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান তিনি যতবার জাতির উদ্দেশে আনুষ্ঠানিক এবং জাতীয় সংসদে বক্তব্য
রেখেছেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য, মুক্তিযুদ্ধের জন্য অবদান রেখেছেন, তাদের সকলকে
স্মরণ করতে গিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের নামও স্মরণ করেছেন। তেমনিভাবে আমাদের নেত্রী বেগম
খালেদা জিয়া যতবার সংসদে বক্তব্য রেখেছেন এবং তিনি জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছেন, তিনিও
স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের অবদান রেখেছেন তাদেরকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন, সেখানে শেখ
মুজিবুর রহমানের নাম ছিল।”
“আমরা
ইতিহাসকে অবজ্ঞা করতে চাই না, আমরা ইতিহাসকে মুছে দিতে চাই না। ৭ মার্চ জনাব শেখ মুজিবুর
রহমান বলেছেন, জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। আমি মনে করি, এই
যে তার বক্তব্য, এটা সঠিক। ওই সময়ে সেটাই তার বক্তব্য রাখা উচিৎ ছিলে, সেটাই উনি রেখেছেন,”
বলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য।
৭ মার্চের ভাষণ জিয়ার কাছে ছিল ‘গ্রিন সিগন্যাল’
বিএনপির
স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস সভায় বলেন, “৭ মার্চ পালনের কথা শুনে আওয়ামী লীগের
গাত্রদাহ হয়েছে। ৫০ বছরের ইতিহাসে ছোট একটা অংশ এই ৭ মার্চ।
“৭
মার্চের ভাষণটা যখন হয়, আমি আমার এলাকা লোকজনকে সঙ্গে নিয়ে মঞ্চের বাঁ দিকে বাঁশের
ব্যারিকেডের সামনে উপস্থিত ছিলাম। ৭ মার্চ আমরা কী আশা করেছিলাম? একটা ঘোষণা আসবে।
কিন্তু না, কোনো ঘোষণা আসেনি। যদি কেউ বলেন, কোনো এক মেজরের ঘোষণায় এদেশ স্বাধীন হয়
নাই; আমরাও বলতে পারি, ৭ মার্চের কারণে দেশ স্বাধীন হয় নাই।”
বিএনপির
স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, “৭ মার্চ যারা রেসকোর্সে ময়দানে
উপস্থিত ছিল, তাদের মধ্যে আমি একজন। ৭ মার্চে উনি ভাষণ দিলেন। কিন্তু সেই ভাষণে স্বাধীনতার
ঘোষণা আসল না।
“তারপরের
দিন আওয়ামী লীগ থেকে একটা প্রেসনোট দেওয়া হলো। সেই প্রেসনোটে তাজউদ্দীন আহমদ সাহেব
স্বাক্ষর করলেন এবং সেখানে বলা হল যে, বাঙালির অধিকার আদায় করার জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ
দল ক্ষমতায় আসার জন্য এই ভাষণ দেওয়া হয়েছে। তাহলে সেটা স্বাধীনতার ঘোষণা না। সেটা আওয়ামী
লীগের প্রেসনোটে পাওয়া গেল। আমরা বলতে চাই, স্বাধীনতা ঘোষণা ও ৭ মার্চের ভাষণ এক জিনিস
না।”
বিএনপির
সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব আবদুস সালামের পরিচালনায় আলোচনা সভায়
দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও সেলিমা রহমানও বক্তব্য রাখেন।
বিএনপি
মহাসচিব ফখরুল বলেন, “আওয়ামী লীগ অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে এই নতুন প্রজন্মকে সেই ইতিহাস
থেকে বঞ্চিত করে তাদেরকে ভ্রান্ত ইতিহাস দিচ্ছে। একটা ধারণা দিচ্ছে যে, একটি মাত্র
দল, একজনই মাত্র ব্যক্তি আর একটি গোষ্ঠি যারা এদেশের সব কিছু এনে দিয়েছে। মিথ্যা ইতিহাস
দিয়ে তারা প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করছে।”
বিএনপি
‘সত্যটা’ তুলে ধরতে চায় দাবি করে তিনি বলেন, “একটা কথা দেখবেন, তাদের বক্তব্যের কোথাও..
এই তোফায়েল আহমেদের কথা খুঁজে পাবেন না। তারা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মওলানা
আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নাম একবারও উচ্চারণ করে না। এমনকি যুদ্ধের যে সর্বাধিনায়ক
এমএজি ওসমানী ছিলেন, তার নাম একবারও উচ্চারণ করে না। এমনকি যুদ্ধকালীন সময়ে প্রবাসী
সরকার যিনি নেতৃত্ব দিলেন, তাজউদ্দীন আহমদ, তার নাম একবারও উচ্চারণ করে না। এত সংকীর্ণ
এরা!”
‘সংগ্রাম
ও যুদ্ধ এক বিষয় নয়’ উল্লেখ করে ক্ষমতাসীনরা একে এক করে গুলিয়ে ফেলেছে বলে মন্তব্য
করেন ফখরুল।
“যুদ্ধ
হচ্ছে অস্ত্র হাতে সশস্ত্রভাবে আপনি একজন প্রত্যক্ষ শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে শুরু
করেন। আর সংগ্রাম একজন মানুষ ও জাতি করে। যুদ্ধ ও সংগ্রাম এটা আমাদের দীর্ঘদিনের। যারা
গবেষণা করছেন, তাদের গবেষণায় উঠে এসেছে যে, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের যে ঘোষণা,
সেই ঘোষণাই সমগ্র জাতিকে উদ্দীপ্ত করেছে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য।”
আওয়ামী
লীগ অন্য সবার অবদান অস্বীকার করতে চায় দাবি করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, “এখনও তারা একই
কাজ হয়েছে। এখন কিছুর দায়ভার পড়ে শেখ হাসিনার ওপরে।”
বিএনপি
মহাসচিব ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সমালোচনা করে বলেন, ভিন্নমত দমনের জন্য আওয়ামী লীগ
আইনটি করেছে।
“কেন
আজকে লেখক মুশতাক আহমেদকে জেলের মধ্যে মারা যেতে হয় বিনা চিকিৎসায়? কিশোর কী অপরাধ
করেছিল? একটা কার্টুন এঁকেছিল। সেই কার্টুন হচ্ছে একজন ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে একটা কার্টুন।
তাহলে কি আমরা ধরে নেব ওই ব্যবসায়ীর সকল কুকর্মের সাথে আপনাদের সংযোগ আছে। তাহলে কেনো
বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরা এভাবে মানুষকে তুলে নিয়ে নির্যাতন করছে।”
তিনি
সরকারের উদ্দেশে বলেন, “ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট কেন তৈরি করছেন? এখন বড় গলায় বলছেন
এটা বাতিল হবে না, এটা প্রয়োজনে দেওয়া রয়েছে। কার প্রয়োজনে দিয়েছেন? আপনার নিজের প্রয়োজনে
এই আইন করেছেন, আপনার দলকে রক্ষা করবার প্রয়োজনে দিয়েছেন।”