ক্যাটাগরি

অনিঃশেষ অন্ধকার

কিন্তু অন্য দুই ভাই-বোনের মধ্যে মিলুর আচরণ অন্যরকম। সে ছিল তৃতীয় লিঙ্গের। ছোটবেলায় ছেলের মতো থাকলেও মেয়েদের মতো চলাচল করতে পছন্দ করত। বয়স যখন ৯-১০ তখনই মিলুর মা-বাবা ভাই-বোন সবাই জানে সে তৃতীয় লিঙ্গের। এজন্য যত বড় হতে থাকে তার আদরও তত কমতে থাকে। এভাবে সে সমাজে হয়ে ওঠে একজন রূপান্তরিত নারী।

বাসার বাইরে গেলে লোকে বলতো, রূপান্তরিত নারী আইছে। তার পরনের পোশাক ধরে টান দিত। আস্তে আস্তে মিলু বড় হয়ে ওঠে, আর সঙ্গে বয়ঃসন্ধিকাল পরিবর্তনের ফলে তার মধ্যে মেয়েদের হরমোন, মেয়েদের চরিত্র ফুঠে উঠতে থাকে। সে নিজেও নিজেকে নারী ভাবতে শুরু করে। বাজার থেকে নারীদের পোশাক কিনে আনে, ঠোঁটে লিপস্টিক দেয়।

বাবা তাকে দুচোখে দেখতে পারে না। বলে, তুই আমার মান সম্মান নষ্ট করেছিস, রূপান্তরিত নারীর মুখ দেখলেও অমঙ্গল হয়। এই বলে সারাদিন গালাগালি করে।

ভাই-বোন সবাই অবহেলার চোখে দেখলেও মা মিলুকে খুব ভালোবাসে। সবাই গালাগালি দিলেও মিলু কাউকে কিছু বলতে পারে না, বলে না।

এভাবে মিলুর বয়স যখন ১১ বছর পাশের গ্রামের রূপান্তরিত নারীপল্লীর সদস্যরা জানতে পারে মিলু একজন রূপান্তরিত নারী। আর রূপান্তরিত নারীরা কোন রূপান্তরিত নারী শিশু জন্মগ্রহণ করলে তাকে নিয়ে যায়। মিলু কথাটা জানতে পারে। তারপর থেকে মিলুর খুব ভয় হয়। একদিন রাতে তারা মিলুকে নিতে এসেছিল। মিলুর বাবা সেদিন বাসায় ছিল না।

রাতে মিলুকে নিতে এলে মিলুর মা মিলুকে বুকে জড়িয়ে ধরে রাখে। তাকে দিতে চায় না। রূপান্তরিত নারীর দল সেদিন চলে যায়। মায়ের কোলে মাথা রেখে মিলু প্রশ্ন করে- মা, ওরা আমাকে কেন নিয়ে যেতে চায়? মা সান্ত্বনা দিয়ে বলে- ওরা মজা করছিল তোমাকে নিয়ে।

মিলুকে একথা বলে মা কান্না করতে থাকে।

মিলুর ভাই তিলু। সে এবার বিএ পাশ করেছে। চাকরি হয়েছে। তার জন্য মেয়ে দেখা হচ্ছে বিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু পাত্রীর বাসা থেকে একটাই সমস্যার কথা বলে যে, ওর ভাই রূপান্তরিত নারী বলে তিলুও রূপান্তরিত নারী হতে পারে। অনেক মেয়ে দেখলেও সবার একটাই কথা। অনেক খোঁজাখুঁজির পর বিয়ের পাত্রী খুঁজে পাওয়া গেল। বিয়ে হলো।

হঠাৎ রাতে মিলু্কে নেওয়ার জন্য রূপান্তরিত নারীরা আসে। সেদিন মিলুকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায়। ওদের সঙ্গে না যাওয়ার জন্য মিলু মায়ের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। মা-ও হাত বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু মিলুর বাবা, ভাই-বোন মাকে আটকে রাখে।

মা ভাত খায় না, কান্নাকাটি করে। মিলু কেমন আছে এ চিন্তায় কেটে গেল পাঁচটি বছর। মা মিলুর কোন খোঁজখবর পায় না। মিলুর বাবা জানত মিলু কোথায় থাকে, কিন্তু মিলুর মা যাতে যেতে না পারে এজন্য ঠিকানা গোপন রাখে।

এদিকে মিলুও বাসার ঠিকানা ভুলে গেছে। আর মিলুর মেজবোন নিলু এবার ইন্টার পাশ করেছে। তাকেও বিয়ে দেবে, এজন্য পাত্র দেখা হচ্ছে। কিন্তু তার পরিবারে রূপান্তরিত নারী আছে বলে কোন পাত্রই রাজি হয় না। এদিকে মিলুর বাসায় যাওয়ার জন্য খুব মন কাঁদে। কিন্তু বাসার ঠিকানাটা হারিয়ে যাওয়ায় সে আর বাসা খুঁজে পায় না।

এভাবে কেটে যায় দশটি বছর। মিলুর মন কাঁদে মাকে দেখার জন্য। বাসার ঠিকানা খুঁজতে থাকে সে। খুঁজতে কেটে যায় আরও ছয় মাস। অবশেষে সে বাসার ঠিকানা পায়। কিন্তু তখন ছিল সকাল। সকালে ঢুকলে মানুষ দেখে ফেলবে, হয়তো তাকে মারতেও পারে, মিলু ভাবতে থাকে।

এদিকে তার পরিচয় হয় এক নিঃসন্তান মায়ের সঙ্গে, তিনি রাস্তায় ভিক্ষা করেন। তিনি মিলুকে খুব আদর স্নেহ করে ভালোবেসে ভাত খাইয়ে দেন, কিন্তু নিজ মায়ের যে ভালোবাসা সেটি আসলে কখনও পূরণ হয় না। হঠাৎ একদিন রাতে সে তার নিজ বাসার সামনে যায়। তখন রাত দুটা, দারোয়ান ঘুম। মিলু তার চোখ ফাঁকি দিয়ে চলে যায় দোতলায়, তার বাসায়। কলিংবেল টিপলে সঙ্গে সঙ্গে তার বড় ভাই এসে দরজা খোলে এবং খুলেই গালাগালি করতে থাকে। তুই কেন আমার বাসায় আসিস? আমার সম্মানহানি হয়। তোর জন্য আমার বিয়ে হতে অনেক কষ্ট হয়েছে।

এসব কথা বলে মিলুকে খুব মারধর করতে শুরু করে। মিলু মা মা বলে ডাকতে থাকে।

কিন্তু শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে এলেও বাবা ও বড় ভাইয়ের বাধার কারণে মিলুর কাছে আসা হয় না মায়ের। মিলুর বাবাও বলে, তুই আমার বাসায় এসেছিস কেন? আমার মান-সম্মান সব যাবে। তুই রূপান্তরিত নারী। বাসা থেকে বের হ। মিলু তার মায়ের কাছে আসতে চায়। কিন্তু তার আর আসা হয় না। মিলুর ভাই পা থেকে জুতো খুলে খুব মারধর করে।

মিলু মা মা বলে চিৎকার করতে লাগল। এক পর্যায়ে তিলু চলে যায় এবং দারোয়ানকে হুমকি দিয়ে যায়, এই সমস্ত বাজে লোকজন কীভাবে বাড়িতে ঢোকে? তোর চাকরি যাবে, বলে সে চলে যায়। মিলু অনেক সময় কান্নাকাটি করে চলে যায় তার সেই নিঃসন্তান মায়ের কাছে। বলে- মা, কী যে ক্ষুধা লেগেছে, আমাকে কটা ভাত দাও মা।

নিজ হাতে ওই মা তাকে ভাত খাইয়ে দেয়।

এভাবে কেটে গেছে অনেক বছর। কিন্তু মায়ের ভালোবাসা পাওয়া, চুমু দেওয়া, মিলুর কাছে অধরাই রয়ে যায়। সে যে রূপান্তরিত নারীদের কাছে থাকে তারা তাকে দিয়ে বিভিন্ন সময় চাঁদা, বিভিন্নজনের কাছ থেকে টাকা আনা এসব কাজ করায়। মন থেকে তার এসব কাজ খুব খারাপ লাগে। তার খারাপ লাগে রূপান্তরিত নারী বলে তাকে কেউ চাকরি দেয় না। তাকে কেউ কর্মচারী হিসেবে রাখে না।

তাহলে কী করবে মিলু? এজন্য বাধ্য হয়ে পেটের টানে এসমস্ত কাজ করে। হঠাৎ একদিন মিলুর মা মারা যায়। মায়ের লাশ দেখতে গেলে তাকে দেখতে দিতে চায় না, শুধু সে রূপান্তরিত নারী বলে। অনেক কষ্ট করে লাশ দেখলেও সেদিন মিলুকে নির্যাতনের শিকার হতে হয়। সে মাকে শেষবার একটু স্পর্শ করার চেষ্টা করে। মাকে যখন মাটি দিতে নিয়ে যাচ্ছিল ওখানেও ভাই এবং বাবা লাঠি নিয়ে মিলুকে ধাওয়া করে যাতে সে এই লাইনে এবং জানাজায় অংশগ্রহণ করতে না পারে।

শেষে মাকে যখন কবরে নামানো হয় তখনও মিলুকে একটু মাটি দিতে দেওয়া হয়নি। কারণ তার বাবা, ভাই ও এলাকাবাসীর ধারণা যে রূপান্তরিত নারী কবরে মাটি দিলে অমঙ্গল হবে। রূপান্তরিত নারী হয়ে জন্মানোয় নিজেকে সে অভিশপ্ত মনে করে। মায়ের কবরে মাটি দিতে না পেরে মিলু এলাকা ছেড়ে সঙ্গের রূপান্তরিত নারীদের ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়।

লেখক পরিচিতি: শিক্ষার্থী, দ্বাদশ শ্রেণি, বাগেরহাট সরকারি পি.সি কলেজ

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!