পাঁচ বছর চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন শেষে সোমবার দুদকের প্রধান কার্যালয়ে
গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে এক প্রশ্নের জবাবে তার এ মন্তব্য আসে।
ইকবাল মাহমুদ বলেন, “দুদকের নখ-দাঁত নেই- সেটি অনেক পুরাতন ও প্রাচীন কথা।
এটি এখন আর নেই। দুদক যথেষ্ট ক্ষমতাশালী প্রতিষ্ঠান। যথেষ্ট ক্ষমতা রয়েছে দুদকের। আইনি
ম্যান্ডেট রয়েছে এবং আমি মনে করি যতটুকু আইন আছে, এই আইন দিয়ে অনেক কিছু করা যায়।”
এরপরও এই কমিশনের পক্ষ অনেক কাজ করা ‘সম্ভব হয়নি’ জানিয়ে তিনি বলেন, “কিন্তু
আপনারা বিশ্বাস করবেন যে আমরা চেষ্টা করেছি। এই চেষ্টার যদি কোনো ত্রুটি থাকে, সেই
ত্রুটি আমার।”
ইকবাল মাহমুদ বলেন, সব দুর্নীতি দুদকের আওতায় পড়ে না। তারপরও যে কোনো দুর্নীতির
কথা এলেই দুদকের কথা এসেছে। তাতে তাদের ‘বিব্রত’ হতে হয়েছে।
“আসলে সকল দুর্নীতি কমিশনের আওতায় নই। এটি আমরা হয়ত বোঝাতে পারিনি। এক
কমিশনের পক্ষে অনেক কিছু করা সম্ভব হয় না। পরবর্তী কমিশন এটাকে আরও বেগবান করবে।”
২০১৬ সালের ১০ মার্চ দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন ইকবাল
মাহমুদ। তার সময়েই দুদকের ভুলে পাটকল শ্রমিক জাহালমের জেল খাটার ঘটনা বড় ধরনের সমালোচনার
জন্ম দেয়।
এছাড়া ডিআইজি মিজানুর রহমানের কাছ থেকে দুদক পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছিরের
‘ঘুষ নেওয়ার’ ঘটনাও ছিল একটি আলোচিত ঘটনা।
‘তদবির-চাপহীন
’
গত পাঁচ বছর দায়িত্ব পালনকালে কেউ কোনো তদবির করেনি বা সরকার থেকে কোনো
‘চাপ প্রয়োগ করা হয়নি; বলে বিদায় বেলায় দাবি করেন ইকবাল মাহমুদ।
তিনি বলেন, “কোনো মন্ত্রী বা এমপি কখনও চাপ প্রয়োগ করেননি। শুধু একদিন
একজন মন্ত্রী আমার কাছে এসেছিলেন তিনি আমার বন্ধু হন। তিনি এসেছিলেন এক কাপ চা খেতে,
কোনো তদবির করতে আসেননি। আর কোনো মন্ত্রী মহোদয় আমার কাছে আসেননি। কোনো মন্ত্রী মহোদয়
আমার কাছে ফোন দিয়ে এমন কিছু বলেননি। আমরা দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে পারি, আমার ওপর কোনো
চাপ ছিল না। সরকারের পক্ষ থেকে আমার ওপর কোনো চাপ ছিল না।”
তবে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি রক্ষায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে ‘আত্মচাপ’ নিয়েছেন
বলে মন্তব্য করেন দুদক চেয়ারম্যান।
“একটি বিষয় স্বীকার করতে হয়, যখন আমার মনে হয়েছে যে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি
ক্ষুণ্ন হতে পারে, সেই ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে আমি সরে এসেছি। রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি
সব সময় আমার কাছে প্রথম ছিল। সেই ক্ষেত্রে আমার নিজের ওপর নিজের চাপ ছিল।”
বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি
‘পুরনো প্রশ্ন’
বেসিক ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় আগের কমিশনের সময় করা ৫৬টি মামলা
তদন্ত কাজ শেষ না হওয়ার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, “এটি একটি
পুরনো প্রশ্ন। এই প্রশ্ন আপনারা সব সময় করে থাকেন, এর উত্তরও আমি দিয়েছি। আমার মনে
হয় একই উত্তর হবে। এটি চর্বিতচর্বণ। বেসিক ব্যাংক ইস্যুতে ৬৫টি মামলা হয়েছে, আমার জানামতে
আরও মামলা হবে।
“সমস্যা হচ্ছে যে চার্জশিট হচ্ছে না কেন? তবে চার্জশিট কিংবা মামলা হবে
কিনা আমি বলতে পারি না, আপনিও বলতে পারেন না। প্রশ্নটা হবে রিপোর্ট হচ্ছে না কেন? সেই
রিপোর্ট একবার কমিশনে জমা হয়েছিল। আমরা রিপোর্ট গ্রহণ করতে পারিনি।”
কমিশনে কয়েকজন তদন্ত কর্মকর্তার দাখিল করা সেই তদন্ত প্রতিবেদন গ্রহণ না
করার কারণ জানিয়ে ইকবাল মাহমুদ বলেন, “এর প্রধান কারণ ছিল- রিপোর্টে যাদের বিরুদ্ধে
অভিযোগ ছিল, তাদের নাম থাকলেও অর্থ কীভাবে আত্মসাৎ হয়েছে এবং সেই অর্থ কোথায় গেল তার
উল্লেখ ছিল না। আমরা এ বিষয়টি এখনও ফলো করছি।”
ক্ষমতা থাকলেও দুদক একেবারে ‘স্বাধীন নয়’ এবং আদালতের কাছে সব কিছুর জবাবদিহি
করতে হয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, “প্রত্যকটি রিপোর্ট সেখানে বিচার-বিশ্লেষণ করে। আমাদের
কাজ হল আদালতে প্রমাণ করা। আদালতে যদি প্রমাণই করতে না পারি, সেই রিপোর্টের দায়িত্ব
কতটুকু, আমি জানি না।”
বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির কয়েকটি মামলায় পাওয়া তদন্ত প্রতিবেদন কিছু পর্যবক্ষণ
দিয়ে ফেরত পাঠানো হয়েছে জানিয়ে বিদায়ী চেয়ারম্যান বলেন, “অর্থ কোথায় গেল? তারা (তদন্ত
কর্মকর্তা) অনেক লোকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। আরও জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে কিনা জানি না।”
আর দুদকে চেয়ারম্যানই যে ‘সবকিছু না’, সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন,
“কমিশন মানে আরও দুইজন কমিশনার আছেন। আপনাদের জানা দরকার, কোনো মামলা যখন তদন্ত হয়,
আপনি আইও’র (তদন্ত কর্মকর্তা) সাথে খবরদারি করতে পারবেন না। আইও যখন রিপোর্ট দেবে,
আমরা তার ওপরে পর্যবেক্ষণ করি। আইও যদি নির্দিষ্ট সময়ে রিপোর্ট দিতে না পারে তাহলে
আমরা শোকজ করি। সময় মত রিপোর্ট দিতে বলি।”
জন আকাঙ্ক্ষা ‘সেভাবে’
পূরণ হয়নি
দুর্নীতি দমন কমিশনের কাছে জনগণের যে আকাঙ্ক্ষা রয়েছে, তা সেবাবে পূরণ
হয়নি বলে স্বীকার করেছেন ইকবাল মাহমুদ।
তিনি বলেন, “জন আকাঙ্ক্ষা যে রকম, সেই মাত্রা অনুযায়ী আমরা পারিনি। কিন্তু
জন আকাঙ্ক্ষার মত আপনি তখনই পারতেন, যখন আপনি-আমি, সমাজের সর্বস্তরের মানুষ সবাই একই
প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে একটি কথা উচ্চারণ করতেন একাত্তর সালের মত যে, ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে
আমরা একতাবদ্ধ’। তাহালে আপনি জন আকাঙ্ক্ষার মত পারতেন।
“বুঝতে হবে, যদি আমরা জন আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করতে পারতাম, তাহলে এই কমিশনের
আর প্রয়োজন ছিল না। এটা কখনোই কোনো দেশে সম্ভব হয় না। জন আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী পারা যায়
না। মানুষের আকাঙ্ক্ষার কোনো শেষ নেই। জন আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য পরের কমিশন, তার পরের
কমিশন, এর পরের কমিশন… এরপর একটা অবস্থায় যাবে।”
গণমাধ্যম কর্মীদের কমিশনের গঠনমূলক সমালোচনা করতে আহ্বান জানিয়ে ইকবাল
মাহমুদ বলেন, “এই সমালোচনা আমি চলে যাওয়ার পরেও করবেন, কোনো অসুবিধা নেই। প্রতিষ্ঠানের
দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আপনাদের যা করার করবেন। তারপর ব্যক্তিগতভাবে যদি কিছু করে থাকি,
সেটারও সমালোচনা করবেন। এটা আমরা নিতে রাজি আছি।”
দুদক কর্মীদের সম্পদের
হিসাবের জন্য ‘দরকার আইন’
দুদকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব প্রকাশ করা যায় কিনা- এমন
প্রশ্নে ইকবাল মাহমুদ বলেন, “এটা এক প্রতিষ্ঠান থেকে যদি শুরু করেন… আপনাকে কেবিনেট
ডিভিশন, আর মন্ত্রণালয় না হয়ে যদি শুরু করেন তাহলে…. এটা দিয়ে আপনি
কী করবেন? আপনি সম্পদের বিবরণ দিলেন, তারপর কী করবেন? ১২ লক্ষ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী
তাদের… এই হিসাব নেওয়ার পর আপনি কী করবেন?”
তাছাড়া সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব নেওয়ার জন্য নতুন আইনের
দরকার জানিয়ে বিদায়ী চেয়ারম্যান বলেন, “আইনি কাঠামো না হলে তা কীভাবে সংরক্ষণ করা হবে,
এই পরিমাণ সম্পদ পাওয়া গেলে কী করা হবে? এটা নিয়ে আমরা চিন্তা করেছি। ইন্ডিয়াতেও তা
করতে পারেনি সেভাবে। সার্বিক বিষয় বিবেচনা না করে একা কিছু করতে পারবে না।”