ক্যাটাগরি

বন্ধুমহলে ‘পিরিয়ড’ বেলার একাল-সেকাল

বিজ্ঞাপন, গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে এ প্রসঙ্গে কথা বলার সুযোগ তৈরি হওয়ায় পিরিয়ড নিয়ে ‘সংকোচ’ কমছে বলে মনে করছেন কেউ কেউ।

পিরিয়ডের সময় বন্ধুদের আড্ডায় কতটুকু স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন তা নিয়ে নানা বয়সী ও পেশার কয়েকজন অকপটেই কথা বলেছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে সঙ্গে। 

পঞ্চাশ পেরোনো স্কুল শিক্ষিকা মারিয়া গমেজ জানিয়েছেন, নিজের প্রথম মাসিক হওয়ার সময় এই স্বাভাবিক শারীরিক প্রক্রিয়াটির কথা কতটা গোপন রাখতে হত।

“আমাদের সময়ে বন্ধু মহলে তো দূরের কথা ঘরের অন্য কেউ যদি টের পেত যে পিরিয়ড হয়েছে, সেটা আমাদের  জন্য ছিল ভীষণ লজ্জার।”

‘ওই যুগে’ পিরিয়ড নিয়ে ছিল অনেক কুসংস্কারও।

“পিরিয়ড হলে সন্ধ্যায় বাইরে যাওয়া যাবে না, চুল খুলে রাখা ঠিক না, এর জন্য ব্যবহৃত কাপড় কারও নজরে এলে অসুখ হয়; এমন আরও অনেক কিছু,” বলেন তিনি।

পিরিয়ড নিয়ে কোনো সমস্যা হলে কারও সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলার মত পরিবেশও ছিল না।

আগের সেই দিনগুলো মনে করে হলিক্রস ‘বিকালের লেখাপড়া’ কার্যক্রমের এই শিক্ষিকা বলেন, “তখন এ নিয়ে আলোচনা করাকেও একটা দুঃসাহসিক কাজ বলে মনে হত। আমার নিজেরও অনেক কিছু অজানা ছিল। ছিল অনেক ভ্রান্ত ধারণা। আমি নিজেও অনেক লুকোচুরি করেছি, লজ্জা পেয়েছি। বড় হওয়ার পরে কাজের সুবাদে নারী সহকর্মীদের মাধ্যমে অনেক কিছু জানতে পেরেছি কিন্তু তখন কোনো পুরুষের সঙ্গে এই ধরনের বিষয় নিয়ে কথা বলব তা ভাবতেও পারতাম না।”

তবে এখনকার ছেলেমেয়েরা এ নিয়ে অনেক সচেতন বলে মনে করছেন মারিয়া গমেজ।

“এরা নির্দ্বিধায় বাবা, ভাই, বন্ধুদের সঙ্গেও পিরিয়ড বা শারীরিক নানা সমস্যা নিয়ে কথা বলতে পারে।” 

এজন্য মিডিয়ার ভূমিকাকে সাধুবাদ দিতে চান এই নারী।

তিনি বলেন, “মিডিয়ার প্রচারের কারণেই মূলত আমাদের মত অনেকে কুসংস্কার থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছে। মেয়েদের পাশাপাশি ছেলেরাও বিষয়টাকে স্বাভাবিকভাবে দেখছে। এতে করে গোপনীয়তা ও অহেতুক লজ্জা পাওয়ার বিষয়টাও কমে এসেছে।”

ভাঙছে ‘চুপ’ থাকার সংস্কৃতি

মাসিক নিয়ে সামাজিক ও পারিবারিক ট্যাবু প্রসঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতার কথা বললেন নাহিদ দিপা।

“আমরা সারা জীবন টিটকিরি শুনে এসেছি। যখন ছোট ছিলাম… স্কুল থেকে ফিরছি, কোমরে স্কার্ফ জড়িয়ে রেখেছি। অনেক সময় ছেলেরা বলত, গলারটা কোমরে বাঁধা কেন? এখন শহরে হয়ত এমন হয় না, কিন্তু গ্রামাঞ্চলে হয় এবং খুব খারাপভাবে হয়।”

উন্নয়নকর্মী নাহিদ দিপা বলেন, “আমি আমার মায়ের সাথে ছোটবেলায় এটা নিয়ে আলোচনা করতে কমফোরটেবল ছিলাম না… আমাদের কালচারটাই এমন ছিল।”

প্রজন্ম বদলে শহরে এই চিত্রে কিছু বদল দেখছেন জানিয়ে নাহিদ দিপা বলেন, “আজকাল বাচ্চারা কিন্তু মায়েদের সঙ্গে, এমনকি বাবাদের সঙ্গেও এটা নিয়ে কথা বলে। আমার এক আত্মীয় ফোন করে জানাল, মেয়ের তো পিরিয়ড হয়েছে, সে তার বাবাকে বলেছে, বাবা তুমি এখনি আমাকে প্যাড এনে দাও। এটা জেনে আমার মনে হয়েছে পরিবর্তন কিছুটা হলেও হয়েছে।”

এখনকার প্রজন্মের মাঝে পিরিয়ডের দিনগুলো নিয়ে লুকোচুরি নেই বলে জানালেন ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটির এলএলবি চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ভিক্টোরিয়া সরদারও।

“আমি গার্লস স্কুল ও কলেজে পড়াশুনা করেছি। ইউনিভার্সিটিতে এসে ছেলেমেয়ে এক সঙ্গে ক্লাস করি। পিরিয়ডের বিষয়টা নিয়ে শুরুতে বেশ সংকোচ কাজ করত। কিন্তু যখন দেখেছি বন্ধুরা অনেক মিশুক ও চিন্তাভাবনায় খোলামেলা, তখন থেকে আমিও নির্দ্বিধায় সব কিছুই খোলামেলাভাবে বলা শুরু করেছি।”

নিজে এই ইতিবাচক পরিবেশ পেয়ে এখন ঢাকার বাইরে পড়তে আসা এ বিষয়ে উৎসাহ দেওয়া শুরু করেছেন ভিক্টোরিয়া।

মাসিক নিয়ে ভাঙছে ‘চুপ’ থাকার সংস্কৃতি

 

উপযুক্ত জ্ঞান না থাকায় মানুষ পিরিয়ড নিয়ে অকারণে সংকোচবোধ করে বলেই মনে করেন এই শিক্ষার্থী।

ভিক্টোরিয়া বলেন, “ছোট বেলায় আমার সমবয়সী ছেলেরাই এই বিষয়টা নিয়ে মজা করত বা মুচকি মুচকি হাসত। কিন্তু এরাই এখন আমাদের সাপোর্ট দিচ্ছে। কোনো সমস্যা হলে এগিয়ে আসছে, আমরাও খোলামেলা কথা বলতে পারছি।”

মেয়েদের পিরিয়ড নিয়ে অকপট কথা বলাকে স্বাভাবিক ভাবেই দেখতে চান ছেলেরাও।

সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটির বিএসসি ইন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী  সালাউদ্দিন ইবনে সাইফ বলেন, “পিরিয়ড নিয়ে এত লুকোচুরির কিছু আছে বলে আমি মনে করি না।”

তবে মেয়েদের যে বয়সে মাসিক শুরু হয়, ওই বয়সে ছেলেদের এই নিয়ে সঠিক ধারণা না থাকার কথা তুলে ধরলেন তিনি।

“কৈশোরে মেয়েদের পিরিয়ড হওয়া নিয়ে সঠিক ধারণা না থাকায় অনেক সময় অনেক ভুলভাল কথা বলেছি বা আচরণও করেছি। কম্বাইন্ড স্কুল হলেও ছেলেমেয়েদের এই বিষয়গুলোকে খুব গোপনীয়ভাবে দেখা হত এবং মেয়েদেরকে আলাদাভাবে নানা কনফারেন্স ও ক্লাস নেওয়া হত, যা আমাদের মনে আরও আগ্রহ বাড়িয়ে দিত যে পিরিয়ড আসলে কী?” 

পরে নিজের ভাবনায় বদল আসার কথা জানিয়ে এই শিক্ষার্থী বলেন, “এখন আর এটাকে আজব কিছু মনে হয় না। বন্ধুদের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলে বিষয়গুলো খুব স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। ”

সঠিক ধারণা না থাকার কুফল

পিরিয়ড নিয়ে সঠিক ধারণা না রাখার কারণেই মেয়ে ও ছেলেদের মধ্যে বিব্রতকর পরিস্থিতি ঘটে বলে মনে করছেন আদমজী ক্যান্টনমেট কলেজের ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী ইয়ানুর সুলতানা রোজা।

তিনি বলেন, “স্নাতক শেষ করা ছেলেটাও কৈশোরে না জেনেই তার মেয়ে বন্ধুকে অনেক এলোমেলো প্রশ্ন করে ফেলত; আর মেয়েটা লজ্জায় ও সংকোচে নিজেকে আরও আড়াল করতে চাইত।”

নিজের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছেলে সহপাঠীদের কাছ থেকে কখনও মাসিক নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া পাননি বলে জানান তিনি।

স্বচ্ছন্দে কাটুক মাসের বিশেষ সময়

নিজের পিরিয়ডের প্রথম দিকের দিনগুলো মনে করে ইয়ানুর বলেন, “পিরিয়ড যখন প্রথম শুরু হয় তখন এটাকে আড়াল করার বিষয় মনে হত। আমার তো মনে হত এটা একটা শারীরিক সমস্যা।” 

আর এখন প্রতি মাসের এই বিশেষ কয়েকটি দিন নিয়ে কী ভাবেন?

মহামারীর কারণে আটকে যাওয়া উচ্চ মাধ্যমিকের পরীক্ষার্থী ইয়ানুর বলেন, “স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে যখন কলেজে ভর্তি হলাম তখন ছেলেমেয়েরা এক সঙ্গে ক্লাস করা শুরু করলাম। কলেজে ওঠার পরেই আমি পিরিয়ড বিষয়টাকে স্বাভাবিকভাবে দেখা শুরু করি। এটাকে আমার আর অসুস্থতা বলে মনে হয়না।

“এটা আমার অনুভূতি। কিন্তু আমার অনেক বান্ধবীকে তখনও লজ্জা পেতে দেখেছি। অন্যরা জানলে কী ভাববে তাই নিয়ে লজ্জা, পিরিয়ডের দিনগুলোতে নিজেকে একটু আড়াল করার চেষ্টাও করতে দেখেছি অনেকের ভেতর। তবে খোলামেলাভাবে আলোচনা করায় সেই বিষয়গুলো ঠিক হয়ে গেছে।”

পিরিয়ডের দিনে ‘মুড সুইং’ হলে তখনও বন্ধুদের কাছে খুব আন্তরিক আচরণ পান বলে জানালেন তিনি।