মঙ্গলবার দুপুরে চট্টগ্রাম
প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ দাবি জানান।
হারুন বশর হত্যার প্রত্যক্ষদর্শী
মোশাররফ হোসেন এ মামলায় ২০১৭ সালের ২৫ মে আদালতে সাক্ষ্য দেন।
প্রয়োজনে আবারও সাক্ষ্য
দেবেন জানিয়ে ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বলেন, “এই ঘটনা হুবহু আদালতে আমি সাক্ষ্য দিয়েছি।
আমি শিবিরের নাসিরকে শনাক্ত করেছি। জজের সামনে আমি হুবহু এটা বলেছি। এটা তো আমার চোখে
দেখা, আমার চোখের সামনে হয়েছে। তাকে তো অবশ্যই ফাঁসি দেওয়া উচিত।
“নাছির এক নম্বর আসামি।
একটা কথা আছে- জাস্টিস ডিলেইড, জাস্টিস ডিনাইড। বিচার বিলম্বিত হলে বিচার পাওয়া না
পাওয়া সমান কথা। আদালতের কাছে আবেদন, প্রয়োজনে আবার সাক্ষী দিতে আমি রাজি। এরকম দুর্ধর্ষ
খুনির বিনা সাজায় জেলখানায় থাকা উচিত নয়।”
ওই মামলার প্রধান আসামি
নাসির উদ্দিন ইসলামী ছাত্রশিবিরের দুর্ধর্ষ ক্যাডার এবং পুলিশের তালিকাভুক্ত শীর্ষ
সন্ত্রাসী ছিলেন।
তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন
থানায় খুন, গুমসহ প্রায় ৩৬টি মামলা আছে। এরমধ্যে কয়েকটি মামলায় বিভিন্ন মেয়াদে তার
সাজা হয়েছে।
১৯৯৮ সালের ৬ এপ্রিল
চট্টগ্রাম কলেজের শেরেবাংলা ছাত্রাবাস এলাকা থেকে নাসিরকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। সেদিন
পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় করা মামলায় ২০১৭ সালের ৪ অক্টোবর পাঁচ বছরের সাজা হয় নাসিরের।
গ্রেপ্তারের পর ২২ বছর ধরে কারাগারে আছেন নাসির।
সম্প্রতি গণমাধ্যমে
হারুন বশর হত্যা ও ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের হত্যাচেষ্টার মামলায় আদালতে সাক্ষী না
আসায় সাক্ষ্যগ্রহণ হচ্ছে না বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়।
মঙ্গলবারের সংবাদ সম্মেলনে
ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বলেন, “পত্রিকায় যেভাবে আমার নাম ধরে লেখা হয়েছে, এটা আমার
ওপর দায়িত্ব বর্তায় যে ক্লিয়ার করে দেওয়া। আমি মনে করেছি, এটা এক্সপ্লেইন করা দরকার।
“এ ঘটনায় আদালতে সাক্ষ্য
দিয়েছি। আসামি নাসিরকে শনাক্ত করেছি। এর অতিরিক্ত তো কিছু হতে পারে না।”
সেদিন যা ঘটেছিল
১৯৯২ সালের ৮ মে ফটিকছড়ির
মোহাম্মদ ত্বকিরহাট এলাকায় গাড়িতে হামলা চালিয়ে হত্যা করা হয় ভুজপুর ইউনিয়ন আওয়ামী
লীগের তখনকার সাধারণ সম্পাদক হারুন বশরকে।
সেদিন ফটিকছড়ি আজাদী
বাজার এলাকায় উপজেলা ছাত্রলীগের সম্মেলনে যোগ দিয়ে ফিরছিলেন তখনকার চট্টগ্রাম উত্তর
জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোশাররফ হোসেন। তার সঙ্গে একই গাড়িতে ছিলেন হারুন।
সেদিনের ঘটনার বর্ণনা
দিয়ে মোশাররফ হোসেন বলেন, “সম্মেলন চলছিল। দুপুর ১টার দিকে হঠাৎ শিবিরের একটি সশস্ত্র
বাহিনী ট্রাকে-বাসে এসে আক্রমণ চালায়। সেখানে আমাদের ছাত্রলীগকর্মী জমির উদ্দিনকে গুলি
করে হত্যা করে।
“চারদিকে ছোটাছুটি
শুরু হলে আমি এবং রফিকুল আনোয়ার (প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা) পাশ্ববর্তী স্কুলের অফিসে
আশ্রয় নিই। দেখলাম পুলিশের সামনে দিয়ে ট্রাক-বাসে করে অস্ত্র হাতে নিয়ে শিবিরের সন্ত্রাসীরা
হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে চলে যাচ্ছে। পুলিশ কিছুই করেনি।”
ওই হামলায় সম্মেলন
পণ্ড হওয়ার পর নিহত কর্মী জমিরের জানাজা পড়ে শহরে যাওয়ার কথা জানিয়ে মোশাররফ বলেন,
“ভেবেছিলাম, হাটহাজারী হয়ে গেলে আমাদের ওপর শিবিরের সন্ত্রাসীরা আক্রমণ করতে পারে।
তখন রুট পরিবর্তন করি। ফটিকছড়ির নানুপুরে গেলাম। সেখান থেকে মোহাম্মদ ত্বকীর হাট হয়ে
রাউজান দিয়ে শহরে যাব ঠিক করলাম।
“সম্মেলনের কয়েকদিন
আগে শিবিরের সন্ত্রাসীদের হামলায় হারুন বশর পঙ্গু হয়ে গিয়েছিলেন। গাড়ির সামনের সিটে
বসালাম হারুন বশরকে। সন্ধ্যার পর আমরা মোহাম্মদ ত্বকীর হাটে পৌঁছালাম। আমি আশ্চর্য
হয়ে গেলাম, চর্তুদিকে সেইম ড্রেস পরা ২০-২৫ জন সশস্ত্র লোক আমাদের ঘিরে ফেলে। এক মিনিটের
মধ্যে গাড়ি ভাংচুর শুরু করে।”
তখন গাড়ি থেকে নেমে
নিজের পরিচয় দেন জানিয়ে সাবেক মন্ত্রী মোশাররফ বলেন, “হারুন বশরকে দেখে গাড়ি থেকে নামিয়ে
গালি দিয়ে তারা বলে, তুই এখনও বেঁচে আছস? তারপর তাকে আমার গাড়ির চাকার ওপর বসাল। ব্রাশফায়ার
করার মুহূর্তে আমি সামনে দাঁড়িয়ে গেলাম। আমি বললাম, সে একজন পঙ্গু মানুষ, তাকে ছেড়ে
দাও।
“ডোন্ট কিল হিম, ইফ
ইউ ওয়ান্ট, কিল মি। তারা আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ব্রাশফায়ার করে হারুন বশরকে খুন করল।
এরপর আমার মাথায় রাইফেল ঠেকিয়ে নাসির বলল, ‘আঁরে চিনি ল, আর নাম নাসির।’ আমার সঙ্গে
ধ্বস্তাধ্বস্তি হল। রাইফেলের বাট দিয়ে আমাকে বেদম মারধর করল।”
তখন গাড়ির (নিশান পেট্রোল)
পেছনের আসনে থাকা সে সময়ের ছাত্রলীগ নেতা জসীম উদ্দিন শাহ, ইউনূস গণি, মুক্তিযোদ্ধা
আবু আহমেদ বের হয়ে আসলে সন্ত্রাসীরা তাকে ছেড়ে দিয়ে অন্যদের ধরতে ধাওয়া করে বলে জানান
মোশাররফ।
তিনি বলেন, “এই সুযোগে
আমি পাশের একটি খালে লাফ দিই। সেখানে পাটিপাতা ছিল, এর ভেতরে আমি শুয়ে থাকি। সন্ত্রাসীরা
আবার ফিরে এসে এলোপাতাড়ি ব্রাশফায়ার শুরু করল। কিন্তু অন্ধকারে তারা আমাকে দেখতে পায়নি।
আমাকে না পেয়ে চলে গেল। আমি হামাগুড়ি দিয়ে দিয়ে খালপাড় থেকে কিছুদূর গেলাম। হেঁটে স্থানীয়
আবদুল্লাহপুর বাজারে পৌঁছলাম।”
আওয়ামী লীগ নেতা মোশাররফ
বলেন, “তখন বিএনপি ছিল ক্ষমতায়। বিএনপির মদদপুষ্ট হয়ে আমার ওপর হামলা করেছে। না হলে,
পুলিশ হামলাকারীদের গুলি করল না কেন? জামায়াত-শিবির
হচ্ছে বিএনপির ‘বি’ টিম।
“আমার চালক ইদ্রিস
মিয়া মুক্তিযোদ্ধা আবু আহমেদ তো এখনও আছে। প্রয়োজনে আদালতে তাদের জিজ্ঞেস করা হোক।
আদালতের কাছে আবেদন- বিচার যাতে দীর্ঘায়িত না হয়, দোষীকে যেন শাস্তি দেওয়া হয়।”
এতদিনেও মামলায় বিচার
শেষ না হওয়ায় সংশ্লিষ্টদের গাফিলতি আছে কিনা প্রশ্ন করা হলে মোশাররফ বলেন, “যেহেতু
বিলম্বিত হয়েছে কারও না কারও গাফিলতি আছে। যার কারণে দেরি হচ্ছে তার দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া
উচিত।”
হারুন হত্যার ঘটনায়
ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফের গাড়ির চালক ইদ্রিস মিয়া বাদী হয়ে হত্যা মামলা করেন।
১৯৯২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর
অভিযোগপত্র দেওয়ার পর ২৬ জনকে আসামি করে অভিযোগ গঠন হয় ২০০২ সালের ২৫ জুন।
মামলায় কতজন সাক্ষ্য
দিয়েছেন জানতে চাইলে চট্টগ্রামের বিভাগীয় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের পিপি আইয়ুব খান
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নথি দেখে বলতে হবে।”
সংবাদ সম্মেলনে চট্টগ্রাম
উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এম এ সালাম, সহ-সভাপতি এটিএম পেয়ারুল ইসলাম, সাংসদ
ও উত্তর জেলার সাংগঠনিক সম্পাদক খাদিজাতুল আনোয়ার সনি, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক দেবাশীষ
পালিত ও জসীম উদ্দিন শাহ, সদস্য বেদারুল আলম চৌধুরী বেদার এবং মহিলা লীগের সভাপতি দিলোয়ারা
ইউসুফ উপস্থিত ছিলেন।