মানুষ অমর নয়, সে জানে। তারপরও সে মরতে চায় না। অমর হতে চায়। হয়ত ভাবে আমি অমৃতের সন্তান, অমর হব না কেন? তাই জীবন ও মৃত্যুর রহস্য সে খুঁজে ফেরে। আজকের আধুনিক যুগেই শুধু নয়, হাজার হাজার বছর পূর্বে সভ্যতার ঊষালগ্নেও।
এমনই একটি চরিত্র ‘গিলগামেশ’। গিলগামেশ পৃথিবীর প্রাচীনতম উপাখ্যান। সম্ভবত এটি পৃথিবীর প্রথম গল্প।
গিলগামেশ মেসোপটেমিয়া পুরাণের একটি চরিত্র। তার গল্প মানবিক ইতিহাসের প্রথম মহাকাব্যে বর্ণনা করা হয়েছে যা ‘গিলগামেশের মহাকাব্য’ নামে নামকরণ করা হয়। এটি খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ সালে রচিত। এ মহাকাব্যে আবর্তিত হয়েছে প্রাচীন নগরী উরুকের রাজা গিলগামেশ ও তার বন্ধু এনকিদুকে ঘিরে।
গিলগামেশ মহাকাব্য অনুযায়ী, এনকিদুকে দেবতারা প্রেরণ করেন গিলগামেশের সাথে যুদ্ধের জন্য। কিন্তু ঘটনার পরিক্রমায় এনকিদু একসময় গিলগামেশের ভালো বন্ধুতে পরিণত হয়। এনকিদু শৈশবের কমিক্সের টারজানের মতো একটি চরিত্র, যাকে দেবতা আরুরু আবির্ভাব ঘটান। দেবমাতা নিনসন এনকিদুকে তার দ্বিতীয় পুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন। দেবমাতা নিনসনের আদেশে গিলগামেশ ও এনকিদু একসাথে বিভিন্ন অভিযানে যায়, যার উত্থান পতনের বর্ণনা মহাকাব্যে রয়েছে।
মহাকাব্যে ঘটনাক্রমে স্বর্গের ষাড় হত্যা ও অপদেবতা হুমাবাবা হত্যার জন্য এনকিদুর শাস্তি হিসেবে মৃত্যু হলে গিলগামেশ মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। সে কোনভাবে তার বন্ধু এনকিদুর মৃত্যু মেনে নিতে পারে না। তাই সে চেষ্টা শুরু করে বন্ধুকে পুনর্জীবিত করার। গিলগামেশ শুনেছে পৃথিবীর শেষ প্রান্তে উৎনাপিশতিম নামে একজন আছেন যিনি মৃত্যুকে জয় করেছেন। তিনি নাকি জানেন অমরত্বের রহস্য। যে করেই হোক তার কাছ থেকে অমরত্বের রহস্য উদঘাটন করে বন্ধু এনকিদুকে পুনর্জীবিত করতে হবে।
সে সূত্রে শুরু হলো গিলগামেশের যাত্রা। বিশাল অরণ্য,পাতাল থেকে শুরু করে আকাশছোঁয়া মাশু পর্বত পেরিয়ে সে মৃত্যুসাগরের পাড়ে পৌঁছে। উৎনাপিশতিমের নৌকার মাঝি উর্শানাবি ছাড়া আর কেউ ওই নদী পেরোতে পারে না। মাঝি গিলগামেশকেও পার করবে না, তাকে নিজের চেষ্টায় পার হতে হবে। অসম্ভবকে সম্ভব করে গিলগামেশ হাজির হলো উৎনাপিশতিমের কাছে।
কিন্তু উৎনাপিশতিম তাকে জানান মৃত্যু থেকে বাঁচার কোন উপায় নেই। তিনি মহাপ্লাবনের সময় দেবতা এয়ার দয়ায় বেঁচে গেছেন। মৃত্যুকে জয় করার কোন ক্ষমতা বা উপায় তার জানা নেই।
উৎনাপিশতিমের কথায় গিলগামেশ যখন আশাহত হয়ে পড়ে তাকে দেখে মায়া হয় উৎনাপিশতিমের স্ত্রীর। তিনি স্বামীকে ভর্ৎসনা করে বলেন- এটা কেমন হলো তোমার? একটা মানুষ অসাধ্য সাধন করে এত দূর এলো আর তাকে তুমি খালি হাতে ফিরিয়ে দিচ্ছ? এটা একটা বিবেচনা হলো? উপায়ন্তর না দেখে উৎনাপিশতিম সত্যটা গিলগামেশকে জানালেন। বললেন- মৃত্যসাগরের তলায় গায়ে কাঁটাযুক্ত একধরনের লতা আছে, জীয়নলতা। এই লতাই পারে মানুষকে অমরত্ব দিতে।
গিলগামেশ উদ্ধার করে সেই জীয়নলতা। তারপর পা বাড়ায় উরুকের উদ্দেশ্যে। বন্ধু এনকিদুকে সে পুনর্জীবিত করবে, দেবে অমরত্ব।
পথে এক দীঘির পাড়ে জীয়নলতা রেখে গোসল করতে নামে গিলগামেশ। তার এতদিনের ক্লান্তি ধুয়ে গেল শীতল জলে। আর সেই ফাঁকে এক সাপ খেয়ে গেল তার জীয়নলতা।
গিলগামেশ গোসল সেরে উঠে দেখে জীয়নলতা নেই, বরং সে জায়গায় পড়ে আছে একটা সাপের মরা খোলস। বুঝতে গিলগামেশের অসুবিধে হয় না, জীয়নলতার আস্বাদনে নতুন যৌবন নিয়ে সাপটি চলে গেছে, ফেলে রেখে গেছে মৃত বার্ধক্যের স্মৃতি, পুরনো জীবন- তার খোলস।
হতাশ গিলগামেশ মাটিতে বসে অঝরে কাঁদতে থাকে। ব্যর্থ, পরাজিত সে। তার সব পরিশ্রম নিয়তির বানে ব্যর্থ হলো। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! গিলগামেশ তার বন্ধুকে পরিশেষে অমরত্ব দান করতে পারেনি, পারেনি বাঁচাতে।
তারপর গিলগামেশ অনুধাবন করে মৃত্যু সত্য, সব মানুষকে একদিন হারিয়ে যেতে হবে। হতাশা ভুলে গিলগামেশের চোখে নতুন স্বপ্ন জেগে ওঠে। আর এভাবেই শেষ হয় গিলগামেশ উপ্যাখ্যান।
এমন অনবদ্য মহাকাব্য ‘গিলগামেশ’ এর প্রকৃত লেখকের নাম জানা না গেলেও তা রক্ষিত আছে যুগের পর যুগ। মানুষ মরণশীল। এনকিদু মারা গেছে, গিলগামেশও অমর নয়। কিন্তু এই মহাকাব্যের মধ্য দিয়ে তাদের ভালোবাসা অমর হয়ে থাকবে কালের পর কাল, শতাব্দীর পর শতাব্দী। এটিই এই মহাকাব্যের সবচেয়ে বড় সার্থকতা।
কিউনিফর্ম লিপিতে লেখা এ যাবত জানা পৃথিবীর প্রথম গল্প ‘গিলগামেশ’ মহাকাব্যটি বাংলায় অনুবাদ করেন লেখক, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী হায়াৎ মামুদ (জন্ম ৩ জুন ১৯৩৯)। বইটি তিনি শিশু-কিশোরদের জন্য লিখলেও তা বড়দের জন্যও বেশ উপভোগ্য।
লেখক পরিচিতি: শিশু সাংবাদিক, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না! |