বৃহস্পতিবার মেলার মাঠে ঘুরে স্টল, প্যাভিলিয়ন ও অবকাঠামো নির্মাণে কারিগরদের ব্যস্ত সময় পার করতে দেখা গেছে। হাতে আর কয়েক দিন মাত্র বাকি থাকায় মেলার মাঠে পুরোদমে চলছে স্টল নির্মাণ ও সাজসজ্জার কাজ।
করোনাভাইরাস মহামারী কারণে এবার অমর একুশে গ্রন্থমেলা দেড় মাস পিছিয়ে ১৮ মার্চ থেকে শুরু হতে যাচ্ছে। সেদিন বিকাল ৪টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে মেলার উদ্বোধন করবেন।
ইতোমধ্যে লটারি করে প্রকাশকদের স্টল ও প্যাভিলিয়ন বুঝিয়ে দিয়েছে মেলা কর্তৃপক্ষ। মহামারী পরিস্থিতি বিচেনায় এবার ভিড় এড়াতে স্টলের সামনে ফাঁকা জায়গা থাকছে বেশি; স্টলের দূরত্বও বাড়ানো হয়েছে।
ফলে এবার প্রায় ১৫ লাখ বর্গফুটের বিশাল বিস্তৃতি পাচ্ছে বইমেলা; যা গতবারের প্রায় দ্বিগুণ।২০২০ সালে বইমেলার আয়োজন হয়েছিল প্রায় আট লাখ বর্গফুট জায়গা নিয়ে।
বাংলা একাডেমির পরিচালক ও মেলা আয়োজক কমিটির সদস্য সচিব জালাল আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রত্যেক প্রবেশপথে হ্যান্ড স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা থাকবে। মেলায় প্রবেশ করতে হলে অবশ্যই মাস্ক পরতে হবে।”
মহামারীর কারণে ঝুঁকি এড়াতে মেলা প্রাঙ্গণের আয়তন বৃদ্ধি করার বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন,
সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে একুশে বইমেলার একটি স্টল তৈরির কাজ চলছে। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি
“স্টলের সারিগুলোর দূরত্ব বাড়ানো হয়েছে। মেলায় প্রবেশ ও প্রস্থানের জন্য সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের রমনা গেইট দিয়ে আরও একটি নতুন পথ করা হয়েছে। রাখা হয়েছে গাড়ি রাখার ব্যবস্থা।”
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভেতর স্বাধীনতার স্তম্ভকে কেন্দ্র করে উদ্যানের উত্তর ও পূর্ব দিকের অংশেও বেড়েছে মেলার পরিসর।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীকে ঘিরে উৎসর্গ করা হবে বইমেলার এবারের আয়োজন।
বইমেলার সামগ্রিক সৌন্দর্য, বিন্যাস ও প্রকাশনায় থাকবে মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর আবহ। মেলার কারুকাজ ও আলোকচিত্রে থাকবে স্বাধীনতার চেতনার প্রকাশ।
স্বাধীনতার পাঁচটি দশককে পাঁচটি আঙ্গিকে উপস্থাপন করা হবে মেলায়; যাতে বইমেলায় এসে দর্শনার্থীরা স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর অনুভূতিও উপলব্ধি করতে পারেন। এছাড়া স্বাধীনতা স্তম্ভের চারদিকে বর্ণমালা দিয়ে নির্মাণ করা হবে হরফ স্থাপনা।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মেলা প্রাঙ্গণে প্রবেশের জন্য রমনার ইঞ্জিনিয়ারিং ইস্টিটিউটের সামনে দিয়ে এবার নতুন করে একটি প্রবেশ ও প্রস্থান পথ রাখা হয়েছে।
পাশেই গাড়ি রাখার ব্যবস্থা হয়েছে মেলায় আসা দর্শনার্থীদের জন্য। এছাড়া উদ্যানে প্রবেশ ও প্রস্থানের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি সংলগ্ন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ফটক ও বাংলা একাডেমির বিপরীত পাশ দিয়ে আরও দুটি করে পথ থাকবে।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে চলছে একুশে বইমেলার প্রস্তুতি। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি
এদিকে শাহবাগ থেকে টিএসসি, বাংলা একাডেমির সামনে দিয়ে দোয়েল চত্বরের রাস্তায় মেট্রোরেলের রাস্তা নির্মাণের কাজ চলছে। তাতে যেন মেলায় আসা দর্শনার্থীদের সমস্যা না হয়, সেজন্য ১৬ মার্চের মধ্যে ওই রাস্তা খালি করে দেওয়া হবে জানিয়ে জালাল আহমেদ বলেন, মেলা চলাকালে মেট্রোরেলের কাজ বন্ধ থাকবে।
“এছাড়া এই রাস্তায় যাতে বেশি জনসমাগম না হয়, সেজন্যই রমনার দিক দিয়ে প্রবেশ ও প্রস্থান পথ রাখা হয়েছে।”
এবার ঝড়-বৃষ্টি ও গরমের মৌসুম মার্চ ও এপ্রিলে বইমেলা হচ্ছে। এ বিষয়টি মাথায় রেখেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানালেন জালাল আহমেদ।
“ঝড়-বৃষ্টি হলে কেউ যাতে না ভেজে, সেজন্য চারটি শেড নির্মাণ করা হবে। পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের ইউনিটও থাকবে।”
বৃষ্টি বা ঝড় না থাকলে আশ্রয়কেন্দ্রগুলো মোড়ক উন্মোচনের স্থান ও লেখক আড্ডার জায়গা হিসাবে ব্যবহৃত হবে। এছাড়া ঝড়-বৃষ্টির কবলে পড়ে বইমেলায় বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থার ক্ষতি এড়াতে প্রতিটি স্টলের ওপরে ত্রিপলের বদলে দেওয়া হচ্ছে টিনের ছাউনি।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে একুশে বইমেলার স্টল তৈরিতে ব্যস্ত শ্রমিকরা। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি
এবারের মেলায় ৫২২টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান অংশ নেবে বলে জানিয়েছে বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ। সব মিলিয়ে মেলায় স্টলের ইউনিট দাঁড়াবে আট শতাধিক। বাংলা একাডেমিসহ মোট প্যাভিলিয়ন থাকবে ৩৩টি। এছাড়া সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মূল মেলা প্রাঙ্গণে থাকবে লিটল ম্যাগাজিন চত্বর।
অন্যবারের মত এবারও শিশুচত্বর মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে থাকবে। এই কর্নারকে শিশুকিশোর বিনোদন ও শিক্ষামূলক অঙ্গসজ্জায় সজ্জিত করা হচ্ছে। মাসব্যাপী বইমেলায় এবারও শুক্র ও শনিবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ‘শিশুপ্রহর’ ঘোষণা করা হবে।
বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে নজরুল মঞ্চ ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা থাকবে।
বিশেষ দিনগুলোতে লেখক, সাংবাদিক, প্রকাশক, বাংলা একাডেমির ফেলো এবং রাষ্ট্রীয় সম্মাননাপ্রাপ্ত নাগরিকদের জন্য প্রবেশের বিশেষ ব্যবস্থা থাকবে।
এছাড়া বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে মাসব্যাপী থাকবে আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানের শুরুতে প্রতিদিনই থাকছে কবিকণ্ঠে কবিতাপাঠ ও আবৃত্তি।
করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে এবার দেরিতে শুরু হচ্ছে অমর একুশে বইমেলা। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে এই বছর বইমেলার পরিধি আরও বাড়ানো হয়েছে। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি
প্রতিদিন বিকেল ৩টায় শুরু হয়ে রাত ৯টা পর্যন্ত তা চলবে। ছুটির দিন বেলা ১১টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত মেলা খোলা থাকবে।
তবে শুক্রবার বেলা ১টা থেকে বেলা ৩টা এবং শনিবার বেলা ১টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত বিরতি থাকবে। বইমেলা চলবে আগামী ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত।
১৯৭২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা দিবসের অনুষ্ঠানে বাংলা একাডেমির গেইটে চট বিছিয়ে বই বিক্রি শুরু করেন মুক্তধারা প্রকাশনীর মালিক চিত্তরঞ্জন সাহা। ১৯৭৭ সালে তার সঙ্গে আরও অনেকে যোগ দেন।
১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক আশরাফ সিদ্দিকী বাংলা একাডেমিকে এ বইমেলার সঙ্গে সম্পৃক্ত করেন। পরের বছর মেলার সঙ্গে যুক্ত হয় বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি।
১৯৮৩ সালে মনজুরে মওলা বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্বে থাকার সময় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ নামে এ মেলা আয়োজনের প্রস্তুতি নেওয়া হলেও তা আর করা যায়নি। পরের বছর ১৯৮৪ সালে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ‘অমর একুশে বইমেলা’র সূচনা হয়।
মাতৃভাষার অধিকার আদায়ের মাস ফেব্রুয়ারিজুড়ে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণের এই বইমেলা এখন বাঙালির মননের মেলায় পরিণত হয়েছে।
আরও খবর-
ফেব্রুয়ারিতে হচ্ছে না বইমেলা: বাংলা একাডেমি
বইমেলা পেছাতে চায় বাংলা একাডেমি
একুশে বইমেলা ১৮ মার্চ শুরুর সিদ্ধান্ত