গত ৯ ফেব্রুয়ারি হারুনুর রশিদ নামে এক ব্যক্তির পক্ষ থেকে সিলেট জেলা বারের আইনজীবী মো. মোয়াজ্জেম হোসেন চৌধুরীর চেম্বারের প্যাড ও স্বাক্ষরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জ্যেষ্ঠ চার সম্পাদকের নামে উকিল নোটিসটি পাঠানো হয়।
এ বিষয়ে বিস্ময় প্রকাশ করে হারুনুর রশিদ বলেছেন, ওই নোটিসের বিষয়ে তার কোনো ধারণাই নেই, ডা. ইকবালকেও তিনি চেনেন না।
আর আইনজীবী মোয়াজ্জেম বলছেন, ‘জালিয়াতির মাধ্যেমে’ তার নাম, চেম্বারের প্যাড আর সই ব্যবহার করে ওই নোটিস কেউ পাঠিয়েছে বলে তার ধারণা।
ওই নোটিসে গত এক যুগের বিভিন্ন তারিখ উল্লেখ করে সেসব দিনে ডা. এইচ বি এম ইকবাল এবং তার পরিবারের বিরুদ্ধে মামলার কার্যক্রম বা আদালতের আদেশ নিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলো মুছে ফেলতে বলা হয়।
আর তা না করলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এবং ‘মানহানির’ জন্য এক হাজার কোটি টাকার দাবিতে মামলা করা হবে বলে হুমকি দেওয়া হয়।
নোটিসের শেষে বলা হয়, “প্রকাশিত সংবাদের ব্যাপারে ভুল স্বীকার পূর্বক বিজ্ঞপ্তি প্রদান করিবেন। অন্যথায় বিরূপ পরিণতির জন্য আপনারা দায়ী থাকিবেন।”
যেসব প্রতিবেদন তুলে ফেলার জন্য ওই হুমকি দেওয়া হয়েছে, সেসব প্রকাশিত হয়েছিল প্রিমিয়ার গ্রুপ অব কোম্পানিজের চেয়ারম্যান সাবেক এমপি ইকবাল এবং তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে হওয়া মামলা, তার কার্যক্রম এবং আদালতের আদেশ নিয়ে।
অন্য সব সংবাদমাধ্যমের মত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমেও সেসব প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। সেসব মামলা থেকে তারা অব্যাহতিও পেয়ে গেছেন।
কিন্তু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের পুরনো প্রতিবেদনগুলো এখনও অনলাইনে থাকায় ডা. ইকবাল ও তার পরিবারের ‘সম্মানহানি হচ্ছে’ দাবি করে তা তুলে ফেলার জন্য চাপ দেওয়া হয়েছে ওই উকিল নোটিস পাঠিয়ে।
ফেব্রুয়ারির প্রথম দুই সপ্তাহে দুই ডজন জেলা থেকে এরকম তিন ডজনের বেশি উকিল নোটিস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ঠিকানায় পৌঁছায়। ভিন্ন ভিন্ন নামে পাঠানো হলেও সবগুলো নোটিসের ভাষা, বক্তব্য ও দাবি একই রকম।
উকিল নোটিস পাওয়ার পর আইনিভাবেই তার জবাব দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। এর অংশ হিসেবে সিলেট জেলা বারের আইনজীবী মো. মোয়াজ্জেম হোসেন চৌধুরীর চেম্বারের ঠিকানাতেও আইনজীবীর মাধ্যমে জবাব পাঠানো হয়।
কিন্তু মোয়াজ্জেম হোসেন চৌধুরী ৭ মার্চ এক চিঠি পাঠিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, নোটিসের জবাব পেয়ে তিনি বিস্মিত, কারণ তিনি আদৌ কোনো নোটিস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে পাঠাননি। হারুনুর রশিদ নামে কাউকে তিনি চেনেন না। ডা. এইচ বি এম ইকবালও তার সঙ্গে যোগাযোগ করেননি।
ওই চিঠিতে বলা হয়, কেউ একজন মোয়াজ্জেম হোসেন চৌধুরীর নাম ব্যববহার করে ওই ভুয়া নোটিস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে পাঠিয়েছে বলে তিনি ধারণা করছেন।
উকিল নোটিসে বলা হয়েছিল, নোটিসদাতা হারুনুর রশিদ সাবেক সাংসদ ইকবালের একজন শুভাকাঙ্ক্ষী। কিন্তু হারুনুর রশিদ এখন তা অস্বীকার করায় ডা. ইকবালের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। বৃহস্পতিবার কয়েক দফা ফোন করে এবং পরে এসএমএস করে তার সঙ্গে কথা বলতে চাওয়া হয়।
ডা. ইকবাল কল কেটে দিলেও পরে তার মোবাইল থেকে ফেইসটাইম অ্যাপে প্রতিবেদকের পরিচয় জানতে চাওয়া হয়। পরিচয় পাওয়ার পর বলা হয়, ডা. ইকবালকে ‘এখন পাওয়া যাবে না’।
এইচ বি এম ইকবাল: এক যুগ আগের রায়ের খবর নিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরকে উকিল নোটিস
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরের প্রতিবেদন মুছতে চাপের পর এবার মামলার আবেদন
‘না জানিয়েই’ নাম দিয়েছে, বললেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরের বিরুদ্ধে মামলার ‘সাক্ষী’
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম উকিল নোটিসের জবাব দেওয়ার পর এ চিঠি পাঠিয়েছেন সিলেট জেলা বারের আইনজীবী মো. মোয়াজ্জেম হোসেন চৌধুরী
জালিয়াতি?
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ঠিকানায় সিলেট থেকে পাঠানো ওই প্রথম উকিল নোটিস এবং পরে মোয়াজ্জেম হোসেনের পাঠানো চিঠি- দুটোই পাঠানো হয়েছে একই রকম প্যাড ও সিল ব্যবহার করে। নোটিসে সিল দেওয়া হয়েছে বাংলায়, আর মোয়াজ্জেম হোসেনের পাঠানো চিঠিতে সই দেওয়া হয়েছে ইংরেজিতে।
আইনজীবী মোয়াজ্জেম হোসেনের ওই চিঠি পাওয়ার পর বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সিলেট প্রতিনিধি বৃহস্পতিবার জেলা বারের দুই নম্বর বার হলে তার চেম্বারে যান। তবে মোয়াজ্জেম হোসেন সেখানে ছিলেন না।
তার সহকারী মো. তাহের বলেন, সম্প্রতি বিডিনিউজ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের পাঠানো উকিল নোটিসের জবাব পেয়ে ‘হতবাক’ হয়ে যান অ্যাডভোকেট মোয়াজ্জেম, কারণ কোনো নোটিস তারা বিডিনিউজ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে পাঠাননি। বিষয়টিতে ‘কোনো ঘাপলা আছে’ মনে করেই ৭ মার্চ বিডিনিউজ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে চিঠি দিয়ে বিষয়টি জানান তিনি।
তাহের বলেন, অসুস্থতার কারণে অ্যাডভোকেট মোয়াজ্জেম চেম্বারে আসেননি। পরে তাহের তার ফোন থেকেই অ্যাডভোকেট মোয়াজ্জেমের সঙ্গে কথা বলিয়ে দেন।
মোয়াজ্জেম টেলিফোনে বলেন, “আমি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের নামে কোনো লিগ্যাল নোটিস পাঠাইনি। কোনো দুষ্কৃতকারী প্যাড, সিল ও সই জালিয়াতি করে ভুয়া লিগ্যাল নোটিসটি পাঠিয়েছে।”
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে সিলেট থেকে পাঠানো সেই উকিল নোটিসের শেষাংশ
কাউকে ‘চেনেন না’, হারুনুর রশিদ
উকিল নোটিসে যে ঠিকানা দেওয়া হয়েছে, সেখানে যোগাযোগ করে একজন হারুনুর রশিদের সন্ধান পায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। তিনিও বলেন, ওই রকম কিছু তিনি পাঠাননি। কারা তার নামে এটা করতে পারে, সে বিষয়েও কোনো ধারণা তার নেই।
নোটিসে বলা হয়েছিল, নোটিসদাতা হারুনুর রশিদের বাবা মৃত আব্দুর রহমান এবং মায়ের নাম মৃত আমেনা বেগম। গ্রামের নাম ভাটিপাড়া দৌলতপুর, থানা বিশ্বনাথ।
হারুন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তার নাম এবং গ্রামের নাম ঠিক আছে, তবে বাবা-মায়ের নাম মিলছে না। তার বাবার নাম কয়ছর আলী, মায়ের নাম আঙ্গুরা বেগম। তবে ওই গ্রামে হারুনুর রশিদ নামে অন্য কেউ নেই।
“আমি কৃষক মানুষ, ক্ষেত করে জীবন চালাই। এমপি ইকবালকে আমি চিনি না। যাদের নোটিস দিয়েছি বলছেন, তাদেরও আমি চিনি না।”
সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধের চেষ্টা: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরের বিবৃতি
চাপে নত হব না: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরের প্রধান সম্পাদক
পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের চাপের বিষয়ে জানাতে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি সংবাদ সম্মেলন করে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
‘অনৈতিক চাপ’
ডা. ইকবাল এবং তার পরিবারের বিরুদ্ধে মামলা নিয়ে পুরনো প্রতিবেদন মুছতে যেসব উকিল নোটিস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে পাঠানো হয়েছে, তার মধ্যে বরিশালের একজন নোটিসদাতা সেখানকার হাকিম আদালতে ‘মানহানির’ একটি মামলার আবেদনও করেছেন। তবে ওই মামলা আমলে নেওয়া হবে কি না, সে বিষয়ে কোনো আদেশ এখনও আদালত দেয়নি।
ওই মামলার আর্জিতে ‘সাক্ষী’ হিসেবে নিজের নাম দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন স্থানীয় একজন সাংবাদিক। সম্প্রতি ফেইসবুক পোস্ট দিয়ে রুবেল খান নামের ওই সাংবাদিক বলেছেন, তাকে সাক্ষী করা হলেও বিষয়টি সম্পর্কে তিনি ‘অবগত নন।’
জানুয়ারির শেষে বরিশাল থেকে ওই নোটিস পাওয়ার পর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। সে সময়ও ডা. ইকবালের বক্তব্য জানার জন্য তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের একজন প্রতিবেদক।
সাবেক সাংসদ ইকবাল তখন বলেছিলেন, “আমাদের ওয়ান-ইলেভেনের কেইস আজকে ১২ বছর হয়ে গেছে। এগুলো হাই কোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট থেকে কোয়াশ-আউট করে দিছে, আপনারা লোয়ার কোর্টের এটা সারা পৃথিবীতে জানায় রাখতেছেন।”
পেশাগত দায়িত্ব পালনে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের এই চাপের বিষয়গুলো সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরতে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি একটি সংবাদ সম্মেলন করেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদী।
সেখানে তিনি বলেন, প্রতিবেদনে কোথাও ভুল হলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম তা স্বীকার করব, সংশোধন করার প্রয়োজন হলে সাংবাদিকতার নিয়ম মেনে তাও করবে। কিন্তু চাপের কাছে নতি স্বীকার করে কোনো খবর তুলে নেওয়া হবে না।
“বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের নিজস্ব কোনো অনুসন্ধান এসব প্রতিবেদনে নেই; সম্পূর্ণভাবে মামলার কার্যক্রম ও আদালতের আদেশই সেখানে বস্তুনিষ্ঠভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। তাহলে কোন যুক্তিতে একটি সংবাদমাধ্যম এসব প্রতিবেদন সরিয়ে ফেলবে?”
“আমাদের বার বার বলা হয়েছে, অন্যরাও নাকি এ বিষয়ে তাদের প্রতিবেদন সরিয়ে ফেলেছে। বিভিন্নভাবে তদবির করানো হয়েছে প্রভাবশালীদের দিয়ে, যাদের মধ্যে গণমাধ্যম সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিও আছেন। বলা হয়েছে, তারা সরিয়ে ফেলেছেন, আমরা কেন তা করছি না। দীর্ঘদিন নানাভাবে চেষ্টার পরও প্রতিবেদন সরাতে রাজি করাতে না পেরে এখন তারা চাপ দেওয়ার অদ্ভুত এক কৌশল নিয়েছেন।”
পুরনো প্রতিবেদন মুছে ফেলার জন্য বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে এভাবে চাপ দেওয়ার বিষয়টিকে ‘অনৈতিক’ হিসেবে বর্ণনা করে ইতোমধ্যে নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে সারা দেশের সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন। চাপ প্রয়োগকারীদের চিহ্নিত করে ‘শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ারও’ দাবি জানিয়েছে তারা।