বরিশালের অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের বিচারক মো. মাসুম বিল্লাহ
রোববার এ আদেশ দেন বলে আদালতের নাজির কামরুল আহসান জানান।
তিনি বলেন, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদকসহ চার জনের বিরুদ্ধে
যে অভিযোগ করা হয়েছিল তা গ্রহণযোগ্য প্রতীয়মান না হওয়ার বিচারক খারিজ করে দিয়েছেন।”
ডা. এইচ বি এম ইকবাল এবং তার পরিবারের বিরুদ্ধে মামলা নিয়ে পুরনো প্রতিবেদন
মুছতে নানাভাবে চাপ দেওয়া হচ্ছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে।
অযৌক্তিক ওই চাপে নত না হওয়ায় গত ২৪ ফেব্রুয়ারি বরিশালের মুখ্য মহানগর
হাকিম আদালতে ২০০ কোটি টাকার ওই মানহানি মামলার আবেদন করেন কাজী নাসির উদ্দিন বাবুল
নামের এক ব্যক্তি, যিনি নিজেকে ডা. ইকবালের ‘বন্ধু’ হিসাবে পরিচয় দেন।
মামলার আর্জিতে বলা হয়, ডা. ইকবাল ও তার পরিবারের সদস্যরা
ওইসব মামলায় খালাস পেয়ে গেলেও মামলার কার্যক্রম নিয়ে ২০০৭, ২০০৮, ২০১০, ২০১৫ ও ২০১৭
সালে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে প্রকাশিত পুরনো প্রতিবেদনগুলো অনলাইনে থেকে যাওয়ায়
দেশ-বিদেশে ডা. ইকবাল ও তার পরিবারের ‘সম্মানহানি হচ্ছে’।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদী, হেড অব
ইংলিশ নিউজ অরুণ দেবনাথ, বার্তা সম্পাদক জাহিদুল কবির এবং বার্তা সম্পাদক মুনীরুল ইসলামকে
বিবাদী করা হয় ওই আর্জিতে।
জ্যেষ্ঠ মহানগর হাকিম পলি আফরোজ সে সময় মামলাটির গ্রহণযোগ্যতার শুনানির
জন্য প্রথমে ২৫ ফেব্রুয়ারি এবং পরে ১০ মার্চ দিন রাখেন। এরপর ১০ মার্চ বিষয়টি অতিরিক্ত
মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে স্থানান্তরিত হয় এবং রোববার সেখানেই তা খারিজ হয়ে গেল।
প্রতিবেদন মুছতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরকে চাপ: ‘মানহানির’ অভিযোগের বিষয়ে আদেশ পেছাল
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরের প্রতিবেদন মুছতে চাপের পর এবার মামলার আবেদন
এইচ বি এম ইকবাল: এক যুগ আগের রায়ের খবর নিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরকে উকিল নোটিস
মামলার আবেদন কেন?
প্রিমিয়ার গ্রুপ অব কোম্পানিজের চেয়ারম্যান সাবেক এমপি বীর
মুক্তিযোদ্ধা ডা. এইচ বি এম ইকবাল এবং তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে গত দেড় দশকে
বিভিন্ন সময়ে যেসব মামলা হয়েছে, তার কার্যক্রম আর আদালতের আদেশ নিয়ে অন্য সব সংবাদমাধ্যমের
মত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমেও প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। সেসব মামলা থেকে তারা অব্যাহতিও
পেয়েছেন।
কিন্ত সেসব প্রতিবেদন ‘মিথ্যা ও ভিত্তিহীন’ দাবি করে কাজী নাসির উদ্দিন বাবুল গত
জানুয়ারির শেষে তার
আইনজীবী অ্যাডভোকেট আতিকুর রহমান জুয়েলের মাধ্যমে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের চার
জ্যেষ্ঠ সম্পাদকের নামে উকিল নোটিস পাঠান।
ওইসব প্রতিবেদনের তারিখ উল্লেখ করে সেগুলো মুছে
ফেলার (ডিলিট) দাবি তোলা হয় নোটিসে। তা না হলে ২০১৮ সালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে
এবং মানহানির অভিযোগে মামলা করার হুমকি দেওয়া হয়।
সেসব সংবাদ যে ‘বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়’ প্রকাশিত
হয়েছে, সে কথা উল্লেখ করা হলেও নোটিসে আবার অভিযোগ করা হয়, “উক্ত মিথ্যা সংবাদ
পরিবেশনে একমাত্র উদ্দেশ্যেই হল নোটিশ দাতার বন্ধু ডা. এইচ বি এম ইকবাল এবং তাহার
পরিবারের সম্মান হানী করা।”
নোটিস পাওয়ার পর ২ ফেব্রুয়ারি একটি প্রতিবেদন
প্রকাশ করে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। সাংবাদিকতার নিয়ম অনুযায়ী নোটিসদাতা
আইনজীবী এবং ডা. এইচ বি এম ইকবালের সঙ্গে সে সময় কথাও বলা হয়।
আইনজীবী জুয়েল সে সময় বলেছিলেন, নোটিসদাতা কাজী
নাসির উদ্দিন বাবুল বরিশালের একজন ‘প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী, আজকের বার্তা পত্রিকার
মালিক ও সম্পাদক’।
দেশের মূলধারার সব গণমাধ্যমে যেহেতু ওইসব মামলা
নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, সবাইকে উকিল নোটিস পাঠানো হয়েছে কি-না জানতে চাইলে
জুয়েল বলেন, “হয়ত করবে। অন্যান্য জায়গায় যেগুলো হয়েছে করবে। অন্যগুলো এখন হয়েছে
কি-না ইনফর্ম করতে পারব না।”
আর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রশ্নের উত্তরে
সাবেক সাংসদ ইকবাল তখন বলেছিলেন, “আমাদের ওয়ান-ইলেভেনের কেইস আজকে ১২ বছর হয়ে গেছে।
এগুলো হাই কোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট থেকে কোয়াশ-আউট করে দিছে, আপনারা লোয়ার কোর্টের
এটা সারা পৃথিবীতে জানায় রাখতেছেন।”
ওই প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর বিভিন্ন জেলা
থেকে নতুন নতুন উকিল নোটিস আসা শুরু হয়। দুই ডজন জেলা থেকে তিন ডজনের বেশি নোটিস
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ঠিকানায় পৌঁছায়।
ভিন্ন ভিন্ন নামে পাঠানো হলেও সবগুলো নোটিসের
ভাষা, বক্তব্য ও দাবি একই রকম। এর মধ্যে কয়েকটি নোটিসে হুমকির সুরে বলা হয়, “আপনারা আপনাদের প্রকাশিত
সংবাদের ব্যাপারে ভুল স্বীকার পূর্বক বিজ্ঞপ্তি প্রদান করিবেন। অন্যথায় বিরূপ পরিণতির
জন্য আপনারা দায়ী থাকিবেন।”
‘না জানিয়েই’ নাম দিয়েছে, বললেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরের বিরুদ্ধে মামলার ‘সাক্ষী’
প্রতিবেদন মুছতে চাপ: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরকে সেই উকিল নোটিস কে পাঠাল?
উকিল নোটিস পাওয়ার পর তার জবাব দেওয়ার প্রক্রিয়া
শুরু করে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। প্রথমে বরিশাল থেকে কাজী নাসির উদ্দিন
বাবুলের আইনজীবী জুয়েলের পাঠানো নোটিসের জবাব দেওয়া হয় আইনজীবীর মাধ্যমে।
এরপর আইনজীবী জুয়েলের পাঠানো আরেকটি নোটিস ২৪
ফেব্রুয়ারি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কার্যালয়ে পৌঁছায়, যেখানে ১৮ ফেব্রুয়ারির
তারিখ দেওয়া ছিল।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের পক্ষ থেকে জবাব
পাওয়ার বিষয়টি জানিয়ে সেখানে বলা হয়, তিন দিনের মধ্যে ওই প্রতিবেদনগুলো প্রত্যাহার
করে ‘ক্ষমা’ না চাইলে মামলা করা হবে।
দ্বিতীয় ওই নোটিস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
যেদিন হাতে পায়, সেদিনই বরিশালের আদালতে মামলার আবেদন করেন ডা. ইকবালের বন্ধু
হিসেবে পরিচয়দাতা কাজী নাসির উদ্দিন বাবুল।
এদিকে মামলার আর্জিতে ‘সাক্ষী’ হিসেবে যাদের নাম উল্লেখ
করা হয়েছিল, সেখানে নিজের নাম দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেন স্থানীয় একজন সাংবাদিক। ফেইসবুক
পোস্ট দিয়ে রুবেল খান নামের ওই সাংবাদিক বলেন, তাকে সাক্ষী করা হলেও বিষয়টি সম্পর্কে
তিনি ‘অবগত নন।’
আর দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে যেসব উকিল নোটিস বিডিনিউজ
টোয়েন্টিফোর ডটকমে পাঠানো হয়েছে, তার মধ্যে একটিতে সিলেট জেলা বারের আইনজীবী মো. মোয়াজ্জেম
হোসেন চৌধুরীর নাম থাকলেও তিনি গত ৭ মার্চ
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে চিঠি দিয়ে জানান, ওই নোটিস তিনি পাঠাননি। কেউ একজন তার নাম ব্যববহার করে ওই ভুয়া নোটিস পাঠিয়েছে বলে
তিনি ধারণা করছেন।
সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধের চেষ্টা: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরের বিবৃতি
চাপে নত হব না: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরের প্রধান সম্পাদক
‘অনৈতিক চাপ’
পেশাগত দায়িত্ব পালনে প্রভাবশালী
ব্যক্তিদের এই চাপের বিষয়গুলো সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরতে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি একটি
সংবাদ সম্মেলন করেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ
খালিদী।
সেখানে তিনি বলেন, প্রতিবেদনে কোথাও
ভুল হলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম তা স্বীকার করব, সংশোধন করার প্রয়োজন হলে
সাংবাদিকতার নিয়ম মেনে তাও করবে। কিন্তু চাপের কাছে নতি স্বীকার করে কোনো খবর তুলে
নেওয়া হবে না।
“বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের নিজস্ব
কোনো অনুসন্ধান এসব প্রতিবেদনে নেই; সম্পূর্ণভাবে মামলার কার্যক্রম ও আদালতের
আদেশই সেখানে বস্তুনিষ্ঠভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। তাহলে কোন যুক্তিতে একটি
সংবাদমাধ্যম এসব প্রতিবেদন সরিয়ে ফেলবে?”
“আমাদের বার বার বলা হয়েছে, অন্যরাও
নাকি এ বিষয়ে তাদের প্রতিবেদন সরিয়ে ফেলেছে। বিভিন্নভাবে তদবির করানো হয়েছে
প্রভাবশালীদের দিয়ে, যাদের মধ্যে গণমাধ্যম সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিও আছেন। বলা হয়েছে,
তারা সরিয়ে ফেলেছেন, আমরা কেন তা করছি না। দীর্ঘদিন নানাভাবে চেষ্টার পরও
প্রতিবেদন সরাতে রাজি করাতে না পেরে এখন তারা চাপ দেওয়ার অদ্ভুত এক কৌশল নিয়েছেন।”
পুরনো প্রতিবেদন মুছে ফেলার জন্য
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে এভাবে চাপ দেওয়ার বিষয়টিকে ‘অনৈতিক’ হিসেবে বর্ণনা
করে ইতোমধ্যে নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে সারা দেশের সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন।
চাপ প্রয়োগকারীদের চিহ্নিত করে ‘শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ারও’ দাবি জানিয়েছে তারা।