ক্যাটাগরি

এক ঝড়ে দিকহারা পাঁচ নাবিকের জীবন

ঝড়ের কবলে পড়া জাহাজ থেকে উদ্ধারের পর এক বন্দরে ঠাঁই, তারপর হুতি বিদ্রোহীদের হাতে বন্দিত্বের ১১ মাস। মৃত্যু শঙ্কা নিয়ে তখনকার প্রতিদিন দিন কেটেছে। নানা ঘটনা পেরিয়ে অবশেষে মুক্তিও মিলেছে। দেশেও ফিরেছেন।

কিন্তু এখন জীবন-জীবিকার অনিশ্চয়তা আরেক ঝড়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে নাবিক মো. আলাউদ্দিন, মোহাম্মদ আলমগীর হোসেন, রহিম উদ্দিন, মোহাম্মদ ইউসুফ ও আবু তৈয়বকে।

তাদের মধ্যে আলাউদ্দিন ও আলমগীরের বাড়ি চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার পশ্চিম ইছাখালী ইউনিয়নে, রহিম উদ্দিন ও ইউসুফের বাড়ি পূর্ব দুর্গাপুর ইউনিয়নে। আবু তৈয়বের বাড়ি রাউজান উপজেলার গহিরায়।

গত শনিবার মিরসরাইতে মো. আলাউদ্দিন, রহিম উদ্দিন, মোহাম্মদ ইউসুফের সঙ্গে কথা হয় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।  জিম্মি দশার সে ‘ভয়ংকর স্মৃতি’ তুলে ধরে তারা জানিয়েছেন, কখনও ভাবেননি তারা ফিরে আসতে পারবেন স্বজনদের কাছে।

মাসিরা দ্বীপ থেকে আস-সালিফ বন্দরে

ঘটনার সূত্রপাত বাংলাদেশ থেকে সোয়া তিন হাজার কিলোমিটার দূরবর্তী আরব সাগরের মাসিরা দ্বীপে।

সেখানকার ‘আইল্যান্ড ব্রিজ ট্রেডিং অ্যান্ড ট্রান্সপোর্ট কন্টেইনার’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের জাহাজে কর্মরত ছিলেন এই বাংলাদেশিরা। সৌদি আরবের একটি প্রতিষ্ঠান নির্মাণ কাজের জন্য তাদের প্রতিষ্ঠানের তিনটি জাহাজ ভাড়া নেয়।

২০২০ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি তাই মাসিরা দ্বীপ থেকে ‘ডানা-৬’, ‘ফরিদা’ ও ‘আল রাহিয়া’ নামে তিনটি জাহাজে ২০ জন নাবিক রওনা হয় সৌদি আরবের ইয়ানবু বন্দরের উদ্দেশ্যে।  

রহিম উদ্দিন

রহিম উদ্দিন

দুই দিন চলার পর জাহাজ যখন গালফ অব এডেন পেরিয়ে লোহিত সাগরে, তখন এক প্রচণ্ড ঝড় পরে ডুবে যায় ‘ডানা-৬’ জাহাজ।

ওই জাহাজে ছিলেন আলাউদ্দিন ও আলমগীরসহ মোট ছয়জন। তাদের মধ্যে আলাউদ্দিন ওই জাহাজের ক্যাপ্টেনের সহকারী ও আলমগীর ছিলেন ইঞ্জিন মেকানিক।

আলাউদ্দিন বলেন, জাহাজ থেকে ওয়াকিটকি দিয়ে খবর দেওয়ার পর ‘ফরিদা’ ও ‘আল রাহিয়া’ তাদের উদ্ধার করে।

ঝড়ের কারণে আর এগোতে না পেরে তারা পশ্চিম ইয়েমেনের আস-সালিফ বন্দরে নোঙর করতে সহায়তা চান।

“তারা আমাদের নোঙর করার অনুমতি দেওয়ার পর দুইটি জাহাজ নিয়ে বন্দরে প্রবেশ করছিলাম। এসময় স্পিড বোটে এসে কয়েকজন আমাদের জাহাজ লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। তারপর জাহাজে উঠে আমাদের জিম্মি করে সবার পাসপোর্ট, মোবাইলসহ সব কাগজপত্র নিয়ে নেয়। পরে জানতে পারি তারা হুতি বিদ্রোহী। মুক্তিপণ আদায়ের জন্য আমাদের তারা জিম্মি করেছে।”

জিম্মি ২০ নাবিকের মধ্যে পাঁচ বাংলাদেশি ছাড়াও ছিলেন ১৪ জন ভারতীয় এবং একজন মিশরীয় নাগরিক।

ইয়েমেনের ওই অংশটি হুতি বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে। ২০১৪ সালে সানা শহরের নিয়ন্ত্রণ নেয় তারা।

আলাউদ্দিন বলেন, “দুইদিন জাহাজে রাখার পর আমাদের জিজ্ঞাসাবাদের কথা বলে নামিয়ে আনা হয় বন্দরে। ১৭ কিংবা ১৮ ফেব্রুয়ারি সেখানে কয়েকশ হুতি আমাদের অস্ত্রের মুখে দুইটি মাইক্রোতে তুলে নিয়ে যায়। প্রায় সাত ঘণ্টা গাড়ি চলার পর পৌঁছাই সানা সিটির একটি হোটেলে।”

হোটেলের আন্ডারগ্রাউন্ডে ১০ মাস

জিম্মি তিন নাবিক জানান, হোটেলে দু’দিন ভালোভাবে রাখার পর তাদের নিয়ে যাওয়া হয় হোটেলের আন্ডারগ্রাউন্ডে। যেখানে তারা কাটিয়েছেন প্রায় ১০ মাস।

বাংলাদেশ থেকে চার হাজার নয়শ কিলোমিটার দূরে সানা সিটির সেই হোটেলে কেমন কেটেছে তাদের দিন-রাত?

সারাদিনে খাবার জুটত শুধু এক বেলা, তাও দুপুরে কেবল ডাল আর ভাত।

ভূ-গর্ভস্থ সেই ঘরে থাকতে থাকতে ইউসুফসহ জিম্মিদের অনেকই অসুস্থ হয়ে পড়েন। এ নিয়ে কথা বললেই বিদ্রোহীরা তাদের মারধর করতে চাইত এবং বেশি কথা বললে মেরে লাশ সমুদ্রে ভাসিয়ে দেওয়ারও হুমকি দিত। তাদের পাহারায় থাকা হুতিদের বয়স ছিল ১২ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে।   

মোহাম্মদ ইউসুফ

মোহাম্মদ ইউসুফ

ইউসুফ বলেন, “সহকর্মীরা অনেক অনুনয় করার পর আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে নেওয়ার পর হয় আরেক অভিজ্ঞতা।

“হাসপাতালে ভর্তির পর রক্ত পরীক্ষার নামে আমার কাছ থেকে এক ব্যাগ রক্ত নিয়ে নেওয়া হয়। আরেক ব্যাগ নেওয়ার সময় সঙ্গে যাওয়া এক ভারতীয় সহকর্মী বাধা দেয়। এরপর থেকে অন্যরা অসুস্থ হলেও ভয়ে আর হাসপাতালে যেত না কেউ।”

আলাউদ্দিন বলেন, “জিম্মি অবস্থায় থাকার সময় আমরা জানতাম না কখন মুক্ত হতে পারব। আমরা কোনো আশ্বাস পাচ্ছিলাম না। সব সময় আতঙ্কে কাটত আমাদের দিন। রাত হলেই গুলি বোমার শব্দে কেঁপে উঠত হোটেলের প্রাচীর। সারাক্ষণ ভয়ে থাকতাম, কখন যে বোমা এসে পড়ে হোটেলে।

“তার মধ্যেও আমরা ভালো থাকার অভিনয় করতাম পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে। তাদের সঙ্গে যোগাযোগের সময় বারবার বলতাম আমরা ভালো আছি।”

মুক্ত তিন নাবিক জানান, তাদের কাছ থেকে মালিকের নম্বর নেওয়ার পর প্রথম তিন মাস কারও সঙ্গে তাদের যোগাযোগ করতে দেওয়া হয়নি।

“তিন মাস পর সপ্তাহে একদিন ৩০ মিনিটের জন্য তাদের হাতে মোবাইল দেওয়া হতো। আর জুলাই মাসের শেষে আমাদের মোবাইল ফেরত দেওয়া হয়।”

মো. আলাউদ্দিন

মো. আলাউদ্দিন

আলাউদ্দিন বলেন, “মোবাইলে মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি কয়েকবার। তিনি শুধু বলতেন, ‘মোবাইলে কিছু বলব না, আমি চেষ্টা করছি’। পাশাপাশি তিনি নিজ দেশের দূতাবাসের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দিতেন।”

আলাউদ্দিন বলেন, “আমাদের সহকর্মী আবু তাহেরের এক ভাইও ওমান থাকতেন। তিনি চট্টগ্রামের প্রবাসী ব্যবসায়ী ইয়াছিন আলীর সঙ্গে কথা বলেন। ইয়াছিন আলী ওমান দূতাবাসে কথা বলেছিলেন বলে শুনেছি। পাশাপাশি তিনি আমাদের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের নাম্বার দেন।

“বিভিন্ন সময়ে আমি তাকে হোয়াটস আপে মেসেজ দিয়েছি। নভেম্বরের শেষ দিকে মুক্তি পাওয়ার দুই দিন আগে মন্ত্রী আমাদের মুক্তি পাওয়ার কথা জানান।”

তারা জানান, ২৮ নভেম্বর ইয়েমেনের ভারতীয় দূতাবাসের কর্মকর্তারা তাদের ২০ জনকে উদ্ধার করে আরেকটি হোটেলে নিয়ে যায়। সেখান থেকে ৩ ডিসেম্বর এডেন শহরে নিয়ে যাওয়া হয়। দুইদিন পর ভারতীয় নাবিকদের তাদের দেশে নিয়ে যাওয়া হলে তারা চলে যান আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) অধীনে। আইওএমর মাধ্যমে ১০ জানুয়ারি তারা দুবাই হয়ে বাংলাদেশে ফেরত আসেন।

দেশে ফিরে অনিশ্চিত জীবন

রহিম উদ্দিন বলেন, “২০১২ সালের শুরুতেই ওমানে চলে যাই। যে প্রতিষ্ঠানের অধীনে কাজ করতাম; থাকা-খাওয়া সব ছিল তাদের। তাই বেতনের টাকা পুরোটাই হাতে থাকত। সেই টাকা বাড়িতে পাঠিয়ে দিতাম।

“গত এক বছর ধরে এক টাকাও আয় নেই। সঞ্চয়ের টাকাও শেষ। নতুন করে যে পাসপোর্ট করব সে টাকাও আমাদের হাতে নেই। প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম তারাও কিছু বলছে না। কিছুদিন পর আমাদের অবস্থা হবে নুন আনতে পান্তা ফুরানোর মতো।”

একই অবস্থা অন্যদেরও। তাদের অভিযোগ, জিম্মিদশার ১১ মাসের পাশাপাশি তাদের আরও কয়েক মাস করে বেতন বকেয়া আছে তাদের প্রতিষ্ঠানের কাছে। এজন্য টাকা পাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে সরকারের কাছে আবেদনও করেছেন তারা।

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম জেলা জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর উপ-পরিচালক জহিরুল আলম মজুমদার বলেন, “তারা আমাদের কাছে আবেদন করেছে বিশেষ পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে। আমরা বিভিন্ন জনের সঙ্গে যোগাযোগ করছি। প্রধান কার্যালয়েও চিঠি লিখেছি দূতাবাসের মাধ্যমে তাদের বকেয়া টাকা নিয়ে দেওয়ার জন্য।”