বর্তমানে অডিও-নির্ভর ক্লাবহাউস অ্যাপের বিভিন্ন ভার্চুয়াল কক্ষে জড়ো হচ্ছেন মানুষ। এ রকম অনেক কক্ষে চলছে অদ্ভুত শব্দ এবং আওয়াজ তোলার চেষ্টা। অনেক কক্ষে চলছে আলোচনা, অনেকেই আবার ধ্যানে বসেছেন ভার্চুয়াল কক্ষে, কয়েকজন মিলে করছেন মেডিটেশন।
অন্যদিকে, অনেকটা বদলে গিয়েছে গেইমিং প্ল্যাটফর্ম ডিসকর্ডের ব্যবহার। নিজ ব্যবহারকারীদের জন্য নতুন সার্ভার নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। শত শত ব্যবহারকারীর ওই সার্ভার ব্যবহার করে একে অন্যকে ইংরেজি অক্ষর ‘এইচ’ পাঠাচ্ছেন প্রতিদিন।
এ সপ্তাহে খোলা নতুন এক টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে টুইট করা হয়েছিল ছোট এক ভিডিও ক্লিপ। ওই ক্লিপটি দেখাচ্ছে – গাড়িতে বসে বিভিন্ন বিরহের গান শুনে কাঁদছেন টনি সোপ্রানো। নেটিজেনরা মোটেও মুখ ফিরিয়ে নেননি অ্যাকাউন্টটি থেকে। রাতারাতি অ্যাকাউন্টটি পেয়েছে হাজারো অনুসারী।
অনলাইন দুনিয়া পাল্টে যাওয়ায় আগের সমস্যাগুলো কিন্তু থেমে যায়নি। উল্টো ক্ষেত্রবিশেষে আরও অনেক বেড়েছে। মার্কিন নির্বাচন, বর্ণবাদ, টিকা ইত্যাদি প্রশ্নে পক্ষে-বিপক্ষে রয়েছেন অনেক মানুষ। কিছুদিন পরপরই সবার সামনে চলে আসছে ইন্টারনেট বিশ্বের অন্ধকার অংশটি – সেখানে হয়রানির শিকার হচ্ছেন নারী, বিভিন্ন বর্ণের মানুষ, এলজিবিটিকিউ কমিউনিটি’র লোকজন।
অনেকে আবার বিরক্তি, ভয়, উদ্বেগ থেকে মহামারীর এ সময়টিতে ষড়যন্ত্র তত্ত্বের আখড়া কিউঅ্যাননে যোগ দিয়েছেন। অনেকেই আবার বিশ্বাস করছেন, ভিত্তিহীন টিকা বিরোধী ষড়যন্ত্র তত্ত্বে।
মানুষ মজা, সৃজনশীলতা এবং হাসি-ঠাট্টার পেছনেও অনেক সময় ব্যয় করছেন। এখানেও চোখে পড়ছে অনলাইনের উপর তাদের নির্ভরশীলতার বিষয়টি। এ প্রসঙ্গে মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন এক প্রতিবেদনে মন্তব্য করেছে, আমাদের অন্যের সঙ্গে সংযুক্ত থাকার প্রয়োজনীয়তা এবং এই অশান্ত সময় থেকে পালিয়ে বেড়ানোর স্বাক্ষ্য দিচ্ছে এটি।
ইউনিভার্সিটি অফ বাফেলোর মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক শিরা গ্যাব্রিয়েল বলছেন, “এটি ইতিবাচকতার ও নিজেকে সুস্থ্য রাখার শর্তে মানুষের অসাধারণ নমনীয়তা এবং স্বাভাবিকের দিকে ফিরে আসার, এবং অন্যের সঙ্গে সংযুক্ত থাকার লক্ষণ।”
“গত বছরটি অত্যন্ত হতাশাজনক এবং কঠিন ছিল মানুষের জন্য। কিন্তু মানুষ এই কঠিন সময়ের সর্বোচ্চটা করতে যা যা করেছে তা দেখা আমার জন্য অনুপ্রেরণারও ছিল।” – বলেছেন গ্যাব্রিয়েল।
সিএনএন বলছে, অনলাইন কমিউনিটিতে এরকম রঙিন উদাহরণের কোনো অভাব নেই। মহামারীর সময়টিতে একে অন্যের সঙ্গে সময় কাটাতে ডিসকর্ড ব্যবহার করেছে জেন জি বা প্রজন্ম জেড। ১৯৯৬ থেকে ২০০০ এর দশকের মধ্যবর্তী সময়ে জন্মগ্রহণকারীদের এ প্রজন্মের দলভুক্ত ধরা হয়।
এখন ‘চিলডকাউ’ নামে গোটা একটি সার্ভারই রয়েছে তাদের। ওই সার্ভারে আবহ সঙ্গীত শুনে শুনে পড়ালেখা করে, আলোচনা করে, এমনকি ছবিও আঁকে প্রজন্মটি।
গত মে মাসে তৈরি হওয়ার পর থেকে লাখো সদস্য পেয়েছে চিলডকাউ সার্ভারটি। বর্তমানে এর সদস্য সংখ্যা চার লাখ ৭০ হাজারেরও বেশি। সার্ভারটির জনপ্রিয় একটি ইউটিউব চ্যানেলও রয়েছে।
এরকমই আরেকটি সার্ভারের নাম ‘ওয়াফেল হাউস’। বর্তমানে ওয়াফেল হাউসের সদস্য সংখ্যা দেড় হাজারের বেশি। ভার্চুয়াল ক্যাফে পরিবেশে নতুন বন্ধুদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কাজে করছে এটি।
মানুষ এখন এনএফটি শিল্পকর্মের পেছনে কোটি কোটি ডলার খরচ করছে, টুইটারের প্রথম টুইট কিনতে অংশ নিচ্ছে নিলামে। রেডিটের সাব রেডিট ‘ওয়ালস্ট্রিট বেটস’ তো গড়ে দিয়েছে নতুন আরেক ইতিহাস। গেইমস্টপ নামের এক প্রতিষ্ঠানের শেয়ার দর বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণে।
এখন অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিই নড়েচড়ে বসেছেন ব্যাপারটি নিয়ে। এনএফটি, গেইমস্টপ – ইত্যাদি নিয়ে সমালোচনাও হচ্ছে, আবার পক্ষেও আলোচনা চলছে।
এতো ডামাডোলের মধ্যে ক্রিপ্টোকারেন্সির গতিও থেমে নেই। বিটকয়েন তো বটেই, মিম-অনুপ্রাণিত ডোজকয়েনেরও মূল্য বাড়ছে।
সামাজিক মাধ্যমে মানুষ কখনও কোন এলাকার খাবার ভালো তা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে, আবার কখনও কখনও সয়লাব করে ফেলছে সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্সের মাস্ক পরে বসে থাকা ছবি নিয়ে। নানা পোস্টের মাধ্যমে প্রতিবাদও ছড়িয়ে পড়ছে সামাজিক মাধ্যমে।
নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির মিডিয়া, কালচার অ্যান্ড কমিউনিকেশনের ক্লিনিকাল সহকারী অধ্যাপক ইসরা আলি বলছেন, মার্কিনীরা গত বছর “প্রচুর তথ্য” হাতে পেয়েছেন এবং কোভিড-১৯ থেকে শুরু করে ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলন, মার্কিন নির্বাচনকে ঘিরে অস্থিরতা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে গিয়েছেন।
“এর সবগুলোই আমাদেরকে সত্যিকার অর্থেই গভীরভাবে সতর্ক হতে বাধ্য করেছে এবং চিন্তা করতে শিখিয়েছে আমরা আসলে সবসময় কে, একের সঙ্গে অন্যের সম্পর্ক-ই বা কী আমাদের?” – বলেছেন আলি।
এক অর্থে আসলে একই হিসেব খাটে গোটা বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের মানুষদের বেলায়ও। এজন্যই হয়তো অনলাইনে “নির্বোধ” মুহূর্তের ছাপ রেখে যাচ্ছেন মানুষ, যেমন একত্রে একটি ভার্চুয়াল স্থানে গিয়ে সহজ বা বোকামোর মতো কিছু একটা করছেন। হয়তো সবাই মিলে আওয়াজ করছেন কোনো কারণ ছাড়াই।
আলি বলছেন, “কোনো অনলাইন পরিবেশে শুধু একত্রে বসে থাকা এবং কোনো কিছু চিন্তা করতে না হওয়াটাই একটি স্বস্তিদায়ক সময়।”
হালকা কোনোকিছুর খোঁজে মানুষ পাড়ি জমিয়েছেন অনলাইনের নানা কোণে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, টিকটক হুট করে চলে মূলধারায় চলে এসেছে। কোটি কোটি মানুষ প্ল্যাটফর্মটিতে যোগ দিয়েছেন বিশ্বের দৈনন্দিন মন খারাপ করা খবরের হাত থেকে রেহাই পেতে।
টিকটকে সময় কাটানো মানুষেরা নিজেরাই নিজেদের জনপ্রিয় ট্রেন্ড তৈরি করে নিয়েছেন। আর তাই তৈরি হয়েছে অসংখ্য নাচের ভিডিও থেকে শুরু করে কমেডি ধাঁচের নানা ভিডিও।
এই হট্টগোলে যেন খেই হারিয়ে ফেলেছে প্ল্যাটফর্মটির গোপন অ্যালগরিদমও। খুব অল্প অনুসারী থাকা অ্যাকাউন্টও রাতারাতি ভাইরাল হয়ে যাচ্ছে। সিএনএন বলছে, এর আগে কখনও এতো সহজে আমাদের সৃজনশীলতা – এবং আমাদের মানবতা ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হয়নি।
গ্যাব্রিয়েল এ প্রসঙ্গে বলেছেন, “আমরা আসলে সংযোগ ও কমিউনিটি খুঁজছি।”
“যদি সবাই মজার নাচের [টিকটক] ভিডিও, মজার ধারণা পোস্ট করে, আর আপনি যদি এতে যোগ দিতে পারেন, তাহলে আপনিও যোগ দিচ্ছেন তাদের সঙ্গে এবং নিজের চেয়েও বড় কিছুর অংশ হয়ে উঠছেন।”