দুদক তাদের গ্রেপ্তারের পদক্ষেপ না নিলে আদালত এ বিষয়ে আদেশ দিতে বাধ্য হবে বলে জানিয়ে দিয়েছে বিচারপতি নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি মহি উদ্দিন শামীমের ভার্চুয়াল হাই কোর্ট বেঞ্চ।
সোমবার এ বিষয়ে শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক। দুদকের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান। ব্যাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী তানজীব-উল আলম ও খান মোহাম্মদ শামীম আজিজ।
শুনানির এক পর্যায়ে বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক নজরুল ইসলাম তালুকদার দুদকের আইনজীবীর কাছে জানতে চান, পি কে হালদারের অর্থ আত্মসাত এবং পাচারের মামলায় গ্রেপ্তার যারা ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন এবং সেই জবানবন্দিতে যাদের নাম উঠে এসেছে, তাদের বিষয়ে দুদকের কী পদক্ষেপ নিয়েছে।
জবাবে দুদকের আইনজীবী বলেন, জবানবন্দিতে যাদের নাম এসেছে, তাদের কাউকে কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, কেউ কেউ পলাতক।
বিচারপতি নজরুল ইসলাম তালুকদার তখন বলেন, “এস কে সুর ও শাহ আলমের নাম বিভিন্ন মাধ্যমে আসছে। তাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না কেন?”
দুদকের আইনজীবী তখন বলেন, কমিশনের চিঠির ভিত্তিতেই বাংলাদেশ ব্যাংকের বাংলাদেশ ফাইনানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) তাদের ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করেছে।
বিচারক তখন দুদকের আইনজীবীর কাছে প্রশ্ন রাখেন- “গ্রেপ্তার করছেন না কেন? আপনারা পদক্ষেপ না নিলে আদেশ দিতে বাধ্য হব। আগে তাদের ধরেন। কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে মেহমানদারী করতে পারেন না। তাদের অবশ্যই কারাগারে নিতে হবে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মো. শাহ আলমের
পলাতক প্রশান্ত কুমার হালদারের ওরফে পিকে হালদারের দুই সহযোগী ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রাশেদুল হক ও পিপলস লিজিংয়ের সাবেক চেয়ারম্যান উজ্জ্বল কুমার নন্দী আদালতে যে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন, সেখানে এস কে সুর ও শাহ আলমের নাম আসে।
পিপলস লিজিংয়ের অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত আমানতকারীরাও বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই দুই সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল তুলে আসছেন। ক্ষতিগ্রস্ত পাঁচ আমানতকারীর আবেদনে হাই কোর্ট গত ৫ জানুয়ারি ২৫ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করে, যাদের মধ্যে এস কে সুর চৌধুরীর নামও ছিল।
অভিযোগ ওঠার পর গত ৪ ফেব্রুয়ারি নির্বাহী পরিচালক মো. শাহ আলমকে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তবে তিনি অন্য বিভাগের দায়িত্ব পালন করছেন।
আর এস কে সুর চৌধুরী ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে ডেপুটি গভর্নরের পদ থেকে অবসরে যাওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তিনি অবসরে রয়েছেন।
পিকে হালদার নানা কৌশলে নামে-বেনামে অসংখ্য কোম্পানি খুলে শেয়ারবাজার থেকে বিপুল পরিমাণ শেয়ার কেনেন এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ও পরে নিজের আত্মীয়, বন্ধু ও সাবেক সহকর্মীসহ বিভিন্ন ব্যক্তিকে পর্ষদে বসিয়ে চারটি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নেন।
এসব কোম্পানি থেকে তিনি ঋণের নামে বিপুল অংকের টাকা সরিয়ে বিদেশে পাচার করেছেন এবং এ কাজে বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু কর্মকর্তার ‘যোগসাজশ’ ছিল বলে তদন্তকারীদের ভাষ্য।
বিদেশে পালিয়ে থাকা পি কে হালদারকে গ্রেপ্তারে ইতোমধ্যে ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিস জারি করা হয়েছে। ভুয়া ও কাগুজে পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের নামে ৩৫১ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন ও আত্মসাতের অভিযোগে পি কে হালদারসহ ৩৩ জনের বিরুদ্ধে পাঁচটি মামলা করেছে দুদক।
পি কে হালদারসহ ৩৩ জনের বিরুদ্ধে পাঁচ মামলা
পি কে হালদারের মাসহ ২৫ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা
দুই প্রতিবেদন
পিকে হালদারের পালিয়ে যাওয়া এবং বিভিন্ন আর্থিক কেলেঙ্কারির সঙ্গে সম্পৃক্ত বাংলাদেশে ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিষয়ে এদিন আদালতে দুটি প্রতিবেদন দেয় পুলিশ ও বাংলাদেশ ব্যাংক।
পিকে হালদার পালিয়ে যাওয়ার সময় বেনাপোল ও শাহজালার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন পুলিশের কতজন দায়িত্বে ছিলেন, কারা কারা দায়িত্বে ছিলেন, তাদের ভূমিকা কী ছিল, পুলিশের প্রতিবেদনে সেই তথ্য এসেছে।
পাসপোর্ট জব্দে হাই কোর্টের নির্দেশ থাকার পরও পি কে হালদার কীভাবে দেশ থেকে পালিয়েছে, তা জানতে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি এ আদেশ দিয়েছিল হাই কোর্ট।
ইমিগ্রেশন পুলিশ প্রতিবেদনে কী জানিয়েছে প্রশ্ন করলে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মানিক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “২০১৯ সালের ২৩ অক্টোবর বিকেল পৌনে ৪টায় যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে তিনি (পি কে হালদার) দেশ ত্যাগ করেন। সেদিন ইমিগ্রেশন পুলিশের ৫৯ জন সদস্য বেনাপোল স্থলবন্দরে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।”
পিকে হালদার পালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তাদের ব্যর্থতা ছিল কিনা, প্রতিবেদনে সে বিষয়ে কী বলা হয়েছে জানতে চাইলে এই আইন কর্মকর্তা বলেন, “এ বিষয়ে ইমিগ্রেশন পুলিশের কোনো ব্যর্থতা বা গাফিলতি ছিল না। পিকে হালদারের পালিয়ে যাওয়া সংক্রান্ত দুদকের চিঠি তারা পেয়েছে সে পালিয়ে যাওয়ার পরে।”
ডিএজি মানিক বলেন, পি কে হালদার যাতে দেশত্যাগ করতে না পরে সেজন্য ২০১৯ সালের ২২ অক্টোবর পুলিশের বিশেষ শাখায় (এসবি) চিঠি দেয় অক্টোবর দুদক। ডাকযোগে পাঠানো সেই চিঠি এসবি পায় ২৩ অক্টোবর বিকেল সাড়ে ৪টায়। পরে এসবি সে চিঠি দেশের সব স্থলবন্দর ও বিমানবন্দরে দায়িত্বপালনকারী ইমিগ্রেশন ইউনিটকে পাঠায়। ইমিগ্রেশন ইউনিট ওইদিন পৌনে ৬টায় চিঠি পায়। কিন্তু তার ঘণ্টা দুই আগে বিকেল ৩টা ৩৮ মিনিটে বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে পি কে হালদার দেশ ছেড়ে যান।
“প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চিঠি পাঠানোর আগে দুদক যদি ২৩ অক্টোবর সকালে টেলিফোনে ইমিগ্রেশন পুলিশকে বিষয়টি অবহিত করত, তাহলে পিকে হালদারের পালানোর পথ হয়ত বন্ধ করা যেত।”
তবে দুদকের আইনজীবী শুনানিতে দাবি করেন, এক্ষেত্রে কমিশনের কোনো গাফিলতি ছিল না।
আইনজীবী খুরশীদ আলম খান পরে সাংবাদিকদের বলেন, “দুদকের লিখিত কপিটা অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক রিসিভ করেছেন ২০১৯ সালের ২৩ অক্টোবর সকাল ১০টা ৩০ মিনিটে। সেটা আরও কনফার্ম করতে সেই চিঠিটা হোয়াটস অ্যাপে পাঠানো হয় ২টা ৪৩ মিনিটে। সেটা যে তারা রিসিভ করেছেন, সেটিও দুদকের কাছে আছে। সুতরাং দুর্নীতি দমন কমিশনের এখানে কোনো অবহেলা ছিল না।”
এদিকে অর্থ পাচার রোধ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের তদারকিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের আভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা বিভাগ (আইএডি), আর্থিক প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন বিভাগ (এফআইআইডি) ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং বাজার বিভাগ (ডিএফআইআইডি) বিভাগে গত এক যুগ (২০০৮ থেকে ২০২০ পর্যন্ত) কোন কোন কর্মকর্তা দায়িত্বে ছিলেন, তাদের নাম, পদবী, ঠিকানা সংক্রান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
সে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা বিভাগে (আইএডি) গত এক যুগে দায়িত্ব পালন করেছেন ১৭৫ জন কর্মকর্তা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন বিভাগে (এফআইআইডি) দায়িত্ব পালন করেছেন ৫০ জন এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং বাজার বিভাগ (ডিএফআইআইডি) বিভাগে দায়িত্ব পালন করেছেন ১২৯ জন। মোট ৩৫৪ জন বাংলাদেশ ব্যাংকের এই তিন বিভাগে দায়িত্ব পালন করেছেন।
এ সময়ে (২০০৮ থেকে ২০২০ পর্যন্ত) অর্থপাচার রোধে সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাদের ব্যর্থতা আছে কিনা, ব্যর্থ হয়ে থাকলে কেন হলেন, অর্থপাচারের বিষয়টি তারা টের পেয়েছিল কিনা, পেয়ে থাকলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিলেন কিনা, তাদের ইন্ধন বা যোগসাজশে অর্থপাচার হয়েছে কিনা,বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে সে তথ্য ছিল না।
ডিএজি মানিক জানান এসব বিষয় জানাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সময়ের আবেদনের প্রেক্ষিতে সাত সপ্তাহের সময় দেওয়া হয়েছে।
আগামী ৬ এপ্রিল বিষয়টি পরবর্তী শুনানির জন্য রাখা হয়েছে বলে জানান রাষ্ট্রের এই আইন কর্মকর্তা।