ক্যাটাগরি

ক্রং মে মা

রাজার ছিলো অনেক পাহাড়ি জুম। ছেলেরা সকলে মিলে সেই জুম চাষ করতো। একদিন জুমের আগাছা পরিষ্কার করতে গিয়ে ছোট ছেলে একটা সোগোওয়াইসি কুড়িয়ে পেলো। সোগোওয়াইসি হলো এক প্রকার পাহাড়ি সবজি, যা দেখতে অনেকটা শসার মতো। সোগোওয়াইসিটা ছিলো খুবই সুন্দর। সুন্দর সোগোওয়াইসি পেয়ে খুব খুশি হলো সে, হাতে নিয়ে ছুটে গেলো ভাই-ভাবীদের কাছে।

ভাই-ভাবীদের সোগোওয়াইসি দেখিয়ে বললো, এই সোগোওয়াইসির মতো সুন্দরী এক কন্যাকে বিয়ে করতে চাই। ছোট ভাইয়ের কথা শুনে সকলেই খুব হাসাহাসি করলো। তারপর জুমের কাজকর্ম সেরে সকলেই বাড়ি ফিরে গেলো। বাড়ি ফিরে ছোট ভাইকে ডেকে তারা বললো, ‘তুমি তোমার পছন্দ মতো বউ খুঁজে নিয়ে আসো।’ তারপর রাজার ছোট ছেলে বেরিয়ে গেলো তার উপযুক্ত সুন্দরী কন্যার খোঁজে।

দিনভর পাহাড়, ছরা, জঙ্গল ঘুরে ঘুরে এক সময় ক্লান্ত হয়ে পড়লো সে। তখন সন্ধ্যা নেমে আসছে। জঙ্গলের মাথায় এক পাহাড়ের ঢালে সে একটা ঘর দেখতে পেলো। রাতের আঁধার নামার আগেই সে দ্রুত ছুটে গেলো ঘরের দিকে। ঘরে ছিলো এক বুড়ি। বুড়িকে ডেকে খুব অনুরোধ করে বললো, একটা রাতের জন্য আশ্রয় চাই। দয়া করে যদি আশ্রয় দিতেন।

বুড়ি ছেলেটার কথা শুনে ভালো করে দেখলো। তারপর বললো, এক রাত কেন, তুমি চাইলে দশ রাতও এখানে থাকতে পারো।

বুড়ির কথা শুনে ছেলেটা খুব খুশি হলো। বুড়ি ছেলেটাকে খুব আদর-যত্ন করে খাওয়ালো। বুড়ির আপ্যায়নে ছেলেটা খুব খুশি হয়ে আরও কিছুদিন থেকে গেলো। বুড়ি উঠানে কাজ করে আর ছেলেটা বারান্দায় বসে গল্প করে কাটাতে লাগলো।

একদিন বুড়ি উঠানে ধান, আর এক কোণায় লাকড়ি শুকাতে দিয়ে জঙ্গলের দিকে চলে গেলো কি এক কাজে। যাবার সময় সে ছেলেটাকে বলে গেলো, ‘যদি বৃষ্টি আসে, তবে তুমি এই ধান আর লাকড়ি উঠাতে যেও না কিন্তু।’

বুড়ির কথা শুনে অবাক হলো ছেলেটা। এ আবার কেমন কথারে বাবা! সে বুড়িকে বললো, ‘চোখের সামনে সব ভিজে যাবে, তবু ওঠাবো না?’

বুড়ি হেসে হেসে বললেন, ‘তুমি মেহমান, ও চিন্তা তোমার করতে হবে না। আমার ধান, লাকড়ি ওঠানোর লোক আছে। বৃষ্টি এলে ওরাই এসে তুলে রাখবে ঘরে।’ এই বলে বুড়ি বেরিয়ে গেলো।

ছেলেটা বুঝতে পারলো না, এই জঙ্গলে লোক আসবে কোত্থেকে! এ কয়দিনে বুড়ি আর বুড়ির সাতটা বিড়াল ছাড়া একটা মানুষের মুখ পর্যন্ত দেখতে পায়নি সে। অথচ বৃষ্টির সময় তারা এসে ধান তুলে দিয়ে যাবে! মনে মনে হাসলো ছেলেটা। আগে বৃষ্টি তো আসুক তখন দেখা যাবে!

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো। আকাশে হঠাৎ মেঘ জমে উঠলো। তারপর ঝুমঝুম করে বৃষ্টি। বারান্দায় বসে দেখলো, বুড়ির শুকনো ধান বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে। ভিজে যাচ্ছে শুকনো লাকড়ি। বারান্দার খুঁটি ধরে ভাবতে লাগলো, সে উঠানে নেমে ধানগুলো তুলে আনবে কিনা। আবার বুড়ির কথা অমান্য করা ঠিক হবে কিনা সেটাও ভাবলো। যাই হোক, দেখা যাক আসলেই বুড়ির কোন লোক আছে কিনা এই জঙ্গলে। ভাবতে ভাবতেই মুহূর্তেই সে দেখতে পেলো, ঘরের ভেতর থেকে এক অনন্য এক সুন্দরীর দল উঠানে নেমে আসছে।

ঘরের ভেতর ঘুরে তাকালো সে। দেখলো, বুড়ি যে সাতটা বিড়াল পুষতো, সেই সাতটা বিড়াল একে একে নিজেদের খোলস ছেড়ে একেকটা মহাসুন্দরী হয়ে বেরিয়ে আসছে। এই ঘটনা দেখে তো ছেলেটার মুখ হা হয়ে গেলো। একেকজনের মুখ চাঁদের মতো উজ্জ্বল আর দুধে-আলতা গায়ের বরণ। ছোট্ট ছোট্ট চোখ আর হাসিমাখা মুখ। সেইসব সুন্দরীরা চোখের পলকে উঠানের সব ধান আর লাকড়ি গুছিয়ে ঘরে তুলে আনলো। তারপর লাউ থেকে তৈরি পানির পাত্র বদংগুলো পানিভর্তি করে এনে রাখলো ঘরে। অন্যান্য টুকিটাকি কাজ সেরে, সকলেই উঠানে নেমে নেচে নেচে গোসল করতে লাগলো বৃষ্টির পানিতে। একজন আরেকজনের হাত ধরে ঘুরে ঘুরে গান গাইতে লাগলো।

ছেলেটার চোখ আটকে গেলো সবার ছোট মেয়েটার দিকে। কি চোখ তার! মিটমিট করে জ্বলছে যেন ছোট্ট দুটি কালো ভ্রমর। কি চুল! রেশমের মতো, বৃষ্টির পানিতে গুলিয়ে যাচ্ছে তার সোনালি রঙ। বাকি ছয়জন তাকে ঘিরে ঘুরে ঘুরে নাচতে লাগলো। এই সমস্ত দেখতে দেখতে হাত-পা পর্যন্ত স্থির হয়ে গেলো ছেলেটার। গোসল শেষ করে একে একে সবাই আবার ঘরে ফিরে আগের মতো বিড়াল হয়ে গেলো।

ঘরময় তারা মিঁউমিঁউ করে ঘুরে বেড়াতে লাগলো। সবচে ছোট বিড়ালটা কেমন দুর্বল আর ময়লা জড়ানো। তবুও ছেলেটা সেই নোংরা ছোট বিড়ালছানার দিকেই তাকিয়ে থাকলো। তার চোখে ভাসতে থাকলো বৃষ্টিভেজা এক মিষ্টি পরী। তার ইচ্ছা করছিলো এক্ষুণি গিয়ে বিড়ালের বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করতে। কিন্তু সে নিজেকে সংযত রাখলো। আগে বুড়ি আসুক ঘরে তারপর সব জানা যাবে।

রাতের বেলা বুড়ি ঘরে ফিরে এলো। এসে দেখলো সবকিছু ঠিকঠাক আছে। রাতে অনেক মজার মজার খাবার খেলো তারা। খেতে খেতে ছেলেটা বারবার বুড়ির দিকে তাকাতে লাগলো। বুড়িকে বিড়ালের কাহিনি জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করলেও ভয়ে কিছুই জিজ্ঞেস করলো না। রাতে খেয়েদেয়ে শুয়ে পরলো দুইজনই। বুড়ি ঘুমিয়ে গেলেও তার আর ঘুম আসলো না। এপাশ-ওপাশ করে কাটিয়ে দিলো সারারাত।

সকাল হতেই সে বুড়ির কাছে বিদায় নিতে গেলো। যাবার কথা শুনে, বুড়িরও মন খারাপ হয়ে গেলো। এই কয়দিনে একা এক নিঃসঙ্গ বুড়ির মায়া জন্মে গিয়েছিলো ছেলেটার উপর। অনেক করে বোঝানোর পর বুড়ি শেষ পর্যন্ত মেনে নিলো, সে অতিথি, আজ হোক কাল হোক চলে সে যাবেই। বুড়ি ছেলেটার মায়ায় জড়িয়ে ধরে বললো, চলেই যখন যাবি তখন তোকে তো কিছু দেওয়া চাই। কিন্তু আমার তো দেবার মতো কিছু নেই। আমার সাতটা বেড়াল আছে, তুই ওখান থেকে একটা বিড়াল নিয়ে যা।

বুড়ির কথা শুনে ছেলেটার চোখ ভিজে এলো। একে তো বিদায় নিয়ে চলে যেতে হচ্ছে তার উপর না চাইতেই সবচে কাঙ্ক্ষিত সম্পদ বুড়ি তাকে উপহার দিয়ে দিচ্ছে। আনন্দে আত্মহারা হয়ে সে আবারও বুড়িকে জড়িয়ে ধরে বিদায় নিলো। বুড়ি দেখলো ছেলেটা সেই ছোট্ট ময়লা বিড়ালটা কোলে তুলে নিলো। বুড়ি কাছে গিয়ে বললো, এ কিন্তু যে সে বিড়াল নয়। এ তোমার বিপদে-আপদে সাথে থাকবে। শুধু সাবধানে রেখো আমার আদরের বিড়ালটাকে।

বিড়ালটা কোলে নিয়ে বেরিয়ে পরলো ছেলেটা। হাঁটতে হাঁটতে শেষ পর্যন্ত ফিরে এলো রাজ দরবারে। বাড়ির ছোটছেলে গিয়েছিলো বউ খুঁজতে, সে ফিরে এসেছে, এই খবর সবার কানে কানে পৌঁছে গেলো। এক এক করে সব ভাইয়েরা এলো ছোট ভাই আর তার বউ দেখতে, ভাবীরা এলো, গ্রামবাসীরা এলো। কোথায় বউ! কিসের বউ! রাজার ছোট ছেলে কিনা বিয়ে করে এনেছে একটা বিড়ালের বাচ্চা!

ছি ছি করতে লাগলো সবাই। গ্রামবাসী নাক সিঁটকে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। ভাবীরা কপালে হাত দিয়ে বসে পড়লো মাটিতে আর বাকি ছয় ভাই রাগারাগি করে প্রাসাদ মাথায় তুলে ফেললো। এতোকিছু ঘটে গেলেও রাজা কিছুই বললো না। কয়েকদিনের মধ্যেই ছোট ছেলে ও তার বিড়াল-বউকে যৌথ সংসার থেকে আলাদা করে দিলো। ছেলেটাও বিড়ালের সাথে সাথে একা এক ঘর নিয়ে আলাদা হয়ে গেলো। তাকে যে আর যৌথ সংসারে রাখলো না তার ভাইয়েরা, এতে কোন দুঃখ নেই। কারণ, দিনে নোংরা বিড়ালের বাচ্চা হলেও, রাতে খোলস পালটে অপরূপ এক সুন্দরী বের হয়ে আসে। স্বামীর অনুগত বউ হয়ে সুখে শান্তিতে সংসার করতে লাগলো  সেই বিড়াল।

হঠাৎ একদিন রাজা তার সাত ছেলে আর ছেলের বউদের রাজপ্রাসাদে ডেকে পাঠালেন। বড় ছয় ছেলে তাদের সুন্দরী বউদের নিয়ে রাজপ্রাসাদে গেলেন। ছোট ছেলে গেলো তার আদরের বিড়ালের বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে। রাজপ্রাসাদে গিয়েও বাকি ছয় বউ বিড়ালের দিকে ঘৃণা আর অবহেলা নিয়ে তাকাতে লাগলো, পাশ থেকে ফোঁড়ন কাটলো তারা আর ভাইয়েরা দূরে গিয়ে বসলো।

রাজা এসে সকলের কানাকানি থামিয়ে দিয়ে বললেন, আমার বয়স হয়েছে। এখন আর এই বিশাল রাজ্য পরিচালনা আমার একার পক্ষে সম্ভব নয়। তোমাদের মধ্যে এমন একজনকে এই দায়িত্ব দিতে চাই, যে এই রাজ্য পরিচালনার যোগ্য।

রাজার কথা শুনে তার বড় ছয় ছেলেই উঠে দাঁড়ালো, নিজেরা নিজেদের পক্ষে বলতে লাগলো যে, সে-ই সবচে বেশি যোগ্য। তারা রাজাকে বোঝাতে চাইলো, কে কত বেশি ফসল উৎপাদন করেছে। কার বউয়ের কী কী গুণ আছে! শুধু ছোট ছেলেটাই চুপচাপ বসে থাকলো। রাজা সবাইকে থামিয়ে দিয়ে আবারও বলতে লাগলো, তোমাদের যোগ্যতার পরীক্ষা আমি পরে নেবো। তার আগে আমার শেষ বয়েসের একটা ইচ্ছাপূরণ করতে হবে তোমাদের। আবারও ছয় ছেলে উঠে দাঁড়ালো। রাজা এবারও হাতের ইশারায় সবাইকে বসিয়ে দিলো, অস্থির হয়ো না আমার পুত্রগণ। তোমাদের সময় এখনও আসেনি। তার আগে, তোমাদের বউদের বলো, তারা যেন আমার জন্য কাপড় তৈরি করে নিয়ে আসে। যে কাপড় এর আগে কেউ দেখেনি। যার কাপড় সবচেয়ে সুন্দর হবে আমি তাকে পুরস্কৃত করবো।

এই বলে সবাইকে বিদায় করে দিলেন রাজা। ঘরে ফিরে সকলেই ব্যস্ত হয়ে পরলো নতুন নতুন কাপড়ের চিন্তা নিয়ে। এবার আর ভাই ভাই নেই। তারা প্রত্যেকেই আলাদা হয়ে গেলো যার যার বউ নিয়ে। ভাইয়ের সাথে ভাইয়ের দেখা হলেও কথা বলে না কেউ। স্ত্রীরা কী সুতোয় কাপড় বুনবে, কী রঙ মাখাবে, কোথায় সুতা পাওয়া যায় এইসব নিয়ে দিনরাত খাটতে লাগলো। এদিকে ছোট ছেলের বউ তো বিড়াল। সে না পারবে কাপড় বুনতে, না পারবে সেসব নিয়ে চিন্তা করতে। এতো ব্যস্ততার দিনে তার কিছুই করার নেই বলে, ঘরের মধ্যে চুপচাপ বসে থাকে। স্বামীর মন খারাপ দেখে, মিঁউমিঁউ করে স্বামীর চারপাশে ঘুরতে থাকে বিড়াল বউ। দূরে যেতে বললেও আবার এসে স্বামীর পাশে ঘুরঘুর করতে থাকে। বিড়ালের উপর রাগ করে লাভ নেই। তার তো কোন দোষ নেই, তাই সে বিড়ালের বাচ্চাটাকে কোলের মধ্যে নিয়ে মাথায় আদর করতে করতে বলে, বাড়ির অন্যসব বউরো রাজার জন্য কাপড় বুনছে, আমাদের তো আর সে উপায় নেই। তুমি বিড়াল হয়ে তো আর কাপড় বুনতে

পারবে না। তাই তোমাকে বকেছি। তুমি কিছু মনে করো না, লক্ষ্মীছানা।

বিড়াল স্বামীর সব কথা বুঝলেও কিছু বলতে পারলো না। একই দুঃখ তার মনেও জ্বলছে। বিড়াল হয়ে সে তো আর কাপড় বুনতে পারবে না। খুব মন খারাপ করে সারাটা দিন কাটালো দুইজন। রাতে যখন বিড়ালছানা থেকে মানুষ হলো তখন সে তার স্বামীকে বললো, আমি সাত বোনের মধ্যে সবার ছোট। আমি কোন কাজ করলত পারি না। এমনকি কাপড়ও বুনতে পারি না। কিন্তু আমার দিদিরা তো পারে, আমার দিদিরা আমাকে সাহায্য করবে। তুমি আমাকে আমার দিদিদের কাছে নিয়ে চলো। বউয়ের কথাটা মনে ধরলো ছোট ছেলের। সত্যিই তো, তাছাড়া বুড়িকে বললে একটা উপায় তো হতে পারে।

পরদিন সকালে উঠেই বিড়াল-বউকে কাঁধে নিয়ে ছুটলো বুড়ির বাড়ির দিকে। বুড়ি সব সমস্যার কথা শুনলো। শুনলো বিড়াল-বউয়ের দিদিরাও। আদরের ছোট নাতনীর দুঃখের কথা শুনে খুব মন খারাপ হলো বুড়ির। দিদিরাও কষ্ট পেলো খুব। মনের দুঃখ মনে নিয়ে বুড়ি বললো, তুমি কোনো চিন্তা করো না। আমার নাতনীর কষ্ট দূর করার জন্য আমরা সাধ্যমতো করবো। বুড়ির কথা শুনে রাজার ছোট ছেলে আশ্বস্ত হলো।

সেই রাতেই বুড়ি আর সাত পরী একত্রে মিলে কাপড় বোনার জন্য উঠে-পরে লাগলো। একজন সুতা বোনে তো আর একজন সুতা রঙ করে। টানা কয়েকদিন ধরে সবাই দিনরাত মিলে কাপড় বোনার বিশেষ তাঁত রাহকাইং-এ কাপড় বুনতে লাগলো। এইভাবে অক্লান্ত পরিশ্রম করে কয়েকদিনের মধ্যে তারা বিরাট এক কাপড় তৈরি করে ফেললো। কাপড় তো নয়, যেন যাদুকরি এক সূক্ষ্ম পর্দা। এতো সূক্ষ্ম কাপড় এর আগে দুনিয়ার কেউ দেখেনি। এক কাপড়ে পুরো রাজপ্রাসাদ সাত পাক ঘিরে ফেলা যাবে। আবার এতো বিশাল সাইজের কাপড় ভাঁজ করে একটা মাদুলির মধ্যে ভরে রাখা যায়। ছোট ছেলে কাপড় দেখে নিজেই হতবাক হয়ে গেলো।

এতো গেলো কাপড়ের সমস্যা। এবার বুড়ি আর অন্য পরীরা নিয়ে এলো আরেক সমস্যা। শুধু বিড়াল হয়ে থাকার জন্য তাদের আদরের ছোট বোন অপমানিত হয়েছে, কষ্ট পেয়েছে এটা তো মানা যায় না। ছেলেটাকে বললো, ‘তুমি যদি চাও, এবার থেকে তোমার বউ আর বিড়াল থাকবে না।’

বিড়াল থাকবে না? যাকে সে ভালোবাসে সে যাই হোক তাতে ছেলেটার কোন আপত্তি নেই। মন ভারী করে ছেলেটা বললো, আমি যাকে ভালোবাসি, সে বিড়াল হোক আর মানুষ হোক তাতে আমার কোন সমস্যা নেই। সে যদি চায় তবে সে বিড়ালও থাকতে পারে, আবার মানুষও হতে পারে।

সাথে সাথে তার বউ উঠে দাঁড়ালো। সে দিদিদের কোলে অনুরোধ করে বললো, আমি আর বিড়াল থাকতে চাই না। আমি বিড়াল বলে সবাই আমার স্বামীকে অপমান করে। আমি আমার স্বামীর অপমান আর সহ্য করতে পারছি না। আমি চিরকালের জন্য মানুষ হয়ে যেতে চাই। তোমরা আমাকে মানুষ বানিয়ে দাও।

দিদিরা তাকে বোঝালো, একবার মানুষ হয়ে গেলে আর কোনদিন ফিরে আসতে পারবি না আমাদের কাছে। তোকে আমরা ভালোবাসি। বড় দিদিদের কথা শুনে ছোট পরী বললো, আমি তোমাদের কাছে আসতে পারবো না ঠিকই, কিন্তু তোমরা তো আমার কাছে যেতে পারবে। তোমরা তো আমার দিদি। আমি

ডাকলেই তোমরা আমার কাছে চলে আসবে, সেটা আমি জানি। কিন্তু তোমরা একবার ভাবো তো, যে মানুষটা আমার জন্য এতো কিছু ছেড়ে দিলো, তার জন্য এইটুকু ত্যাগ করা তো আমার কর্তব্য।

ছোটবোনের কথা শুনে বাকি ছয় বোন খুশি হলো। বুড়িও খুব খুশি হলো। সে ঘরের ভেতর থেকে একটুকরো সাদা কাপড়ের টুকরো নিয়ে এলো। দিদিরা চোখের জল মুছতে লাগলো, কেউ কেউ বুড়িকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করতে লাগলো এই ভেবে যে, চিরতরে তারা আদরের ছোট বোনকে হারাতে হচ্ছে। তারপর সব বোনেরা মিলে ছোটবেলার মতো ঘিরে ধরলো। বুড়ি সেই মোহিনী সাদা কাপড়ের টুকরো তুলে দিলো সবার আদরের ছোট পরীটার হাতে। সকলে তারে ঘিরে নাচতে লাগলো। এর মধ্যেই হাতের কাপড় দিয়ে সাতবার করে সে নিজের মুখ মুছে চিরতরে মানুষ হয়ে গেলো। বাকি পরীরাও উড়ে গেলো তাকে রেখে। বোনেরা উড়ে গেলো বলে চোখ দুটো তার ছলছল করে উঠলো।

অনেক শোক-তাপ বুকে নিয়ে কোন রকম রাতটা কাটিয়ে পরদিন স্বামীর হাত ধরে ফিরে এলো রাজপ্রাসাদে। এদিকে রাজার বাকি ছেলে আর তাদের বউ সবাই মহাব্যস্ত কাপড় তৈরির জন্য। একজন আরেকজনের থেকে দূরে সরে গিয়ে এক মহাপ্রতিযোগিতায় নেমে পড়লো সকলেই। বিভিন্ন রাজ্য থেকে দামি দামি সুতা, রঙ আর নিজেদের অক্লান্ত পরিশ্রম দিয়ে অনেক দামি কাপড় বুনলো একেকজন। একটার চেয়ে আরেকটা কম যায় না। কি রঙে, কি বুননে! এক এক করে সবাই রাজপ্রাসাদে এলো।

ডালিতে যার যার হাতে বোনা কাপড়, অঙ্গে নানারকম সাজসজ্জা। সবাই রাজপ্রাসাদে ঢুকে যাবার পর, সবার শেষে ছোট ছেলে আর তার পরী-বউ এসে উপস্থিত হলো সামান্য একটা মাদুলি হাতে নিয়ে। প্রাসাদে উপস্থিত অন্য ছয় ভাই আর তাদের বউয়েরা প্রথমে বিশ্বাসই করতে চাইলো না, এইটা তাদের ছোট ভাইয়ের বউ। রাজামশায় প্রাসাদে এসে আসন গ্রহণ করলেন। একে একে সবাই তাদের হাতে বোনা বিশেষ কাপড় রাখা সুসজ্জিত ডালি এনে রাজার সামনে রাখলেন। রাজামশায় প্রত্যেকের ডালি থেকে কাপড় তুলে নিয়ে নিজ হাতে পরীক্ষা করে নিলেন। এক এক করে কাপড় দেখে রাজামশায় নিজেই চিন্তায় পড়ে গেলেন, কোনটা থেকে কোনটা আলাদা করবেন! কোনটা রেখে কোনটা বাদ দেবেন! উত্তেজনায় তিনি দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু সিদ্ধান্তের বেলায় এসে কপালে ভাঁজ নিয়ে ধপাস করে সিংহাসনে বসে পরলেন। রাজামশায়কে সিংহাসনে পরে দেখে ভয়ে ভয়ে ছোট বউ এগিয়ে এসে রাজার

দাঁড়ালো। কাছে গিয়ে শ্বশুরের পা ছুঁয়ে নমস্কার করে আশীর্বাদ চাইলেন। রাজামশায় আশীর্বাদ করে তার পরিচয় জানতে চাইলেন। এইবার ছোট ছেলের বউ তার পরিচয় দিলেন এবং বিড়ালের কাহিনি খুলে বললেন। শুধু কাপড় সম্পর্কে কিছু বললেন না। রাজামশায় ছোট ছেলের বউকে পাশে দাঁড় করিয়ে রেখে অন্য সব ছেলের বউদের কাছে ডাকলেন। ডেকে নিয়ে সবার উদ্দেশ্যে বলতে লাগলেন, কেন সে এই প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছে। কারণ, এই প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে সে, তার রাজ্যের জন্য একজন দক্ষ রাজা ও

রানি নির্বাচন করতে চান। রাজ্যকে সূচারুরূপে সাজিয়ে রাখতে পারবে সেই রাজা-রানি যারা দক্ষ তাঁতি হিসেবে তাদের সুতাকে সুন্দর কাপড়ে পরিণত ও সুন্দর রঙে সাজিয়ে তুলতে পারে। সমস্ত ঘটনা খুলে বলার পর তার ছেলে বউদের নিজ নিজ আসনে ফিরে যেতে বললেন। সবাই ফিরে গেলেও ছেলের বউ গেলেন না। রাজার মুখ থেকে সমস্ত কথা শুনে ছোট ছেলের বউ বললো, এই ঘোষণা আমি আগেই জানি মহারাজ। কিন্তু আমি সেসময় বিড়াল ছিলাম।এবং আপনার আদেশ অনুযায়ী আমিও আপনার জন্য সামান্য এক টুকরো কাপড় বুনে এনেছি। দয়া করে যদি হাতে নিয়ে দেখতেন। রাজামশায় খুশি হলেন যে, সামান্য বিড়াল হলেও ছোট ছেলের বউ তার হুকুম পালন করেছে। কিন্তু কোথাও কোন ডালা কিংবা উপস্থাপনের জন্য আয়োজন দেখতে পেলেন না। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় সেই কাপড় যা তুমি আমার জন্য তোমার নিজের হাতে বুনেছো? এবার সে তার হাতের মুঠি খুলে একটা লম্বা মাদুলি এগিয়ে দিলেন রাজার জন্য। রাজা অবাক হলেন। জিজ্ঞেস করলেন, এটা কি? ছোট ছেলের বউ বললো, হে পিতা, আপনার জন্য তৈরি করা অতিসূক্ষ্ম এক কাপড় ভাঁজ করে এই মাদুলিতে রাখা আছে। আপনি নিজের হাতেই খুলে দেখুন।

রাজা এবার রেগে গেলেন। মাদুলির মধ্যে কাপড়? তাও আবার এতো ছোট একটা মাদুলি? কাপড় যদি থাকেও তো সে খুবই সামান্য এক টুকরো। সে ধমক দিয়ে বললো, তুমি আমাকে অপমান করছো? তুমি কি দেখো নাই, আমার অন্য ছেলের বউ কত সুন্দর সুন্দর কাপড় বানিয়ে এনেছে আমার জন্য?

আর এই সামান্য কাপড়ের টুকরো দিয়ে আমাকে ছোট করতে এসেছো। যাও, বেরিয়ে যাও এখান থেকে।

রাজার ধমক শুনে এবার তার ছোট ছেলেও উঠে দাঁড়ালো। কিছুই বললো না। এবার ছোট ছেলের বউ নিজের হাতে মাদুলির মুখ খুলে রাজার হাতে দিয়ে বলে, আমাকে ক্ষমা করুন পিতা। আপনাকে অপমান করার আগে আমি আমার মাথা পেতে দেবো। একবার শুধু হাতে নিয়ে দেখুন। এই বিশেষ কাপড় আমি নিজের হাতে বানিয়েছি আপনার জন্য। ছেলের বউয়ের কথায় রাজার মন গলে গেলো। তিনি ভাঁজ করা কাপড়ের টুকরা হাতে নিলেন। বাকিরা বসে বসে এই ঘটনা দেখতে লাগলো আর নিজেদের মধ্যে ফিসফাস করতে লাগলো।

এবার রাজামশায়, এক এক করে ভাঁজ খুলতে লাগলেন। ভাঁজের পর ভাঁজ,

ভাঁজের পর ভাঁজ। তিনি ক্লান্ত হয়ে উঠলেন। পুরো দরবার ছড়িয়ে গেলো কাপড়ে। এতো বিশাল আর এতো সূক্ষ্ম যে রাজামশায় চিন্তাই করতে পারলেন না, এই কাপড় তার ছেলের বউ বানিয়েছে। তিনি কাপড় ছেড়ে দিয়ে ছোট ছেলের বউয়ের দিকে তাকালেন। ছোট ছেলের বউ এবার রাজামশায়কে বলে, মহান পিতা, এই কাপড় দিয়ে আপনার এই রাজপ্রাসাদ সাতপ্যাঁচ ঘিরে দেওয়া যাবে। এবং আমার দিদিরা আমাকে শিখিয়েছিলেন কী করে এই কাপড় বুনতে হয়। আমি শুধু আপনাকে উপহার দেবো বলেই এই কাপড় বুনতে শিখেছিলাম।

রাজামশায় ময়লা বিড়ালছানা থেকে এমন রূপবতী আর গুণবতী মানুষ হয়ে ওঠা ছেলের বউয়ের আচরণ আর বুদ্ধিমত্তায় অত্যন্ত খুশি হলেন। এবং আরও খুশি হলেন তার ছোট ছেলে, যে শুধু মানুষের কথায় প্ররোচিত হয়ে তার গুণবতী বউকে নোংরা বিড়াল বলে ছুড়ে ফেলে দেয়নি। আবার রাজ্যলোভেও মরিয়া হয়ে রাজাকে অহেতুক সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করেনি, কিন্তু সমস্ত ব্যাপার ঠান্ডা মাথায় এবং বুদ্ধি আর সময়ের উপর নির্ভর করে শুধু নিজের কার্য সমাধা করতে পেরেছে।

এমন চিন্তাশীল ছেলেই তো আসলে তার যোগ্য উত্তরসূরী। তিনি তার ছোট ছেলেকে কাছে ডাকলেন, এক হাতে ছেলে আর এক হাতে ছেলের বউকে ধরে ঘোষণা করলেন, এই হলো আমার যোগ্য উত্তরসূরী। সে যেমন সৌন্দর্যের কদর জানে, তেমন গুণেরও কদর করতে পারে। আমার এই বৃদ্ধ বয়সে আমি তার হাতে আমার রাজ্যের ভার তুলে দিয়ে নিশ্চিন্তে বাকি জীবনটা কাটাতে চাই। আমি আশা করবো এতে কারও দ্বিমত থাকবে না, বা থাকলেও তারা তাদের যোগ্যতা দিয়ে এই ভবিষ্যৎ রাজার সাথে মোকাবেলা করবে। বাকি ভাইয়েরা নিজেদের জন্য আপসোস করতে লাগলো। তারা নিজেদের দোষ বুঝতে পারলো। ঘৃণা দিয়ে আসলে কিছুই জয় করা যায় না। তারা নিজেদের দোষ মেনে নিয়ে রাজপ্রাসাদ ছেড়ে নিজেদের সংসারে ফিরে গেলো।

 

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!