‘যদি রাত পোহালেই শোনা যেত বঙ্গবন্ধু মরে নাই’- এ গানের কথা যে বাঙালিই মনের কথা।
যে বছর বাঙালির মুক্তির সংগ্রাম চূড়ান্ত লড়াইয়ের রূপ পেল, সেই ১৯৭১ সালের ১৭ মার্চ দৈনিক ইত্তেফাকে ছাপা হল পল্লীকবি জসীম উদ্দীনের একটি কবিতা।
‘বঙ্গ-বন্ধু’ শিরোনামে সেই কবিতায় তিনি লিখলেন – ‘মুজিবর রহমান/ ওই নাম যেন বিসুভিয়াসের অগ্নি-উদারী বান।’
সেই শেখ মুজিবুর রহমানের ১০১তম জন্মবার্ষিকী বুধবার, যার হাত ধরে এসেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, দেশের মানুষ ভালোবেসে যাকে দিয়েছে বঙ্গবন্ধু উপাধি, স্বাধীন দেশের সংবিধান যাকে দিয়েছে জাতির পিতার স্বীকৃতি।
জন্মদিন নিয়ে বিশেষ কোনো ভাবনা ছিল না বঙ্গবন্ধুর; তিনি বলতেন, “আমার জন্মদিনই কী, আর মৃত্যুদিনই কী? আমার জনগণের জন্য আমার জীবন ও মৃত্যু। আমি তো আমার জীবন জনগণের জন্য উৎসর্গ করেছি।”
তার হাত ধরেই বাঙালি পেয়েছিল স্বাধীনতার দিশা; অর্ধ শতকের পথচলায় অর্থনৈতিক মুক্তির যে সোনালি দিগন্তের সামনে আজ বাঙালি দাঁড়িয়ে, তারও অনুপ্রেরণা তিনি।
গতবছর সাড়ম্বরে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের প্রস্তুতি নিয়েছিল সরকার। কিন্তু করোনাভাইরাসের মহামারীতে স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা বিবেচনায় নিয়ে মূল আয়োজন সীমিত করা হয়।
তারপরও নানা আয়োজনে আগামী বিজয় দিবস পর্যন্ত মুজিববর্ষের উদযাপন চলবে। তারই মধ্যে এবারের স্বাধীনতা দিবসে আসছে বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের আরেক মাহেন্দ্রক্ষণ।
মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ‘মুজিব চিরন্তন’ প্রতিপাদ্যে ১০ দিনের কর্মসূচি নিয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি। এরমধ্যে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনের থিম ‘ভেঙেছ দুয়ার, এসেছ জ্যোতির্ময়’।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন উপলক্ষ্যে জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে হবে ১০ দিনের অনুষ্ঠান। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি
বুধবার বিকালে প্যারেড গ্রাউন্ডে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনের আয়োজনে উপস্থিত থাকবেন মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম মোহাম্মদ সলিহ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ।
ভিডিওতে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেবেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং, জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইউশিহিদে সুগা ও কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। বাংলাদেশের শিল্পীদের সঙ্গে থাকবে ভারতীয় একটি সাংস্কৃতিক আয়োজন।
বঙ্গবন্ধুর মাত্র ৫৪ বছরের জীবনের এক-চতুর্থাংশই কেটেছে কারাগারে; তার পুরো জীবনটাই ছিল বাঙালির জন্য নিবেদিত; সেজন্য ফাঁসির মঞ্চকেও তিনি ভয় পাননি।
বাঙালি আর বাংলাদেশের সঙ্গে এমনই অচ্ছেদ্য হয়ে উঠেছিলেন শেখ মুজিব; টুঙ্গিপাড়ার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে মহানায়ক হয়ে উঠে এসেছেন জাতীয় অঙ্গনে, এরপর দ্যুতি ছড়িয়েছেন বিশ্বমঞ্চে।
জাতির পিতা যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেই সোনার বাংলায় তার বাংলাদেশকে পৌঁছে দিতে আজকের অভিযাত্রায় নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন তারই মেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এক বাণীতে তিনি বলেন, ইতোমধ্যে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে। … দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। বাঙালি আজ আত্মমর্যাদাশীল দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে।
“আসুন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীতে আমরা দৃঢ় সঙ্কল্পে আবদ্ধ হই- বাংলাদেশকে আমরা বিশ্বসভায় আরো উচ্চাসনে নিয়ে যাব, আগামী প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ-শান্তিপূর্ণ আবাসভূমিতে পরিণত করব।”
বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ১৭ মার্চ জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে উদযাপিত হয়। এই দিনে স্কুল-কলেজে শিশুদের অংশগ্রহণে বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হয়, কিন্তু মহামারীর কারণে এবার আর হচ্ছে না।
এবারের জাতীয় শিশু দিবসের প্রতিপাদ্য ঠিক হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন, শিশুর হৃদয় হোক রঙিন’।
রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ এক বাণীতে বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজ সম্পাদনের মাধ্যমে দেশকে সোনার বাংলায় পরিণত করাই হোক মুজিববর্ষে সকলের অঙ্গীকার। তার নীতি ও আদর্শ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে পড়ুক, গড়ে উঠুক সাহসী, ত্যাগী ও আদর্শবাদী নেতৃত্ব- এ প্রত্যাশা করি।”
শৈশবে দুরন্ত খোকা
শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায়, শেখ লুৎফর রহমান ও সায়েরা খাতুনের ঘরে।
বাবা-মা আদর করে ডাকতেন ‘খোকা’ বলে। এই খোকাই কালে হয়ে ওঠে ইতিহাসের মহানায়ক।
ছোটবেলায় দুরন্ত স্বভাবের ছিলেন শেখ মুজিব, তার নিজের ভাষায় ‘দুষ্টু প্রকৃতির’। শৈশবে বেরিবেরি রোগ হওয়ার পর হৃদযন্ত্র হয়ে পড়েছিল দুর্বল, গ্লুকোমা হওয়ায় অস্ত্রোপচারের পর চোখেও উঠেছিল চশমা। তার মধ্যেও ফুটবল নিয়ে মাঠ মাতাতেন তিনি।
গত শতকের সেই ৩০ এ দশকে এর মধ্যেই স্বদেশী আন্দোলন দেখে ইংরেজবিরোধী মনোভাব জেগে ওঠে বালক শেখ মুজিবের মনে।
কিন্তু পরে কংগ্রেস-মুসলিম লীগ বিভাজনে মুসলিম লীগের প্রতি ঝুঁকে পড়েন তিনি, আর এক্ষেত্রে প্রভাব রেখেছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী; রাজনৈতিক আজীবন যার মোহে আচ্ছন্ন ছিলেন শেখ মুজিব।
গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুল, মিশনারি স্কুলে পড়াশোনার সময়ই রাজনীতির দীক্ষা হয়ে যায় শেখ মুজিবের।
স্কুলে পড়াকালেই ‘মুসলিম সেবা সমিতির’ সক্রিয় সদস্য হিসেবে কাজ শুরু করেন। সমিতির পক্ষ থেকে মুসলমান বাড়ি থেকে সংগৃহীত মুষ্টিভিক্ষার চাইলের অর্থ দিয়ে গরিব ছাত্রদের পড়ালেখা অন্যান্য খরচের জোগান দেওয়া হত।
১৯৩৮ সালে অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক ও শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর গোপালগঞ্জ সফরে তাদের সংবর্ধনা দেন শেখ মুজিব।
শিক্ষার্থীদের দাবি নিয়েও সোচ্চার ছিলেন তিনি। তখনই সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে তার যোগাযোগের শুরু। পরে বেঙ্গল মুসলিম ছাত্রলীগ গোপালগঞ্জ মহকুমার সম্পাদক হন। অল বেঙ্গল মুসলিম ছাত্রলীগের ফরিদপুর জেলা ও প্রাদেশিক কাউন্সিলরও হন তিনি। বেঙ্গল মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন ১ বছরের জন্য ১৯৪১ সালে। ওই বছরই তিনি দুই বার সাময়িকভাবে গ্রেপ্তার হন।
১৯৪২ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে (বর্তমানে মৌলানা আজাদ কলেজ) ভর্তি হন শেখ মুজিব। তার রাজনৈতিক তৎপরতা বাড়তে থাকে। কলেজ ছাত্র সংসদের জিএস নির্বাচিত হন ১৯৪৬ সালে। ১৯৪৭ সালে এই কলেজ থেকেই তিনি স্নাতক ডিগ্রি নেন।
ভারত এবং পাকিস্তানের পাশাপাশি তৃতীয় রাষ্ট্র হিসেবে বাংলা প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৪৭ সালে সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে আন্দোলনে যোগ দেন শেখ মুজিব। এই উদ্যোগ ব্যর্থ হলেও পরবর্তীতে এটাই তার স্বপ্নের রাষ্ট্র গড়ার ভিত্তি গড়ে দেয়।
রাজনীতিতে উত্থান
ভারত ভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন শেখ মুজিব; প্রতিষ্ঠা করেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, সোচ্চার হন পাকিস্তান সরকারের দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে।
উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার জন্য মুসলিম লীগের চক্রান্তের বিরুদ্ধে দাঁড়ান শেখ মুজিব; রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ধর্মঘট পালন করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হন, পরে ছাড়াও পান।
চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের অধিকার আদায়ে নেমে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে থাকা অবস্থায় ১৯৫২ সালের ভাষাআন্দোলনে নানা দিক-নির্দেশো দেন।
১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ (বর্তমান আওয়ামী লীগ) গঠন হলে কারাগারে বন্দি অবস্থাতেই যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন শেখ মুজিব। এর মধ্যদিয়ে বিকশিত হতে থাকে তার রাজনৈতিক নেতৃত্ব।
১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক সরকারের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতায় গেলে গোপালগঞ্জ থেকে নির্বাচিত শেখ মুজিব সর্বকনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে মন্ত্রিসভায় যোগ দেন; যদিও এক বছরও সেই সরকারকে থাকতে দেয়নি পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী।
অসাম্প্রদায়িক শেখ মুজিব ১৯৫৫ সালে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে ‘আওয়ামী লীগ’ করতে মূল ভূমিকা পালন করেন। আর এই আওয়ামী লীগই হয়ে ওঠে তার ধ্যান-জ্ঞান। যার জন্য পরে আবার প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রী হলেও দলকে সুসংহত করার উদ্দেশ্যে মাত্র নয় মাস পরর পদত্যাগ করেন তিনি।
এরপর আইয়ুব খানের সামরিক শাসনে কারাগারেই কাটাতে হয় শেখ মুজিবকে; কিন্তু তা বাঙালির নেতা হিসেবে তার ভিত্তি আরও মজবুত করে তোলে। এই সময় ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ নামে একটি গোপন সংগঠনও প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।
বাংলাদেশ ছাত্রলীগের জাতীয় সম্মেলনে প্রধান অতিথি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৮ জানুয়ারি, ১৯৭৪। ছবি: নাসির আলী মামুন/ফটোজিয়াম
হলেন বঙ্গবন্ধু
ষাটের দশকে বাঙালির রাজনৈতিক সংগ্রাম তুঙ্গে উঠলে তার অবিসংবাদিত নেতা হয়ে ওঠেন শেখ মুজিব। ১৯৬৬ সালে বাংলার শোষণ-বঞ্চনার অবসান দেন ৬ দফা, যা তখন জাতীয় মুক্তির সনদ হিসেবে গ্রহণ করে বাঙালি।
এই ছয় দফা বাঙালি জাতির জন্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তির বীজ যেমন বুনে দেয়, তেমনি পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনের গোড়ায় হানে আঘাত।
ছয় দফার পক্ষে ব্যাপক জনমত গড়ে উঠলে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী প্রথমে বন্দি করে শেখ মুজিবকে; এরপর করে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’।
কিন্তু শেখ মুজিবের মুক্তি দাবিতে দেশব্যাপী শুরু হয় তীব্র ছাত্র গণআন্দোলন, যাতে ভিত কেঁপে ওঠে আইয়ুব শাহীর।
১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবসহ রাজবন্দিরা মুক্তি পেলে পরদিন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক বিশাল ছাত্র সমাবেশে লাখো শিক্ষার্থীর উপস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করে।
স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনকে ধীরে ধীরে স্বাধীনতা সংগ্রামের দিকে চালিত করতে থাকে বঙ্গবন্ধুর বিচক্ষণ নেতৃত্ব। ওই বছরের ৫ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত আওয়ামী লীগের এক জনসভায় পূর্ব পাকিস্তানের নাম ‘বাংলাদেশ’ রাখেন তিনি।
১৯৭০ সালে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ জয় তাকে কেন্দ্রীয় সরকারে বসার দাবিদার করলেও তা হতে দেয়নি পাকিস্তানিরা। যার ফলে নতুন দেশ গড়ার নিজের লালিত স্বপ্নের দিকে এগোতে থাকেন বঙ্গবন্ধু।
স্বাধীনতার ডাক
আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করলে ফুঁসে ওঠে বাঙালি।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা পায় গতি; কার্যত ১ মার্চ থেকে তার নির্দেশেই চলতে থাকে পূর্ব পাকিস্তান।
পাকিস্তানিদের নানা ষড়যন্ত্রের মধ্যে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে জনসমুদ্রে হাজির হন বঙ্গবন্ধু; বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’।
বিশ্বের ইতিহাসে অন্যতম সেরা ভাষণ হিসেবে স্বীকৃত ওই ভাষণ থেকেই ‘স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের হল’।
প্রয়াত অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেছিলেন, “যে শুনেছে সেই ভাষণ, তার শরীরে বয়ে গেছে বিদ্যুৎ প্রবাহ।”
বঙ্গবন্ধুর ডাকে সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতিতে নামে বাঙালি; অন্যদিকে পাকিস্তানিরাও চরম আঘাত হানার পরিকল্পনা নেয়।
২৫ মার্চ দিবাগত রাতে পাকিস্তানি বাহিনী গণহত্যা শুরু করলে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধু।
পাকিস্তানি বন্দি বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করে তার নেতৃত্বেই চলে স্বাধীনতার সংগ্রাম। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম শেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিজয় লাভ করে।
১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে লন্ডন, নয়াদিল্লী হয়ে ১০ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশে ফেরার পর পূর্ণতা পায় বাঙালির স্বাধীনতা।
একটি সমাবেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১১ নভেম্বর, ১৯৭৩। ছবি: নাসির আলী মামুন/ফটোজিয়াম
ট্র্যাজেডির নায়ক
যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব নিয়ে জাতির পিতা নামলেও ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি, তা চলতে থাকে দেশে এবং দেশের বাইরে।
প্রথমে প্রধানমন্ত্রী হন শেখ মুজিব, কয়েক বছর পর ১৯৭৫ সালে বাকশাল গঠন করে প্রেসিডেন্ট হন তিনি। ওই বছরই ১৫ অগাস্ট বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক অন্ধকার রাত আসে, যাতে বাঙালি হারায় জাতির পিতাকে।
স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য সংগ্রামে যার জীবনের ৪ হাজার ৬৮২ দিন থাকতে হয়েছিল কারাগারে, জনগণকে প্রাধান্য দিতে পরিবার যার কাছে হয়ে পড়েছিল গৌন, সেই শেখ মুজিবের হন্তারক হিসেবে আবির্ভূত হন একদল বাঙালিই।
নিরাপত্তা নিয়ে বিদেশি সাংবাদিকদের প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু বলতেন, কোনো বাঙালি তাকে মারতে আসবেন বলে তিনি বিশ্বাস করেন না।
বাঙালির প্রতি তার ছিল অগাধ বিশ্বাস; তিনি বলতেন, তিনি দেশের মানুষকে ভালোবাসেন, এটা তার শক্তি। আর তার দুর্বলতা হচ্ছে, তিনি দেশের মানুষকে ‘বেশি’ ভালোবাসেন।
সেই দুর্বলতার সুযোগে পঁচাত্তরের ট্রাজেডি আসে বাংলাদেশে; যার জন্ম না হলে হয়ত বাংলাদেশ হত না বলা হয়, সেই বঙ্গবন্ধু শেষ গোসল হয় একটি কাপড় কাচা সাবানে, কাফন হয় রিলিফের কাপড়ে।
ধর্ম নিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র- এই চার মূল নীতি নিয়ে বঙ্গবন্ধু যে দেশ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তার হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের পথচলা উল্টো দিকে বেঁকে যায়।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার গোটা পরিবারকেই হত্যা করেছিল খুনি ওই সেনা সদস্যরা; বিদেশে থাকায় বেঁচে যান দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা।
প্রতিকূল পরিবেশে বাবার দলের দায়িত্ব নিয়ে দেশে আসেন শেখ হাসিনা; তখন নিজের গড়া দেশেই রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নির্বাসিত বঙ্গবন্ধু।
শত প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফেরার পর বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ পুনরায় ফিরলে বিচার সম্পন্ন করে গ্রেপ্তার খুনিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগের অর্থনৈতিক দর্শন বদলালেও তার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যেই এখন কাজ করার কথা বলছেন তার মেয়ে শেখ হাসিনা। ফলে জাতীয় জীবনে বঙ্গবন্ধু আছেন স্বমহিমায়।
অন্নদা শঙ্কর রায় তো বলেই গেছেন- “যতকাল রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান, ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান”।