দিগন্তের সুবর্ণ প্রভায় চোখ রেখে বাঙালি মিলিত হয়েছে ইতিহাসের দুই মাহেন্দ্রক্ষণের উদযাপনে; তাতে সঙ্গী হচ্ছেন প্রতিবেশী রাষ্ট্রনেতারাও।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনে দশ দিনের বর্ণিল আয়োজনের পর্দা উঠেছে বুধবার; যেখানে উচ্চারিত হয়েছে জাতির জনকের স্বপ্নের পথ ধরে সামনে এগিয়ে চলার প্রত্যয়।
জাতির পিতার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, “এখন শুধু আমাদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার পালা। পেছনে ফিরে তাকানোর কোনো সুযোগ নেই।”
বুধবার বিকাল সাড়ে ৪টায় জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে শিশুদের কণ্ঠে জাতীয় সংগীতের পরিবেশনার মধ্য দিয়ে ‘মুজিব চিরন্তন’ প্রতিপাদ্যে ১০ দিনব্যাপী এ আয়োজনের সূচনা হয়।
প্রথম দিনের আয়োজনে সম্মানিত অতিথি ছিলেন মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম মোহাম্মদ সলিহ। ফার্স্ট লেডি ফাজনা আহমেদও তার সঙ্গে ছিলেন। অনুষ্ঠানস্থলে তাদের অভ্যর্থনা জানান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ রেহানা, রাষ্ট্রপতির স্ত্রী রাশিদা খানম, স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলামও ছিলেন অনুষ্ঠানে।
জাতীয় সংগীতে অনুষ্ঠানের সূচনা হওয়ার পর শত শিশুর কণ্ঠে কয়েকটি গান পরিবেশিত হয়। অতিথিরা মঞ্চে আসার পর পাঠ করা হয় ধর্মগ্রন্থ থেকে।
এরপর ‘মুজিব চিরন্তন’- এই থিমের ওপর তৈরি একটি অ্যানিমেশন দেখানো হয়। সেই প্রদর্শনী শেষে হলে পরিবেশিত হয় এ আয়োজনের ‘থিম সং’ এর মিউজিক ভিডিও।
এরপর বিমানবাহিনীর ফ্লাই পাস্টের রেকর্ড করা ভিডিও দেখানো হয়। উদযাপন কমিটির সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন।
বঙ্গবন্ধুর আজীবন সংগ্রামের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, “শত শত বছরের গোলামির জিঞ্জির থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করার জন্য একজন মহাপুরুষের আবির্ভাব ঘটল, তার নাম শেখ মুজিবুর রহমান। বিনিময়ে তাকে সপরিবারে জীবন দিতে হল। কিন্তু তিনি অমর হয়ে গেলেন। কারণ মানুষ একবারই মরে, কিন্তু তার কর্মধারায় স্থির হয় তিনি অমর কিনা।”
অনুষ্ঠানে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের ভিডিওবার্তা প্রচারের পর দেখানো হয় চীনের রাষ্ট্রদূত তার দেশের উপহার হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বঙ্গবন্ধুর যে আবক্ষ ভাস্কর্য হস্তান্তর করেছেন, তার একটি ভিডিও।
এরপর কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো, জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইউশিহিদে সুগা ও বাংলাদেশের বন্ধু সাংবাদিক স্যার মার্ক টালির ধারণ করা ভিডিও বার্তা দেখানো হয় অনুষ্ঠানে।
বঙ্গবন্ধুকে চীনের পুরোনো ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসাবে বর্ণনা করে প্রেসিডেন্ট শি বলেন, “১৯৫২ ও ১৯৫৭ সালে দু’বার চীন সফরে তিনি চেয়ারম্যান মাও সে তুং ও প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাইসহ জ্যেষ্ঠ চীনা নেতাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করেছিলেন।
চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং অনুষ্ঠানে ভিডিও বার্তা দেন
জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইউশিহিদে সুগা অনুষ্ঠানে ভিডিও বার্তা দেন
“একটি চীনা প্রবাদে আছে ‘পানি পানের সময় কূপ খননকারীকে ভুলো না’, আমাদেরও সবসময় মনে রাখা উচিত পূর্বপ্রজন্মের নেতারা কী করেছিলেন।”
স্বাধীনতার ৫০তম বছরে বাংলাদেশের অভূতপূর্ব উন্নয়নের সঙ্গে তার দেশের সহযোগী হওয়ার কথা তুলে ধরে ট্রুডো বলেন, “শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নের কারণেই আজকের অনুষ্ঠান সম্ভব হচ্ছে।”
তিনি বলেন, “৫০ বছরে এই দেশ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক এগিয়েছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বেড়েছে, দারিদ্র্যের হার কমেছে, শিক্ষার হার বেড়েছে, স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন হয়েছে, মানুষের জন্য নতুন নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।”
জাপানি প্রধানমন্ত্রী সুগা বলেন, “স্বাধীনতার পর থেকে স্বপ্নের সোনার বাংলা করার ক্ষেত্রে জাপান বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে সহযোগিতা করে যাচ্ছে। ১০০ টাকার নোটে থাকা যমুনা বহুমুখী সেতু ও সোনারগাঁও হোটেল নির্মিত হয়েছিল স্বাধীনতার ঠিক পরে। আর এগুলো আমাদের দীর্ঘদিনের সম্পর্কের প্রতীক।”
প্রথম দিনের আয়োজনে সম্মানিত অতিথি ছিলেন মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম মোহাম্মদ সলিহ।
এরপর ’সম্মানিত অতিথির’ বক্তব্যে মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম মোহাম্মদ সলিহ বলেন, “বাংলাদেশের উন্নয়নের গতি উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং জনগণের কঠোর পরিশ্রম দেশকে দ্রুত উন্নয়নের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।”
বাংলাদেশের এই অগ্রযাত্রায় শেখ মুজিবুর রহমান প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবেন মন্তব্য করে তিনি বলেন, “তার জীবন বাংলাদেশকে স্বতন্ত্র একটি পরিচয় দান করেছে। সারাজীবন তিনি গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছেন। তার ছয় দফা বাংলাদেশের স্বাধীনতার ভিত্তি স্থাপন করেছিল। তার ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ কার্যত বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা।”
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের ভাষণের পর অতিথিদের হাতে তুলে দেওয়া হয় ‘মুজিব চিরন্তন’ শ্রদ্ধা-স্মারক।
স্বাধীনতার ৫০ বছরে রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন কতটুকু হয়েছে তা ভেবে দেখার তাগিদ দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দুয়ারে দাঁড়ানো বাংলাদেশে রাজনীতির গতিধারা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে রাজনীতিবিদদের বঙ্গবন্ধুর আদর্শে ফেরার এবং দেশের কাজে আত্মনিয়োগ করার আহ্বান জানান রাষ্ট্রপতি।
তিনি বলেন, “আজ আমরা স্বাধীনতার ৫০ বছর পার করছি। এ সময়ে রাজনীতিতে অনেক চড়াই-উৎরাই ঘটেছে। কিন্তু রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন কতটুকু হয়েছে তা ভেবে দেখতে হবে। ব্যক্তির চেয়ে দল, দলের চেয়ে দেশ বড়- এটাই হচ্ছে রাজনীতির মূল আদর্শ। কিন্তু আজকাল যেন রাজনীতি উল্টো পথে হাঁটছে।”
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক কর্মী আবদুল হামিদ বলেন, “ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বা ভোগ-বিলাস কোনো কিছুই তাকে তার লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু চাইলেই বিত্ত-বৈভবে নিজেকে উজাড় করে দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি অবলীলায় এসব প্রত্যাখ্যান করে দেশ ও জনগণের অর্থাৎ বাঙালি ও বাংলাদেশের স্বার্থকেই জীবনের ব্রত হিসাবে নিয়েছেন।”
অনুষ্ঠানের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যের মধ্য দিয়ে আলোচনা পর্ব শেষ হয়। এরপর বিরতি দিয়ে শুরু হয় ‘ভেঙেছো দুয়ার এসেছো জ্যোতির্ময়’ থিমে সাংস্কৃতিক আয়োজন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, এখন শুধু সামনে এগিয়ে যাওয়ার পালা।
বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা অনুষ্ঠানে বলেন, ”সকল বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে এ দেশকে আমরা জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের শোষণ-বঞ্চনামুক্ত, ক্ষুধা-দারিদ্র্য-নিরক্ষরতামুক্ত, অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলাদেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করবই, ইনশাআল্লাহ। এটাই আজকের দিনে আমাদের প্রতিজ্ঞা।”
স্বাধীনতার অর্ধশতক পরও স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি যে সক্রিয়, সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে তাদের প্রতিহত করে দেশকে এগিয়ে নিতে সবার প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
জোড়া উদযাপন ঘিরে জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ড এলাকাকে সাজানো হয়েছে বর্ণিল সাজে; রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে টানানো হয়েছে প্রচুর ব্যানার-ফেস্টুন। বিভিন্ন ভবনে হয়েছে আলোকসজ্জা।
বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার থিমে ওই এলাকায় গ্রামবাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তুলে ধরার পাশাপাশি উন্নয়নের নানা দিকও ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন সময়ের ভাষণের উদ্ধৃতি ছাড়াও জাতির পিতার তর্জনীর ছবি কিংবা শিল্পকর্মের প্রাধান্য পেয়েছে ব্যানার, ফেস্টুন আর বিলবোর্ডে।
আয়োজনে ঘিরে বাঙালির অধিকার আদায়ের আন্দোলনের ধারাবাহিকতা তুলে ধরার পাশাপাশি সামনে আনা হচ্ছে গত ৫০ বছরের ’স্বপ্নযাত্রার’ গল্প।
প্রথম দিনের সাংস্কৃতিক আয়োজনে দেশীয় শিল্পীদের পাশাপাশি একটি বড় অংশজুড়ে ছিল ভারতীয় শিল্পীদের পরিবেশনা।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পর্বে ‘ভেঙেছ দুয়ার এসেছ জ্যোতির্ময়’ থিমের ওপর ভিত্তি করে নির্মিত অডিও-ভিজ্যুয়ালে ফুটিয়ে তোলা হয় জাতির পিতার সংগ্রামী জীবনের নানা অধ্যায়।
অর্কেস্ট্রা মিউজিকের সঙ্গে গান পরিবেশনা, বঙ্গবন্ধুকে প্রতীকী চিঠি উৎসর্গ এবং ‘মুজিব শতবর্ষের কার্যক্রম ফিরে দেখা’ শীর্ষক ভিডিও দেখানো হয় এ সময়।
এ পর্বে পরিবেশিত হয় বঙ্গবন্ধুর প্রিয় সব গান। গেয়ে শোনান সাদি মোহাম্মদ, রফিকুল আলম, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা ও শিমূল ইউসূফ।
পরিবেশনায় ছিল ‘জাত গেল জাত গেল’, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তব একলা চল রে, ধনধান্য পুষ্প ভরা’সহ কয়েকটি গান।
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর প্রথম দিনের আয়োজনের সমাপনী অনুষ্ঠানে আতশবাজির আলোয় রঙিন হয়ে ওঠে প্যারেড গ্রাউন্ডের আকাশ। ছবি: মাহমুদ জামান অভি
বঙ্গবন্ধুকে উৎসর্গ করে বন্ধু-রাষ্ট্রের সাংস্কৃতিক পরিবেশনা পর্বে ছিল ভারতের প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী মমতা শঙ্করের নির্দেশনায় একটি বিশেষ পরিবেশনা।
আতশবাজির আলোকচ্ছটায় রাত সাড়ে ৮টার দিকে শেষ হয় প্রথম দিনের আয়োজন।
করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে গত এক বছর থমকে গিয়েছিল সব আয়োজন; বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর উদযাপন গত এক বছর ধরে ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে সীমাবদ্ধ ছিল।
নতুন করে পরিকল্পনা সাজিয়ে বুধবার বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে জাতীয় পর্যায়ে দশ দিনের এই অনুষ্ঠানমালার সূচনা হল, যার শেষ হবে ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির দিনে।
জাতীয় প্যারেন্ড গ্রাউন্ডে ১০ দিনের এই অনুষ্ঠানমালার পাঁচ দিনের আয়োজনে যোগ দেবেন প্রতিবেশী পাঁচ দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান।
মহামারীর কারণে ওই পাঁচ দিনের আয়োজনে সর্বোচ্চ পাঁচশ জন আমন্ত্রিত অতিথি অংশ নিতে পারবেন। অনুষ্ঠানে আসার আগে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে হবে যে তিনি সংক্রমিত নন।
বাকি পাঁচ দিনের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথিদের কেউ জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে থাকবেন না; শিল্পীদের পরিবেশনা সেখানে থেকে টেলিভিশন আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচারে সীমাবদ্ধ থাকবে।