রায়ে আদালত বলেছে, “এই ইতিহাস বিকৃতি সকলের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটিয়েছে। ফলে রিট আবেদনকারীর আবেদন করার যথেষ্ট কারণ ছিল। এরই মধ্যে আদালতের নির্দেশে সকল বই সংগ্রহ করে ধ্বংস করা হয়েছে। এছাড়া সংশ্লিষ্টরা নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করায় আবেদনটি নিষ্পত্তি করা হল।”
বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম ও বিচারপতি মোহাম্মদ আলীর হাই কোর্ট বেঞ্চ বৃহস্পতিবার এ রায় দিয়েছে।
আদালতে রিট আবেদনকারীপক্ষে আইনজীবী ছিলেন জ্যোর্তিময় বড়ুয়া। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল কাজী মাইনুল হাসান ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল নাসিম ইসলাম রাজু।
রায়ের পর কাজী মাঈনুল ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিহাস’ নামক গ্রন্থে বঙ্গবন্ধুর ছবি না দেওয়ায় ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগে একটি রিট আবেদন করা হয়েছিল। আদালত কিছু পর্যবেক্ষণ দিয়ে ওই রিট আবেদনটি নিষ্পত্তি করে রায় দিয়েছে।
তিনি বলেন, “সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণ হয়েছে। কিন্তু আদালতের নির্দেশে বইটি তুলে নিয়ে ধ্বংস করেছেন ও মহামান্য আদালতের কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়েছেন। তাছাড়া ইতিহাস বিকৃতির বিষয়টি ইচ্ছাকৃত ছিল না, অবহেলাজনিত। একারণে আদালত তাদের ভবিষ্যতের জন্য সতর্ক করে দিয়ে রিট মামলাটি নিষ্পত্তি করে দিয়েছেন।”
আতিউর রহমান বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর থাকার সময় ২০১৩ সালে এ বইয়ের পাণ্ডুলিপি তৈরি ও প্রকাশনার সিদ্ধান্ত হয়। এ বিষয়ে উপদেষ্টা ও সম্পাদনার জন্য দুটি কমিটি করা হয়।
বইটি প্রকাশের আগে সম্পাদনার দায়িত্বে বেশ কয়েকবার রদবদল হয়। সর্বশেষ এ দায়িত্বে ছিলেন ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক শুভংকর সাহা। তার আগে দায়িত্ব পালন করেন আরেক নির্বাহী পরিচালক মো. মাহাফুজুর রহমান। তারা দুজনই অবসরে গেছেন।
পাণ্ডুলিপি চূড়ান্ত করার পর ২০১৭ সালে ডিসেম্বরে প্রকাশিত হয় ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিহাস’। ২০১৮ সালের ২৫ মার্চ অনুষ্ঠানিকভাবে বইটির মোড়ক উন্মোচন করেন বর্তমান গভর্নর ফজলে কবির।
এরপর গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বইয়ে বঙ্গবন্ধুর নাম না থাকলেও আইয়ুব খানের নাম থাকার বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা উঠলে ওই বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর বইটি বিতরণ বন্ধের নির্দেশ দেন গভর্নর।
কিন্তু এরই মধ্যে কাজী এরতেজা হাসান হাই কোর্টে রিট আবেদন করলে তার প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গত বছর ২ অক্টোবর হাই কোর্ট রুল জারির পাশাপাশি একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠনের নির্দেশ দেয়।
‘বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিহাস’ বইয়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান, পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খানের ছবি থাকলেও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি অন্তর্ভুক্ত না করে ইতিহাস বিকৃতি করা কেন আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয় রুলে।
এদিকে কমিটি তদন্ত শেষে ২০১৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করে। তাতে ইতিহাস বিকৃতির জন্য বইটি সম্পাদনা কমিটি এবং গবেষণা ও পাণ্ডুলিপি প্রণয়ন কমিটির সদস্যদের গাফিলতিকে দায়ী করা হয়।
এর পরিপ্রেক্ষিতে হাই কোর্টে হাজির হয়ে নিঃশর্ত ক্ষমা চান বইটির সম্পাদক ও বাংলাদেশ বাংকের তৎকালীন নির্বাহী পরিচালক শুভংকর সাহা।
এরপর ওই রুলের শুনানি শেষে ২০১৯ সালের ১৯ জুন রায়ের তারিখ রাখে হাই কোর্ট।
কিন্তু রায়ের আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের আইনজীবী আজমালুল হোসেন আদালতকে বলেন, প্রকাশিত গ্রন্থে ত্রুটি ধরা পড়ার পর গভর্নর গ্রন্থটি বিতরণ বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং এটি রিভিউ করার জন্য ডেপুটি গভর্নরের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করেন। কিন্তু এসব তথ্য গোপন করে রিট আবেদনটি করেছেন কাজী এরতেজা হাসান।
তখন আদালত রায় ঘোষণা না করে আবেদনকারী কাজী এরতেজাকে তলব করলে আদালতে হাজির হয়ে আইনজীবীর মাধ্যমে এর ব্যাখ্যা দেন রিটকারী।
এরপর বৃহস্পতিবার রায় দিল হাই কোর্ট।
আরও পড়ুন
ইতিহাস বিকৃতি: ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিহাস’ বইয়ের সম্পাদকের ক্ষমা প্রার্থনা
‘বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিহাস’ বাজার থেকে সরানোর নির্দেশ
বাংলাদেশ ব্যাংকের বইয়ে ‘ইতিহাস বিকৃতি’ তদন্তের নির্দেশ হাই কোর্টের