শনিবার বঙ্গবন্ধু জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর আয়োজনের চতুর্থ দিন ‘তারুণ্যের আলোকশিখা’ থিমের ওপর বক্তৃতায় তিনি এ কথা বলেন।
মেট্রিক পরীক্ষা শেষে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজের শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় বড় পরিসরে বঙ্গবন্ধুর রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ার প্রসঙ্গ ধরে অধ্যাপক জাফর ইকবাল বলেন, “তার বয়স ছিল কম, কিন্তু তখনও তিনি অনেক বড় বড় দায়িত্ব পালন করতে শুরু করেছিলেন।
”বড় বড় নেতাদের বড় বড় কাজে সবসময় তার ডাক পড়ত। কাজের জন্য নয়, বুদ্ধি পরামর্শের জন্য। তার প্রায় অলৌকিক একটি রাজনৈতিক প্রতিভা ছিল।”
বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ’আমার দেখা নয়া চীন’ এবং ’কারাগারের রোজনামচা’ বইয়ের বিভিন্ন উদ্ধৃতি টেনে তারুণ্যের শেখ মুজিবকে ফুটিয়ে তোলেন জাফর ইকবাল।
স্কুল জীবনে সহপাঠীকে ছাড়িয়ে আনার গল্প, দাঙ্গা-দুর্ভিক্ষ মোকাবেলায় ভূমিকা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের পাশে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর ছাত্রত্ব হারানোর কথাও মনে করিয়ে দেন তিনি।
বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হওয়ায় স্কুলে বঙ্গবন্ধুর পড়াশোনায় ছেদ পড়েছিল। পরে সহপাঠীদের থেকে বয়সে বড় মুজিব স্বভাগতভাবেই তাদের নেতা হয়ে ওঠেন।
স্কুলের সহপাঠী মালেককে তিনি হিন্দু মহাসভার হাত থেকে ছাড়িয়ে আনতে গেলে মারামারি বেঁধে যায়। পরে দরজা ভেঙে তাকে ছাড়িয়ে আনা হয়।
বাবা শেখ লুৎফর রহমান মারামারির বিষয়ে জানতে চাইলে চুপ করে থেকে ঘটনার সত্যতা তুলে ধরেছিলেন বঙ্গবন্ধু।
সে প্রসঙ্গ টেনে জাফর ইকবাল বলেন, “যত কিছু ঘটুক, তার সত্যবাদিতায় কিন্তু কোনো ঘাটতি নাই। যাই হোক, বঙ্গবন্ধুকে জেল যেতে হল। সপ্তাহখানেক জেল খেটে জামিনে বেরিয়ে এলেন।
”তখন কি কেউ অনুমান করেছিল যে, দেশের মানুষের জন্য রাজনীতি করতে গিয়ে একটি নয়, দুটি নয়, ১৪টি বছর জেলে কাটাবেন! সে অভিজ্ঞতা নিয়ে তার লেখা বই ’কারাগারের রোজনামচা’র মত হৃদয়বিদারক বই খুব কম লেখা হয়েছে।”
ওই বই প্রসঙ্গে জাফর ইকবাল বলেন, “সেখানে তিনি যে শুধু নিজের দুঃসহ জীবনের কথা লিখেছেন তা নয়, গভীর মমতা দিয়ে সাধারণ কয়েদিদের জীবন বিশ্লেষণ করেছেন। কেউ যেন মনে না করে, তার শৈশবটুকু তিনি দুরন্তপনা করে কাটিয়েছেন।”
সব বিষয়ে আগ্রহ থেকে বঙ্গবন্ধু যে অল্প বয়সেই গভীর জ্ঞানের অধিকারী হয়ে উঠছিলেন, সে কথা তুলে ধরে জাফর ইকবাল বলেন, “কত অল্প বয়সে তিনি কত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন, সেটি এক কথায় খুব অবিশ্বাস্য। খেলাধুলায় খুব ভালো ছিলেন, পত্রপত্রিকা পড়ে সারাপৃথিবীর খবর রাখতেন, ইংরেজবিরোধী স্বদেশি আন্দোলনে আগ্রহ ছিল।”
১৯৩৮ সালে স্কুলের ছাত্র থাকা অবস্থায় বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এবং শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গোপালগঞ্জে এলে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে তোলার প্রসঙ্গও তুলে ধরেন জাফর ইকবাল।
তিনি বলেন, “বঙ্গবন্ধু খুব সুচারুভাবে তার দায়িত্ব পালন করলেন। শুধু তাই নয়, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী যখন তার স্কুল পরিদর্শন করতে এলেন, তখন মোটামুটি নাটকীয়ভাবে তার শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে পরিচয় হয়ে গেল।
”অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ সোহরাওয়ার্দী কিশোর বঙ্গবন্ধুকে দেখেই তার ভেতরে ভবিষ্যতের একজন রাজনীতিবিদকে আবিষ্কার করলেন। তিনি তার নাম-ঠিকানা নিয়ে গেলেন। শুধু তাই নয়, তাকে চিঠি লিখে বললেন, কলকাতা গেলে তার সাথে দেখা করতে। তার ভেতর গুরুশিষ্যের বন্ধন শুরু হয়েছিল, সেটি এক সময় বন্ধুত্ব এবং ধীরে ধীরে রাজনৈতিক সহকর্মীতে রূপ নেয়।”
কলেজের ছাত্র থাকার সময় বঙ্গবন্ধু কেমন ছিলেন, তা তুলে ধরতে গিয়ে তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীর শরণ নেন জাফর ইকবাল।
যেখানে বঙ্গবন্ধু লিখেছিলেন: ”আমি খুব রাগি ও একগুয়ে ছিলাম। কিছু বললে কড়া কথা বলে দিতাম। কারও কিছুর ধার ধারতাম না। আমাকে যে কাজ দেওয়া হত ,আমি নিষ্ঠার সাথে সে কাজ করতাম। কোনো দিন ফাঁকি দিতাম না। ভীষণভাবে পরিশ্রম করতে পারতাম। সেজন্য আমি খুব কড়া কথা বললেও কেউ আমাকে কিছু বলত না। ছাত্রদের আপদে বিপদে পাশে দাঁড়াতাম।
”কোন ছাত্র হোস্টেলে জায়গা পায় না, কার ফ্রি সিট দরকার, আমাকে বললেই প্রিন্সিপাল ড. জুবেরি সাহেবের কাছে হাজির হতাম। আমি অন্যায় আবদার করতাম না। তাই শিক্ষকরা আমার কথা শুনতেন। ছাত্ররাও আমাকে ভালোবাসত।”
জাফর ইকবাল বলেন, “ছাত্র জীবনে বঙ্গবন্ধুর কথা কল্পনা করলে ঠিক এই রকম একজন তরুণের চিত্র আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে না!”
“বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি কখনো পদের জন্য ছিল না। সেই তরুণ বয়স থেকে তার রাজনীতি ছিল মানুষের জন্য। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর জাপানিদের ভয়ে চার্চিল বাংলায় খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে দিলে এখানে একটা ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ শুরু হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু নিজের হোস্টেলে যে খাবার বাঁচে, সেটা বুভুক্ষুদের বসিয়ে ভাগ করে দেন। লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে লঙ্গরখানা খোলেন। দিনে একবার খাবার দিতেন।
”অনেকগুলো লঙ্গরখানা খুলে দিনরাত সেখানে কাজ করতেন। হোস্টেলে ফিরে আসার সময় পেতেন না। রাতে লীগ অফিসের টেবিলে শুয়ে থাকতেন।”
কিছুদিন পর দাঙ্গা শুরু হলে মানুষকে বাঁচাতে বঙ্গবন্ধুর ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রসঙ্গ ধরে জাফর ইকবাল বলেন, “হিন্দু নয়, মুসলমান নয়, মানুষকে বাঁচাতে হবে। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত, না খেয়ে, না ঘুমিয়ে, না বিশ্রাম করে পুরো এলাকা তিনি উল্কার মত ছুটে বেড়ালেন।
”যখন দাঙ্গা বন্ধ হয়েছে, তখন কাজ করতে করতে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। এটি প্রথমবার নয়, অমানুষিক পরিশ্রম করে কাজ করতে করতে অসুস্থ হয়ে যাওয়া তার জন্য নিয়মিত ব্যাপার।”
সেবার সুস্থ হওয়ার পর ইসলামিয়া কলেজ থেকে বিএ পরীক্ষা দিয়ে পাস করেন বঙ্গবন্ধু।
জাফর ইকবাল বলেন, “তরুণ বিএ পাস একজন ছাত্র, কিন্তু তার অভিজ্ঞতার ঝুলি অবিশ্বাস্য। মানুষের জন্য তার অবদান আকাশছোঁয়া। রাজনীতিতে পরিপক্ক, নেতৃত্বে ঈর্ষণীয়।”
তিনি বলেন, দেশভাগ হয়ে ‘পৃথিবীর বিচিত্রতম দেশ’ পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু ঢাকায় এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন।
”কিন্তু শিগগিরই চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করে দেওয়া হল। অন্য সবাই মুচলেকা দিয়ে তাদের ছাত্রত্ব ফিরে পেল, কিন্তু তেজস্বী বঙ্গবন্ধু রাজি হলেন না। তার আনুষ্ঠানিক ছাত্রজীবন এখানেই শেষ।”
জাফর ইকবাল বলেন, “বয়সের হিসাবে বঙ্গবন্ধুর তরুণ জীবনটি হয়ত তখন শেষ, কিন্তু তার বৈচিত্র্যময় তারুণ্যের জীবনটিতো কখনোই শেষ হয়নি। সেটি বোঝা যায়, যখন আমরা এদেশের শিশু-কিশোরদের চোখে তার জীবনের ব্যাখ্যাটি শুনি।”
‘গ্রাফিক নভেলে’ উঠে আসা বঙ্গবন্ধুকে দেখে আজকের তরুণ-তরুণী আর শিশু-কিশোরেরা তাকে ‘সুপার হিরো’ হিসাবে ভাবে বলে মন্তব্য করেন এই কথা সাহিত্যিক।
তিনি বলেন, “একজন কিশোর কিংবা তরুণ যেভাবে জানতে চায়, ঠিক সেভাবে যদি তাদেরকে বঙ্গবন্ধুর বর্ণাঢ্য জীবনটিতে শুধু একটিবার উঁকি দেওয়ানো যায়, তাহলে তার জীবনটি কি অন্য রকম হয়ে যাবে না!”
বঙ্গবন্ধুর জীবনকে নানাভাবে বিশ্লেষণ করা সম্ভব মন্তব্য করে জাফর ইকবাল বলেন, “আমরা যদি তারুণ্যের রঙিন চশমা দিয়ে তার জীবনটা দেখি, তাহলে কী দেখব? দেখব, এই অসাধারণ মানুষটি আপাদমস্তক একজন তরুণ। তিনি হলেন সত্যিকারের তারুণ্যের একটি জলন্ত আলোকশিখা।”
‘তারুণ্য মনের বয়স দিয়ে হয়’ মন্তব্য করে বঙ্গবন্ধুর ‘আমার দেখা নয়া চীন’ বই থেকে একটি ঘটনার উল্লেখ করেন জাফর ইকবাল।
সেখানে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন: ”বিদায়ের উদ্যোগ নিতেই ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা আমাকের জড়িয়ে ধরল। কারণ আমি ওদের একটু ঠাট্টা করেছিলাম, মুখ ভেঙচিয়ে দিয়েছিলাম। মনে করল, পেয়েছি মনের মত লোক। তাই আমাকে জড়িয়ে ধরল।
”আমি ওদের সাথে কিছু খেলা করে রওনা হলাম, আমার বন্ধুবান্ধবেরা আগে থেকে গাড়িতে উঠে বসে রয়েছে, মনে মনে বিরক্ত হলো বলে আমার মনে হল। কিন্তু কী করব, ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের আনন্দময় সঙ্গ যেন হুট করে ছেড়ে আসা যায় না। আমার স্বভাবও সে রকম না। ছেলেমেয়েদের সাথে মিশতে আমি ভালোবাসি।”
ইকবাল বলেন, “বঙ্গবন্ধুর বয়স তখন বত্রিশ। তিনি পুর্ণ বয়স্ক মানুষ। রাজনীতির জগতে তার সদর্প পদচারণা, তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও নেতৃত্বের ছটায় অনেক প্রবীণ নেতা ম্রিয়মান। পাকিস্তান সরকার তার ভয়ে থরথর কম্পিত। তার নিয়মিত জেলজীবন শুরু হয়েছে তখন।
”তার বয়স যতই হোক না কেন, মনের দিক থেকে তিনি সবসময় ছিলেন আপাদমস্তক তরুণ।”
শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক জাফর ইকবাল বলেন, “যে মনের দিক দিয়ে তরুণ সে যে শুধু মানুষের সাথে মিশতে পারে তা নয়, সে মানুষ একজন তরুণের মত তার জীবনের সমস্যাগুলো বুঝতে পারে। তাই স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণীদের শিক্ষার দিকে নজর দিয়েছিলেন।”
বঙ্গবন্ধুকে সত্যিকারভাবে ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা ‘কারো নেই’ মন্তব্য করে জাফর ইকবাল বলেন, “এই রকম একটা অবস্থায় এলে আমরা সবসময় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথে শরণাপন্ন হই। মনে হয় বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ্য করে তিনি লিখেছিলেন:
”চিরযুবা তুই যে চিরজীবী,
জীর্ণ জরা ঝরিয়ে দিয়ে
প্রাণ অফুরান ছড়িয়ে দেদার দিবি।”
জাফর ইকবাল বলেন, “বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে ফিদেল কাস্ত্রো বলেছিলেন, আমি হিমালয়কে দেখিনি, তবে আমি বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি।
”পৃথিবীর ইতিহাসে ফিদেল কাস্ত্রো নিজেই একজন হিমালয়। তার কাছে যদি বঙ্গবন্ধুকে হিমালয়ের সমান মনে হয়, তাহলে বঙ্গবন্ধুর সত্যিকারের মূল্যায়নটুকু কী হতে পারে, আমরা সেটা খুব সহজেই অনুমান করতে পারি।”
তিনি বলেন, “আমাদের কত বড় সৌভাগ্য পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ট একজন নেতার হাত ধরে আমরা আমাদের মাতৃভূমিটাকে পেয়েছিলাম। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা অনেক সময় খুব দূরের একজন রহস্যময় মানুষ হিসাবে থেকে যান। কিন্তু বঙ্গবন্ধু আমাদের খুব কাছের একজন মানুষ।”