ক্যাটাগরি

বিরাণভূমিতে যার হাত ধরে ফিরল প্রাণ

অবকাঠামো উন্নয়ন কিংবা বাণিজ্য সম্প্রসারণ থেকে শুরু করে রপ্তানি বাড়িয়ে বৈদেশিক আয় বৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে মনোযোগ দিলেন তিনি। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অল্প সময়েই ৭ দশমিক ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধির হারে পৌঁছায়।

সেই ধারা থমকে গিয়েছিল ইতিহাসের নৃশংস এক হত্যাকাণ্ডে। বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পর বাংলাদেশের উল্টোযাত্রা শুরু হয়েছিল।

নানা ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ যখন স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের স্বীকৃতি পেল, সরকারের নেতৃত্বে তখন তারই মেয়ে শেখ হাসিনা; আর বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর মাহেন্দ্রক্ষণে।

বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী আর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের পঞ্চম দিন রোববার বাংলাদেশ স্মরণ করল সেই শেখ মুজিবকে, যার হাত দিয়ে আজকের অগ্রযাত্রার ভিত রচনা হয়েছিল।  জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে এ অনুষ্ঠানের থিম ছিল ‘ধ্বংসস্তূপে জীবনের জয়গান’।

তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে নির্ধারিত বিষয়ের ওপর আলোচনায় অংশ নেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সাবেক অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন।

জর্ডানের বাদশা দ্বিতীয় আবদুল্লাহ বিন আল হোসেইন এদিন বাংলাদেশকে শুভেচ্ছা জানিয়ে ভিডিও দেন।

 

সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে উন্নয়নের এমন কোনো ক্ষেত্র ছিল না, যেখানে বঙ্গবন্ধুর ছোঁয়া লাগেনি।

“আজ বদলে যাওয়া বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যা কিছু হচ্ছে, তার সবকিছুরই ভিত্তি রচনা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু।”

যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের ভবিষ্যত নিয়ে বিদেশি পর্যবেক্ষকরা যখন শোনাচ্ছিলেন হতাশার বাণী, সেই তখনই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মাটি আর মানুষের শক্তিতে ভর করে ঘুরে দাঁড়ানোর এক দুঃসাহসিক পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমে পড়েছিলেন।

সেই গল্প শোনাতে গিয়ে ইতিহাসবিদ অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ নিয়ে লেখা ‘বাংলাদেশ: দ্য টেস্ট কেইস অব ডেভেলপমেন্ট’ থেকে উদ্ধৃত করেন।

“তারা বলেছিলেন, বাংলাদেশের উন্নয়ন পৃথিবীর কঠিনতম সমস্যা। বাংলাদেশে যদি উন্নয়ন হয়, তাহলে পৃথিবীর সব দেশে উন্নয়ন হবে। বাংলাদেশের উন্নয়ন করতে অন্তত দুইশ বছর লাগবে। এই বাংলাদেশ পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। তার মাটি আর মানুষ দিয়েই বঙ্গবন্ধুর যাত্রা শুরু হয়েছিল।”

১৯৭২ এর ২৬ মার্চ প্রথম স্বাধীনতা দিবসে বেতার ভাষণে বঙ্গবন্ধু বললেন, “আজ আমাদের সামনে পর্বততুল্য সমস্যা উপস্থিত। মহাসঙ্কটের ক্রান্তি লগ্নে আমরা উপস্থিত হয়েছি। বিদেশ ফেরত এক কোটি উদ্বাস্তু। স্বদেশের বুকে দুই কোটি গৃহহারা মানুষ। বিধ্বস্ত কর্মহীন চট্টগ্রাম পোতাশ্রয়, নিশ্চল কারখানা, নির্বাপিত বিদ্যুৎ সরবরাহ, অসংখ্য বেকার, অপরিমিত অরাজকতা, বিশৃঙ্খল বাণিজ্যিক সরবরাহ ব্যবস্থা, ভগ্ন সড়ক-সেতু, বিচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা। দারিদ্র্য, খাদ্যাভাব, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধগতি এবং অকর্ষিত ভূমি- এই সবকিছুই আমরা পেয়েছি উত্তরাধিকার সূত্রে।

“জনগণের গভীর ভালোবাসা, আস্থা, অদম্য সাহস ও অতুলনীয় ঐক্যকে সঙ্গী করে আমার সরকার এই সঙ্কটকে কাটিয়ে উঠার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করবে।”

অধ্যাপক আনোয়ার বলেন, যে চ্যালেঞ্জ বঙ্গবন্ধু সেদিন নিয়েছিলেন, ঘাতকের হাতে প্রাণ যাওয়ার আগে মাত্র চার বছরের জীবনেই তার সফল বাস্তবায়ন শুরু করতে পেরেছিলেন তিনি।

বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগগুলো বিশ্লেষণ করে তিনি বলেন, অভ্যন্তরীণ পুনর্গঠনের সূচনা হয়েছিল মাত্র ৯ মাসের মধ্যে একটি সংবিধান প্রণয়নের মধ্য দিয়ে। অথচ সংবিধান প্রণয়নে পাকিস্তানের সময় লেগেছিল ১০ বছর।

“তখন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন ছিল বিশ্ব সম্প্রদায়ের স্বীকৃতি। সেজন্য বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারির ভাষণে এক দিকে স্বীকৃতির আবেদন জানিয়েছেন, অন্যদিকে ঋণ সাহায্যের জন্য আকুল আবেদন করেছেন। ১৯৭৫ এর ১৫ অগাস্টের মধ্যে ১৩৪টি দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। চীন, সৌদি আরব, জর্ডান, ইরাক স্বীকৃতি না দিলেও এইসব দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রস্তুতি পর্ব বঙ্গবন্ধুর আমলেই শেষ হয়েছিল।”

বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রশংসা করে জর্ডানের বাদশার পক্ষে দেশটির উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আয়মান আল সাদাফি এক ভিডিও বার্তায় বলেন, “গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশ সর্বক্ষেত্রে অসাধারণ অগ্রগতি অর্জন করেছে, যার মাধ্যমে দেশের জনগণের সহনশীলতা ও নেতৃত্বের প্রজ্ঞা প্রতিফলিত হয়েছে।

“আমি আত্মবিশ্বাসী, শান্তি বজায় রাখা, আরও উন্নয়ন এবং জনগণের সক্ষমতা কাজে লাগানোর মাধ্যমে ভবিষ্যতে আরও বেশি অগ্রগতি অর্জন করবে বাংলাদেশ।”

সাংস্কৃতিক আয়োজন

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পর্বে চীনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সঙ্গে ছিল ‘মুজিব চিরন্তন’ প্রতিপাদ্যের ওপর টাইটেল অ্যানিমেশন ভিডিও।

এরপর ‘ক্যানভাসে বঙ্গবন্ধুর সাড়ে তিন বছর: শূন্য থেকে মহাশুন্যে’, ‘বঙ্গবন্ধুর নবজীবনের ডাক: ধূসর বাংলা থেকে সবুজ বাংলা’, ‘বিশ্বনেতা ও বিশ্বনাগরিকের সাথে মেলবন্ধন’ এবং ’নারী জাগরণ ও নারীর ক্ষমতায়নে বঙ্গবন্ধু’ শীর্ষক কোরিওগ্রাফি দেখানো হয়।

‘শিশু বিকাশে বঙ্গবন্ধু: আলো আমার আলো’ নামে ১০০ জন শিশু শিল্পীর একটি পরিবেশনাও ছিল অনুষ্ঠানে।

সাংস্কৃতিক আয়োজনের একটি অংশে ’২৮৮ দিন’ শিরোনামের নাটকে ফিরিয়ে আনা হয় মুক্তিযুদ্ধকালে বঙ্গবন্ধুর সর্বশেষ কারাজীবনের স্মৃতি।

আমিনুর রহমান মুকুলে নির্দেশনায় আসাদুল ইসলাম রচিত নাটকে ফাঁসির রশি সামনে রেখেও দৃঢ়চেতা বঙ্গবন্ধুকে তুলে ধরা হয়।

১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে বিজয়ের খবর কানে আসছিল, নাটকে তখন বঙ্গবন্ধু বলছিলেন: ”নমো নমো নম, সুন্দরী মম জননী জন্মভূমি। গঙ্গার তীর, স্নিগ্ধ সমীর জীবন জুড়ালে তুমি।”

কারাগারের ভেতরে পাকিস্তানিরা যখন ভয়ার্ত পরিবেশের সূচনা করছিল, তখন বঙ্গবন্ধু তাদের স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন: “হত্যার ভয় আমাকে বারবার দেখাইও না, আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান। মুসলমান একবার মরে, দু’বার মরে না।”

মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর জুলফিকার আলী ভুট্টো যখন ‘পাকিস্তান পুনরুদ্ধারে’ যৌথ বিবৃতির আহ্বান নিয়ে এলেন, বঙ্গবন্ধু তাকে ফিরিয়ে দেন।

নাটকে বঙ্গবন্ধুকে দৃঢ়কণ্ঠে  বলতে দেখা যায়: ”মিস্টার ভুট্টো, ওইসব ডিপ্লোমেসি বাদ দাও, আমি তোমাদের মত বিলেত, আমেরিকা থেকে ডিগ্রি নিয়ে রাজনীতিতে আসি নাই। আমি বাংলার কাদামাটি থেকে উঠে আসা রাজনীতিবিদ,  আমি আগে আমার দেশে যাব, আমার লোকজনদের সাথে কথা বলব, তারপর তুমি তোমার প্রস্তাবের জবাব পাবা।”

নাটকের শেষাংশে ফুটিয়ে তোলা হয় ’জয়বাংলা’ স্লোগানে মুখর জনতার মাঝে বঙ্গবন্ধুর সেই স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দৃশ্যপট।

আন্তর্জাতিক সংগীত ধারার সঙ্গে সমন্বয় রেখে ব্যান্ড সংগীতের পরিবেশনার মধ্য দিয়ে শেষ হয় পঞ্চম দিনের আয়োজন।

ষষ্ঠ দিনের থিম ‘বাংলার মাটি আমার মাটি’

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন উপলক্ষ্যে ‘মুজিব চিরন্তন’ প্রতিপাদ্যে ১০ দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার ষষ্ঠ দিন সোমবারের অনুষ্ঠানের থিম ‘বাংলার মাটি আমার মাটি’।

জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে এ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধান অতিথি থাকবেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। সম্মানিত অতিথি হয়ে বাংলাদেশের উদযাপনের সঙ্গী হবেন নেপালের রাষ্ট্রপতি বিদ্যা দেবী ভাণ্ডারী।

অনুষ্ঠানের প্রথম পর্বে আলোচনা চলবে বিকাল সাড়ে ৪টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত। মাঝে আধা ঘণ্টার বিরতি দিয়ে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় শুরু হবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, চলবে রাত ৮টা পর্যন্ত। অনুষ্ঠানটি টেলিভিশন, বেতার, অনলাইন ও সোশ্যাল মিডিয়ায় সরাসরি সম্প্রচার করা হবে।