পাড়ার পাশে দুটি ছড়া থাকলেও তাতে হাঁটুসমান ময়লা পানি রয়েছে, তাও দুর্গন্ধযুক্ত। পানির ওপরের স্তর বিভিন্ন পচা বুনো লতাপাতায় ঢাকা। এছাড়া খাওয়ার পানির জন্য রয়েছে ছোট মাত্র একটি কূয়ো। বর্ষা বাদ দিলে বছরের আট মাসই তাদের পানির সংকটে থাকতে হয়।
জেলার রোয়াংছড়ি উপজেলার তারাছা ইউনিয়নে এই পাড়ায় ‘বহুদিন ধরে পানির অভাব সকলকে ভোগাচ্ছে’ বলে জানিয়েছেন পাড়াপ্রধান নংলং খুমিসহ সংশ্লিষ্টরা।
বিষয়টি উপজেলা প্রশাসন জানে না; কিংবা কেউ কখনও তাদের জানায়নি। এছাড়া পানির এই সমস্যা দূর করার কোনো উপায়ও দেখতে পাচ্ছে না বলে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের ভাষ্য।
নংলং খুমি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “পানির অভাব পাড়ার ১৮টি পরিবারকে বহুদিন ধরে ভোগাচ্ছে। নোংরা পানি খেয়ে নানা রকম রোগবালাই লেগে থাকে সারা বছর। সুপেয় পানি পাওয়া যায় এমন কোনো জায়গা পেলে পাড়া ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাওয়ার পরিকল্পা রয়েছে পাড়াবাসীর।”
সম্প্রতি পাড়ায় গিয়ে দেখা গেছে, বনের বাঁশ-কাঠ ও ছন দিয়ে তৈরি সারি সারি ঘর। বেশির ভাগ ঘরে রয়েছে সোলার প্যানেল। প্রতিটি ঘর মাচাংয়ের আদলে। ঘরের পাশেই ছোট করে তৈরি করা হয়েছে আরেকটি ঘর; যেখানে রয়েছে সারা বছরের জ্বালানি কাঠের স্তূপ। কিছুটা দুর্গম হলেও বেঁচে থাকার জন্য এমন আয়োজন গড়ে তুলেছেন তারা। কিন্তু আশপাশে কোথাও নেই সুপেয় পানি।
পাড়ার পাশে দুটি ছড়া রয়েছে। তাতে হাঁটুসমান পানি। ময়লা রয়েছে। দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। পানির ওপরের স্তর বিভিন্ন পচা বুনো লতাপাতায় ঢাকা। এই পানিতেই সারা দিনের পরিশ্রম শেষে গোসল সারেন তারা।
পাড়ার বাসিন্দা সুনে খুমি বলেন, “শীতের দিনে গোসল না করলেও চলে। গরমের দিনে তা সম্ভব নয়। জুমক্ষেতে কাজ করে প্রচুর ঘাম ঝরে। দিন শেষে গোসল না করলে হয় না। বাধ্য হয়ে এই পানিতে গোসল করতে হয় আমাদের। ময়লা ও দুর্গন্ধ হলেও একমাত্র ভরসা ছড়ার এই সামান্য পানিটুকুই। তাছাড়া ছড়ার পাশে সামান্য একটা কুয়ো রয়েছে। তাও ঘোলা ও অপরিষ্কার। এই পানিই খায় পাড়াবাসী। নোংরা ও স্বাস্থ্যসম্মত নয় জেনেও খেতে হয়।”
পাড়ার বাসিন্দা ষাট বছর বয়সী রেলুং খুমি বলেন, “আধঘণ্টা হেঁটে একটি মরা ছড়ায় গিয়ে কোনো রকমে গোসল করা যায়। কিন্তু খাওয়ার পানির মারাত্মক সমস্যা। কাড়াকাড়ি করে একটা ছোট কুয়া থেকে পানি সংগ্রহ করে খেয়ে বেঁচে থাকতে হচ্ছে।
“পানি সংগ্রহ ও গোসল করতে আসা-যাওয়ার মধ্যে প্রতিদিন এক ঘণ্টা সময় চলে যায়। ওই পানিটাও বিশুদ্ধ নয়। ঘোলা এবং ময়লা। আতঙ্কে থাকি। বর্ষাকাল ছাড়া পাড়ার আশপাশে কোথাও পানি থাকে না। এভাবে বছরের আট মাস কষ্ট করে খুব অমানবিকভাবে বেঁচে থাকতে হয়।”
পাড়ার এক নারী বলেন, “সবাই পানির সংকটে ভুগলেও নারীদের সমস্যা আলাদা। সংসারের রান্নার কাজ থেকে শুরু করে বাচ্চা লালন-পালন নারীদেরই করতে হয়। এক্ষেত্রে পানির সমস্যায় তিক্ত পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। নারী ও শিশুদের ভয়ংকর সমস্যায় পড়তে হয়।”
পাড়াবাসী জানান, ছোটবেলা থেকে বর্ষাকাল ছাড়া পানিশূন্য দেখে আসছেন তারা। এরপরও ২০-৩০ বছর আগে পানি পরিষ্কার ছিল। এখন দিন দিন কমে যাচ্ছে এবং নোংরা হচ্ছে।
”এভাবে চলতে থাকলে এ পাড়ায় আমরা বেশি দিন টিকতে পারব না। এজন্য সবাই মিলে জায়গা খুঁজছি অন্য কোথাও চলে যাওয়ার জন্য,” বললেন সোনো খুমি নামে এক বাসিন্দা।
এ পাড়ার পাশে অংতং খুমিপাড়া নামে ২২ পরিবারের আরেকটি পাড়ায়ও একই রকম পানির সমস্যা রয়েছে বলে জানান নংলং খুমি।
পানির অভাবের কারণ পরিবেশ বিপর্যয় ও মানুষের অসচেতনতাকে দায়ী করছেন বন ও ভূমি অধিকার সংরক্ষণ আন্দোলন বান্দরবান জেলা শাখার সভাপতি জুয়ামলিয়ান আমলাই।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “ছড়ার আশপাশে পানির উৎস ধরে রাখে এমন কতকগুলো গাছ থাকতে হয়। সেই সঙ্গে অবশ্যই পাথরও থাকতে হয়। সেগুলো কেটে ফেলেছে মানুষ।”
পানির এই সমস্যা দূর করার কোনো উপায় দেখতে পাচ্ছে না জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর।
অধিদপ্তরের সহকারী প্রকৌশলী খোরশেদ আলম প্রধান বলেন, ভৌগলিকভাবে পাহাড়ি অনেক এলাকা পাথুরে হওয়ায় গভীর নলকূপ ও রিংওয়েল বসানো যায় না। এছাড়া পানি সরবরাহের অন্য উপায় হল গ্র্যাভিটি ফ্লোর সিস্টেম। তাও উপযুক্ত জায়গায় পানির উৎস থাকতে হবে।
পানির অভাবে পড়া এলাকাগুলো তারা পরিদর্শন করে দেখবেন বলে তিনি জানান।
রোয়াংছড়ি ইউএনও মো. আব্দুল্লাহ আল জাবেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ওই পাড়ার কেউ বিষয়টি তাকে জানায়নি। জনস্বাস্থ্য বিভাগকে জানিয়েছে কিনা তাও জানা নেই। তিনি খবর নেবেন।