আব্দুল্লাহ আল মামুন নামের এক ব্যক্তি
নিজেকে ডা. ইকবালের ‘ভক্ত ও শুভাকাঙ্ক্ষী’ পরিচয় দিয়ে গত ১০ মার্চ খুলনার মুখ্য মহানগর
হাকিম আদালতে এক হাজার কোটি টাকার ওই ‘মানহানি’ মামলার আবেদন করেন।
খুলনার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের
বিচারক মো. শহিদুল ইসলাম অভিযোগ তদন্ত করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই)
প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দিয়েছেন। এ বিষয়ে পরবর্তী তারিখ রাখা হয়েছে ৬ জুলাই।
এর আগে ১৪ মার্চ একই দাবিতে একই
ধরনের একটি মামলার আবেদন ‘গ্রহণযোগ্য প্রতীয়মান না হওয়ার’ খারিজ করে দেয় বরিশালের
অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম আদালত।
বরিশালের মতই খুলনার মামলার আবেদনে
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদী, হেড অব ইংলিশ নিউজ
অরুণ দেবনাথ, বার্তা সম্পাদক জাহিদুল কবির এবং বার্তা সম্পাদক মুনীরুল ইসলামকে বিবাদী
করা হয়েছে।
এইচ বি এম ইকবাল: বরিশালে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরের বিরুদ্ধে মামলার আবেদন খারিজ
প্রতিবেদন মুছতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরকে চাপ: ‘মানহানির’ অভিযোগের বিষয়ে আদেশ পেছাল
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরের প্রতিবেদন মুছতে চাপের পর এবার মামলার আবেদন
এইচ বি এম ইকবাল: এক যুগ আগের রায়ের খবর নিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরকে উকিল নোটিস
প্রিমিয়ার গ্রুপ অব কোম্পানিজের চেয়ারম্যান
সাবেক এমপি বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. এইচ বি এম ইকবাল এবং তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে
গত দেড় দশকে বিভিন্ন সময়ে যেসব মামলা হয়েছে, তার কার্যক্রম আর আদালতের আদেশ নিয়ে অন্য
সব সংবাদমাধ্যমের মতো বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমেও প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। সেসব
মামলা থেকে তারা অব্যাহতিও পেয়েছেন।
এখন এতদিন পর সেসব পুরনো প্রতিবেদন
মুছতে নানাভাবে চাপ দেওয়া হচ্ছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে।
অযৌক্তিক ওই চাপে নত না হওয়ায় গত
জানুয়ারির শেষ দিকে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরের চার জ্যেষ্ঠ সম্পাদকের নামে উকিল নোটিস
পাঠান কাজী নাসির উদ্দিন বাবুল নামে বরিশালের এক ব্যক্তি, যিনি নিজেকে ডা. ইকবালের
‘বন্ধু’ হিসাবে পরিচয় দেন।
সে সময় বাদীর আইনজীবী এবং ডা. ইকবালের
সঙ্গে কথা বলে ২ ফেব্রুয়ারি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।
সেই সঙ্গে আইনজীবীর মাধ্যমে উকিল নোটিসের জবাব দেওয়া হয়।
এরপর বিভিন্ন জেলা থেকে একই ভাষায়
ডজন ডজন উকিল নোটিস পাঠিয়ে হুমকি দেওয়া শুরু হয়, যার মধ্যে খুলনার আব্দুল্লাহ আল মামুনের
আইনজীবীর পাঠানো একটি নোটিসও ছিল।
একই ভাষায় ভিন্ন ভিন্ন নামে ভিন্ন
ভিন্ন জেলা থেকে পাঠানো সেসব নোটিসের মূল বক্তব্য ছিল, বরিশাল থেকে পাঠানো নোটিসের
দাবি অনুযায়ী পুরনো প্রতিবেদন না মুছে সে বিষয়ে নতুন প্রতিবেদন প্রকাশ করায় ডা. ইকবালের
‘সম্মানহানী’ হয়েছে। সুতরাং ২ ফেব্রুয়ারির ওই প্রতিবেদন এবং পুরনো প্রতিবেদনগুলো না
সরালে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম সেসব নোটিসেরও
জবাব দেয়। তারই মধ্যে প্রথমে বরিশালের আদালতে মামলার আবেদন হয়।
সেখানে বলা হয়, ডা. ইকবাল ও তার পরিবারের
সদস্যরা ওইসব মামলায় খালাস পেয়ে গেলেও মামলার কার্যক্রম নিয়ে ২০০৭, ২০০৮, ২০১০, ২০১৫
ও ২০১৭ সালে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে প্রকাশিত পুরনো প্রতিবেদনগুলো অনলাইনে থেকে
যাওয়ায় দেশ-বিদেশে ডা. ইকবাল ও তার পরিবারের ‘সম্মানহানি হচ্ছে’।
গত ১৪ মার্চ বরিশালের আদালতে ওই আবেদন
খারিজ হয়ে যায়। তার চার দিন আগে খুলনার আদালতে ডা. ইকবালের ‘ভক্ত’ আব্দুল্লাহ আল মামুনের
‘মানহানি’ মামলার আবেদন জমা পড়ে।

নিজেকে ‘খুলনা শহরের একজন প্রতিষ্ঠিত মৎস্য ব্যবসায়ী’ হিসেবে পরিচয় দেওয়া মামুন তার আর্জিতে বলেন, “বাংলাদেশের অন্যতম প্রথিতযশা ব্যবসায়ী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. এইচ বি এম ইকবাল ও তার পরিবারবর্গকে নিয়া ‘এইচ বি এম ইকবাল: এক যুগ আগের রায়ের খবর নিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরকে উকিল নোটিস’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ ও প্রচার করার অন্তরালে বিগত ২৮/০৮/২০১০ ইং তারিখে ‘AL leaders relieved from 2001 murder case’ এবং ০৯/০৩/২০১৭ সালের ‘Ex-MP Iqbal’s wife, three children appeal against conviction in ACC case’ শিরোনামে সংবাদসমূহ জনাব ইকবাল সাহেব ও তাহার পরিবারবর্গের মানহানীর হীন উদ্দেশ্যে পুনরায় প্রচার করিয়াছেন।”
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম ওই প্রতিদেন
প্রকাশ করেছিল বরিশাল থেকে কাজী নাসির উদ্দিন বাবুলের পাঠানো উকিল নোটিস পাওয়ার পর।
ওই নোটিসের সঙ্গে ‘AL leaders relieved from 2001 murder case’ এবং ‘Ex-MP Iqbal’s
wife, three children appeal against conviction in ACC case’ শিরোনামের প্রতিবেদন
দুটির অনুলিপিও পাঠানো হয়েছিল।
যেহেতু ওই নোটিস প্রাপ্তি নিয়েই প্রতিবেদন,
সেহেতু স্বাভাবিকভাবেই ওই প্রতিবেদন দুটির প্রসঙ্গ আসে। তাহলে কেন খুলনার ব্যবসায়ী
মামুনের তা ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ মনে হল, তার কোনো ব্যাখ্যা তার এজাহারে নেই।
কাজী নাসির উদ্দিন বাবুলের আইনজীবী
অ্যাডভোকেট আতিকুর রহমান জুয়েলের নাম উল্লেখ করে মামুনের মামলার আর্জিতে বলা হয়, “উক্ত
সংবাদে আসামিরা অ্যাডভোকেট আতিকুর রহমান জুয়েলের নোটিসের জবাব প্রদান না করিয়া মানহানীর
উদ্দেশ্যে প্রকৃত ঘটনা গোপন রেখে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন সংবাদ পরিবেশন করেছেন যাহা আমার
শুভাকাঙ্ক্ষী বীর মুক্তিযোদ্ধা এইচবিএম ইকবাল ও তার পরিবারের জন্য চরম মানহানিকর।”
নাসির উদ্দিন বাবুলের পক্ষে অ্যাডভোকেট
জুয়েলের পাঠানো নোটিসের জবাব যে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম দিয়েছে, তা বাবুলের করা
মামলার আর্জিতেই স্বীকার করা হয়েছিল। আর ওই মামলার আবেদন নিয়ে গত ২৫ ফেব্রয়ারি বিডিনিউজ
টোয়েন্টিফোর ডটকম যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল, সেখানেও বিষয়টির উল্লেখ ছিল।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরের
প্রতিবেদনের কোন অংশ ‘মিথ্যা বা ভিত্তিহীন’? ডা. ইকবালের মামলার কার্যক্রম ও আদালতের
আদেশ নিয়ে সব গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের জন্য কেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের
বিরুদ্ধে ‘উদ্দেশ্যমূলক সম্মানহানী’ ঘটানোর অভিযোগ আনা হচ্ছে? – এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে
বাদী আব্দুল্লাহ আল মামুনের আইনজীবী এ এম আহম্মদ উল্লাহর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।
কিন্তু এ বিষয়ে তিনি
কোনো কথা বলতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।
‘না জানিয়েই’ নাম দিয়েছে, বললেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরের বিরুদ্ধে মামলার ‘সাক্ষী’
প্রতিবেদন মুছতে চাপ: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরকে সেই উকিল নোটিস কে পাঠাল?
‘আইনিভাবেই
মোকাবেলা’
পেশাগত দায়িত্ব পালনে প্রভাবশালী
ব্যক্তিদের এই চাপের বিষয়গুলো সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরতে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি একটি সংবাদ
সম্মেলন করেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদী।
সেখানে তিনি বলেন, প্রতিবেদনে কোথাও
ভুল হলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম তা স্বীকার করব, সংশোধন করার প্রয়োজন হলে সাংবাদিকতার
নিয়ম মেনে তাও করবে। কিন্তু চাপের কাছে নতি স্বীকার করে কোনো খবর তুলে নেওয়া হবে না।
“বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের নিজস্ব
কোনো অনুসন্ধান এসব প্রতিবেদনে নেই; সম্পূর্ণভাবে মামলার কার্যক্রম ও আদালতের আদেশই
সেখানে বস্তুনিষ্ঠভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। তাহলে কোন যুক্তিতে একটি সংবাদমাধ্যম এসব প্রতিবেদন
সরিয়ে ফেলবে?”
“আমাদের বার বার বলা হয়েছে, অন্যরাও
নাকি এ বিষয়ে তাদের প্রতিবেদন সরিয়ে ফেলেছে। বিভিন্নভাবে তদবির করানো হয়েছে প্রভাবশালীদের
দিয়ে, যাদের মধ্যে গণমাধ্যম সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিও আছেন। বলা হয়েছে, তারা সরিয়ে ফেলেছেন,
আমরা কেন তা করছি না। দীর্ঘদিন নানাভাবে চেষ্টার পরও প্রতিবেদন সরাতে রাজি করাতে না
পেরে এখন তারা চাপ দেওয়ার অদ্ভুত এক কৌশল নিয়েছেন।”
যেসব খবর সরিয়ে ফেলার জন্য চাপ দেওয়া
হচ্ছে, সেগুলোর একটি তালিকাও সেদিন সাংবাদিকদের সরবরাহ করে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের লিখিত
বিবৃতিতে সেদিন বলা হয়, “এসব নোটিস পাঠাচ্ছেন কারা? যার সংক্ষুব্ধ হওয়ার কথা তিনি নন,
অন্য কেউ। এর উদ্দেশ্য আমাদের হয়রানি করা; ভয় দেখানো, যাতে আমরা প্রতিবেদনগুলো সরিয়ে
নেওয়ার কথা ভাবি। এবং তাদের বিষয়ে ভবিষ্যতে খবর প্রকাশের ক্ষেত্রেও আমরা যেন ভয়ে থাকি।”
এ ধরনের চাপের কাছে নতি স্বীকার না
করার প্রত্যয় জানিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক সেদিন বলেন, বিডিনিউজ
টোয়েন্টিফোর ডটকম আইনি পথেই লড়বে।
“বিচারকতো অন্ধ নন। বিচারকতো জানেন,
বিচারকতো দেখবেন যে, আসলে এটা গ্রহণযোগ্য মামলা কি-না।”
সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধের চেষ্টা: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরের বিবৃতি
চাপে নত হব না: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরের প্রধান সম্পাদক
সাংবাদিক
সংগঠনগুলোর নিন্দা
পুরনো প্রতিবেদন মুছে ফেলার জন্য
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে এভাবে চাপ দেওয়ার বিষয়টিকে ‘অনৈতিক’ হিসেবে বর্ণনা করে
ইতোমধ্যে নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে সারা দেশের সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন।
বিএফইউজে-বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক
ইউনিয়ন চাপ প্রয়োগকারীদের চিহ্নিত করে ‘শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার’ দাবি জানিয়েছে।
ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন বলেছে, “বিডিনিউজ
টোয়েন্টিফোরসহ গণমাধ্যমের ওপর অনৈতিক চাপ প্রয়োগ উদ্বেগজনক।”
চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়ন (সিইউজে),
বাগেরহাট প্রেসক্লাব, চাঁদপুর প্রেস ক্লাব, নেত্রকোণা জেলা প্রেস ক্লাব, দিনাজপুর প্রেস
ক্লাব, দিনাজপুর সাংবাদিক ইউনিয়ন, রংপুর ফটোজার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন, শার্শা উপজেলা
রিপোর্টার্স ক্লাব বিবৃতি দিয়ে বলেছে, এ ধরনের চাপ সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের
শামিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি
(ডুজা), চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি (চবিসাস), সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান
ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস ক্লাব, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসক্লাব, জাহাঙ্গীরনগর
বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি (জাবিসাস), স্ট্যামকোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক ফোরাম,
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি (বেরোবিসাস), নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি (নোবিপ্রবিসাস) এবং সারাদেশে সাংবাদিকতা বিভাগে পড়ুয়া
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের সংগঠন বাংলাদেশ জার্নালিজম স্টুডেন্টস কাউন্সিলও (বিজেএসসি)
আলাদা বিবৃতিতে এ ধরনের চাপের নিন্দা জানিয়ে সেইসব প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা
নেওয়ার জন্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।