পাশাপাশি ভুটানে জল-বিদ্যুৎ উৎপাদনে ভারতকে সঙ্গে নিয়ে ত্রিপক্ষীয় সহযোগিতার বিষয়েও দুই সরকারপ্রধান ঐকমত্যে পৌঁছেছেন বলে জানিয়েছেন তিনি।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর আয়োজনে যোগ দিতে ঢাকায় আসা ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং বুধবার সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তার কার্যালয়ে সাক্ষাৎ করেন।
দুই নেতার বৈঠকের পর দুপুরে ফরেইন সার্ভিস একাডেমি মিলনায়তনে ওই বৈঠকের বিভিন্ন দিক সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
তিনি বলেন, “উভয় নেতা দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সার্বিক দিক পর্যালোচনা করেন এবং উভয় দেশের বিভিন্ন সম্ভাবনার ক্ষেত্রগুলোতে পারস্পারিক সহযোগিতা বৃদ্ধির বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেন।”
শেখ হাসিনা ও লোটে শেরিংয়ের আলোচনায় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, সড়ক, রেল ও বিমান যোগাযোগ, জল-বিদ্যুৎ, দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় সহযোগিতা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি, সংস্কৃতি এবং দুই দেশের জনগণের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধির বিষয়গুলো এসেছে বলে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং বুধবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তার কার্যালয়ে সৌজন্য সাক্ষাত করেন। ছবি: পিএমও
গতবছর ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ও ভুটানের মধ্যে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি (পিটিএ) স্বাক্ষর হওয়ায় দুই প্রধানমন্ত্রী সন্তোষ প্রকাশ করেছেন জানিয়ে মোমেন বলেন, “তারা আশা প্রকাশ করেছেন, দুই দেশের বাণিজ্য সম্প্রসারণে এ চুক্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।”
বাংলাদেশ ও ভুটানের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী ফরেন অফিস কনসালটেশন (এফওসি) এবং বাণিজ্য সচিব পর্যায়ের বৈঠক যত দ্রুত সম্ভব অনুষ্ঠানের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “তারা আন্তঃরাষ্ট্রীয় পানিপথ ব্যবহারের জন্য এসওপি এবং ট্রানজিট চুক্তির খসড়া প্রটোকল অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চূড়ান্ত করার বিষয়ে সম্মতি প্রকাশ করেছেন।”
দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি খাতের সহযোগিতা বাড়ানোর ওপরও জোর দিয়েছেন উল্লেখ করে মোমেন বলেন, “বাংলাদেশ স্বল্পতম ব্যয়ে ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ ভুটানে সরবরাহের ব্যাপারে নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে। বাংলাদেশের দ্বিতীয় সাবমেরিন কেবলের ব্যান্ডউইথ ব্যবহারে ভুটান আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সংস্থা কাজ করছে।”
বাংলাদেশ, ভুটান ও ভারতের মধ্যে জল-বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে সহযোগিতার বিষয়ে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী একযোগে কাজ করতে একমত হয়েছেন বলেও জানান তিনি।
বৈঠকে বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দরে নেপালকে প্রবেশাধিকার দিতে বাংলাদেশের সম্মতির বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুনর্ব্যক্ত করেন জানিয়ে পরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “এ বিষয়ে ট্রানজিট চুক্তি ও প্রটোকল দ্রুত সম্পাদনের ওপর তিনি জোর দেন।”
সম্প্রতি উদ্বোধন হওয়া চিলাহাটি-হলদিবাড়ি ট্রেন সংযোগের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও ভুটানের মধ্যে ট্রেন চলাচল শুরু করা যায় কি না, তা খতিয়ে দেখতেও দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী সম্মত হয়েছেন বলে জানান আবদুল মোমেন।
তিনি বলেন, “ভুটানের গেলেফু ও বাংলাদেশের সাথে, বিশেষ করে লালমনিরহাট ও সৈয়দপুরের সাথে কার্গো বিমান যোগাযোগ স্থাপনের সম্ভাবনার বিষয়টি খতিয়ে দেখার বিষয়েও দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী একমত হয়েছেন।”
করোনাভাইরাসের মহামারীর মধ্যে ওষুধ পাঠানোয় ভুটানের প্রধানমন্ত্রী বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন বলে সংবাদ সম্মেলনে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
তিনি বলেন, “পারস্পারিক সম্মান, রাজনৈতিক সমঝোতা ও বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে এবং উভয় দেশের জনগণের সমৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ও ভুটানের মধ্যে অত্যন্ত চমৎকার, বন্ধুত্বপূর্ণ ও ভালো প্রতিবেশীসুলভ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বিদ্যমান।”
মোমেন বলেন, ২০০৯ সাল থেকে বাংলাদেশ-ভুটানের মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের সফর বিনিময়, বিশেষ করে ২০১৯ সালে ভুটানের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান ঘনিষ্ঠ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরো গভীর হয়েছে।
“অত্যন্ত আন্তরিক পরিবেশে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বাংলাদেশ ও ভুটানের মধ্যে পরীক্ষিত বন্ধুত্বের প্রতিফলন ঘটেছে। দুই দেশের ঐতিহাসিক ও ভালো প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় গভীর”
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ভুটানের রাজা জিগমে দর্জি ওয়াংচুক এবং সেদেশের জনগণের সমর্থনের বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করেছেন বলে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
“প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের প্রথম স্বীকৃতিদানকারী দেশ হিসেবে এবং একই ধরনের ঐতিহ্য, বিশ্বাস, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের কারণে ভুটান বাংলাদেশের জনগণের হৃদয়ে বিশেষ স্থান দখল করে আছে।”
মোমেন বলেন, বাংলাদেশি ডাক্তার ও সার্জনরা ভুটানে অত্যন্ত সুনামের সাথে কাজ করছেন। ভুটানে আরও চিকিৎসক পাঠানোর বিষয়ে বাংলাদেশ আগ্রহ প্রকাশ করেছে বৈঠকে।
এছাড়া উচ্চশিক্ষার গন্তব্য হিসেবে ভুটানের শিক্ষার্থীদের কাছে বাংলাদেশ পছন্দের জায়গা হয়ে ওঠায় প্রধানমন্ত্রী সন্তোষ প্রকাশ করেছেন জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ভুটানের শিক্ষার্থীদের ভিসার সুবিধা বাড়াতেও বাংলাদেশ সম্মত হয়েছে।
“বাংলাদেশ ও ভুটানের মধ্যে বন্ধুত্বের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান যৌথভাবে সম্পাদনের বিষয়ে উভয় প্রধানমন্ত্রী একমত হয়েছেন।”
এক প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন বলেন, “আমাদের প্রধানমন্ত্রী জানেন… পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী অসুস্থ, কোভিড পজেটিভ হয়েছেন। সেজন্য আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর সুস্থতা এবং এই কোভিড থেকে উত্তোরণের জন্য ভালো হওয়ার আশা প্রকাশ করে বার্তা পাঠিয়েছেন।”
ভারতের সাথে তিস্তা চুক্তির বিষয়ে আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আমাদের তো বহু নদী ভারত থেকে এসেছে, প্রায় ৫৪টি। আমরা বড় বড় ছয়টি নদী নিয়ে আলোচনা করে থাকি। আর তিস্তা চুক্তি, আমাকে সারাক্ষণ এটা নিয়েই প্রশ্নে পড়তে হয়। আমি যেটি বলেছি, খসড়া তিস্তা চুক্তির প্রতিটি পাতায় উভয় দেশ সই করে রেখেছে। কিন্তু এখনও জিনিসটি রাজনৈতিকভাবে সম্পূর্ণ হয়নি।”
চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে মন্ত্রী বলেন, “ইমপ্লিমেন্ট হয়নি, এর কারণ আপনারা জানেন আমিও জানি। যে খসড়া সই করা আছে, ভারত সরকার কখনও ডিনাই করেনি। তারা এই ব্যাপারে একমত যে চুক্তি হবে। তাদের কিছু অসুবিধার কারণে সেটি ডেলিভারি হয়নি। আমরা এখনও আশায় বুক বেঁধে আছি।”