পঞ্চাশ বছর আগে ২৫ মার্চের কালরাতে
বাঙালি জাতির ওপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অপারেশন সার্চ লাইট নামের সেই মানবতাবিরোধী
হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি একথা বলেন।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর
জন্মশতবার্ষিকীর ১০ দিনের অনুষ্ঠানমালার নবম দিন বৃহস্পতিবার সাবেক সংস্কৃতিকমন্ত্রী
আসাদুজ্জামান নূরের সঞ্চালনায় ‘গণহত্যার কালরাত্রি ও আলোকের অভিযাত্রা’ শীর্ষক স্মারক
বক্তব্যের মূল আলোচক ছিলেন মফিদুল।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্যতম ট্রাস্টি
বলেন, ৫০ বছর আগে এই রাতে সূচিত হয়েছিল ২০ শতকের ঘৃণ্যতম হত্যা অভিযান। অপারেশন সার্চ
লাইট নাম দিয়ে পাকিস্তানি সুসংগঠিত বাহিনী এই রাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরস্ত্র বাঙালি জাতির
ওপর। জাতির মুক্তির স্পৃহা রক্তের বন্যায় ভাসিয়ে দেওয়ার মহা আয়োজন। এর পরে নয়মাস জুড়ে
যে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ করা হয় তা তৈরি করে রক্তের মহাসমুদ্র।
“কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের
অনন্য নেতৃত্ব তৈরি করে প্রতিরোধ। চারিদিকে গোলাগুলি ও মানুষের আহাজারির মধ্যেই বঙ্গবন্ধু
ঘোষণা করেন স্বাধীনতার; শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। সেই যুদ্ধে পরাক্রমশালী পাকিস্তানি বাহিনীকে
পরাভূত করে ঘটে অভূতপূর্ব বিজয়।”
গণহত্যার কৃষ্ণগহবরে বিলীন হয়ে যাওয়া
জানা অজানা শহীদদের স্মরণ করে তিনি বলেন, যে অজুত মানুষের জীবনের বিনিময়ে বাংলাদেশ
রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা, যে নৃশংসতা, নির্মমতা ও বর্বরতা মানবজাতিকে নিমজ্জিত করেছিল বর্বরতার
অতল গহ্বরে, সেই বাস্তবতা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় ২৫ মার্চ। পাকিস্তানি বাহিনীর এই
নৃশংসতা কোনো নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে সংগঠিত হলেও তা সমগ্র মানবজাতীর বিরুদ্ধেই
অপরাধ হিসাবে চিহ্নিত।”
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন প্রায় ১০ মাস
জাতির জনককে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি করে রাখা হলেও ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে
ফেরার পর পরই তিনি বাঙালি জাতির ওপর চালানো ভয়াবহ বর্বরতা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে
পেরেছিলেন বলে উল্লেখ করেন মফিদুল হক।
অল্প সময়ের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্তদের
স্বীকৃতি ও তাদের পুনর্বাসনে জাতির জনকের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেন তিনি।
এই মুক্তিযুদ্ধ গবেষক বলেন, পাকিস্তানি
কারাগারে জগত বিচ্ছিন্ন বন্দিদশা থেকে মুক্তির পর বঙ্গবন্ধু লন্ডন হয়ে স্বদেশে ফেরার
স্বল্পতম সময়ে নিবিড়ভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, নয় মাসের ভয়াবহ রক্তগঙ্গার বাস্তবতা।
১০ জানুয়ারি দেশের ফেরার পর প্রথম ভাষণে বলেন, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যে নির্বিচার
গণহত্যা চালিয়েছে তার তদন্ত ও ব্যাপকতা নির্ধারণের জন্য আমি জাতিসংঘের নিকট একটি আন্তর্জাতিক
ট্রাইব্যুনাল করার আবেদন জানাচ্ছি।”
ওই বছরই জাতিসংঘসহ বিশ্বসমাজকে বাংলাদেশে
সংগঠিত গণহত্যার বিচারের জন্য উদ্যোগ নিতে বঙ্গবন্ধু আহ্বা্ন জানিয়েছিলেন উল্লেখ করে
তিনি বলেন, “জেনোসাইড কনভেনশন আইন প্রণয়নের আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু বিশ্বসভা তা
করতে পারিনি। অথচ ৯০ এর দশকে পূর্ব যুগোস্লাভিয়া ও রুয়ান্ডা গণহত্যার পর গঠিত হল বিশেষ
ট্রাইব্যুনাল।
“বিশ্বসংস্থার ব্যর্থতার কাছে পরাজয়
না মেনে বঙ্গবন্ধু উদ্যোগ নিলেন জেনোসাইড কনভেনশন ১৯৪৮ এর আলোকে আন্তর্জাতিক আইনসিদ্ধভাবে
পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের বিচার আয়োজনের। তার নেতৃত্বে ১৯৭৩ সালে
প্রণিত হলো আন্তর্জাতিক অপরাধসমুহ আইন।”
জাতির জনকের পদাঙ্ক অনুসরণে করে তার
কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ৫০ বছর আগের সেই গণহত্যার বিচারে সোচ্চার হয়েছেন বলে
মন্তব্য করেন মফিদুল।
তিনি বলেন, ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক
অপরাধসমূহ আইনের যুগোপযোগী সংস্কার করা হয়। ২০১০ সলে গঠিত হয় ট্রাইব্যুনাল এবং একে
একে গণহত্যার এদেশীয় মূল অপরাধীদের বিচার সম্পন্ন হয়।
“প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পিতার
পদাঙ্ক অনুসরণ করে সব বাধা অতিক্রম করে গণহত্যার বিচার করার মাধ্যমে মানবতার পক্ষে
আকের উদাহারণ সৃষ্টি করেছেন।”
শেষ দিনের প্রতিপাদ্য ‘স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর ও অগ্রগতির সুবর্ণরেখা’
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর
রহমানের জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন উপলক্ষ্যে ‘মুজিব চিরন্তন’
শীর্ষক মূল প্রতিপাদ্যের ১০ দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার শেষ দিন শুক্রবারের প্রতিপাদ্য
‘স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর ও অগ্রগতির সুবর্ণরেখা’।
এদিনের প্রধান আকর্ষণ হিসাবে থাকছেন
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল
হামিদও এদিন অনুষ্ঠান স্থলে থাকবেন।
জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে আয়োজিত অনুষ্ঠানে
সভাপতিত্ব করবেন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা, প্রধান অতিথি থাকবেন রাষ্ট্রপতি
মো. আবদুল হামিদ, অতিথি হিসেবে থাকবেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে আয়োজিত ওই
অনুষ্ঠান টেলিভিশন ও বেতার চ্যানেল, অনলাইন মিডিয়া এবং স্যোশ্যাল মিডিয়ায় সরাসরি সম্প্রচার
করা হবে।
প্রথম পর্বে বিকাল সাড়ে ৪টা থেকে
সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত আলোচনা অনুষ্ঠান চলবে। মাঝে আধাঘণ্টার বিরতি দিয়ে সন্ধ্যা সাড়ে
৬টায় দ্বিতীয় পর্বে শুরু হবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পর্বে ভারতের
প্রখ্যাত শাস্ত্রীয় সংগীতজ্ঞ পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তীর পরিবেশনায় বঙ্গবন্ধুকে উৎসর্গ করে
নবনির্মিত রাগ ‘মৈত্রি’ পরিবেশনা, ‘পিতা দিয়েছে স্বাধীন স্বদেশ, কন্যা দিয়েছে আলো’,
‘বিন্দু থেকে সিন্ধু’ শীর্ষক তিনটি কালজয়ী গান, ঢাক-ঢোলের সমবেত বাদ্য ও কোরিওগ্রাফি
সহযোগে ‘বাংলাদেশের গর্জন: আজ শুনুক পুরো বিশ্ব’ এবং সবশেষে ফায়ার ওয়ার্কস ও লেজার শো’র মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান
শেষ হবে।