ক্যাটাগরি

রাজারবাগ পুলিশ লাইনস: মুক্তিযুদ্ধের প্রথম লড়াই

সাড়ে তিন ঘণ্টার যুদ্ধে রাজারবাগের বাঙালি পুলিশ সদস্যরা সামান্য থ্রি-নট-থ্রি নিয়ে প্রাণপণে লড়ে যান ভারী অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। সেইরাতে শহীদ হন কমপক্ষে দেড়শ বাঙালি পুলিশ সদস্য।

স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত ছিলেন বাঙালি পুলিশ সদস্যরাও

একাত্তরের মার্চে রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে শাহজাহান মিয়া ছিলেন ওয়্যারলেস অপারেটর। পুলিশ কনস্টেবল আবু শামার ডিউটি ছিল অস্ত্রাগারে। সেই রাতের স্মৃতি তারা তুলে ধরেছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কাছে।

বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণের পরই বাঙালি পুলিশ সদস্যরা স্বাধীকারের সংগ্রামে নামতে গোপনে প্রস্তুত হতে থাকেন। তীব্র অসহযোগ আন্দোলনের মধ্যেই চলে আসে ২৫ মার্চ।

সেদিন দুপুর থেকেই পুলিশের বিভিন্ন সোর্সের মাধ্যমে রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে বিভিন্ন খবর আসতে থাকে। বিকালে ট্রাকে করে রাজারবাগের আশপাশের সড়ক রেকি করে পাকিস্তানি সেনারা।

রাত ৯টার পর হঠাৎ খবর আসে রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে সেনাবাহিনীর আক্রমণ হতে পারে। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে তখনই নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে ওয়্যারলেসসেটসহ শহরের বিভিন্নস্থানে টহল দল পাঠানো হয়। ঢাকার বেসামরিক এলাকা ও সেনানিবাসের পরিস্থিতি এবং সেনাবাহিনীর গতিবিধির ওপর লক্ষ্য রাখার জন্য তাদের বিশেষভাবে বলে দেওয়া হয়।

রাত ১০টার দিকে তেজগাঁও শিল্প এলাকায় টহলে যাওয়া একটি দল দেখতে পায় সেনাবাহিনীর একটি বড় কনভয় যুদ্ধসাজে রাস্তায়। তারা দ্রুত বেইজ স্টেশন ও কন্ট্রোল রুমে সেনাবাহিনীর ওই মুভমেন্টের খবর জানায়।

সেই রাতে ওই বার্তা গ্রহণ করেছিলেন কনস্টেবল শাহজাহান মিয়া।

তিনি বলেন, “মোবাইল ওয়্যারলেস স্টেশন থেকে পাঠানো সংবাদটি ছিল- চার্লি সেভেন ফর বেইজ, হাউ ডু ইউ হিয়ার মি, ওভার। জবাবে আমি বলি, বেইজ ফর চার্লি সেভেন, সেন্ড ইওর ম্যাসেজ, ওভার। তখন টহল দলের বেতারযন্ত্র থেকে জানানো হয়- অ্যাবাউট থার্টি সেভেন ট্রাকস, লোডেড উইথ পাক আর্মি আর প্রসিডিং টুওয়ার্ডস ঢাকা সিটি, ওভার।’

বার্তাটি পাওয়া মাত্রই সেই রাতে প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রস্তুতি নেন বাঙালি পুলিশ সদস্যরা।

সেদিন অস্ত্র হাতে প্রাণ বাজি রেখেছিলেন যারা

শাহজাহান মিয়া জানান, রাত সাড়ে ১১টায় পুলিশ লাইনসের পাগলা ঘণ্টি বাজিয়ে পুলিশ সদস্যদের একত্রিত করা হয়। অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র নিয়ে তাদের মধ্যে বিলি করা হয়। পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত লাল সবুজের পতাকা উড়ানো হয়।

তিনি জানান, রাত ১১টা ৫০ মিনিটের দিকে পাকিস্তানি সেনারা চামেলিবাগে প্রথম পুলিশের ব্যারিকেডের মুখে পড়ে। সেখানেই পুলিশের গুলিতে নিহত হয় দুই পাকিস্তানি সেনা। সম্ভবত সেখানেই ছোড়া হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে শত্রুর বুকে প্রথম বুলেট।

কনস্টেবল শাহজাহান বলেন, ‘এই আক্রমণের খবর ১৯টি জেলা,৩৬টি সাব-ডিভিশন এবং সব পুলিশ লাইনসে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে জানিয়ে দিই। বার্তাটি ছিল- ‘দ্য বেস ফর অল স্টেশন পূর্ব পাকিস্তান পুলিশ, কিপ লিসেনিং, ওয়াচ, উই আর অলরেডি অ্যাটাকড বাই পাক আর্মি, ট্রাই টু সেইভ ইয়োরসেলফ, ওভার অ্যান্ড আউট।’- আমি কয়েকবার বার্তাটি ট্রান্সমিট করি। চারদিকে তখন মুহুর্মুহু গুলির শব্দ।”

পাকিস্তানিরা পুলিশ লাইনসের বিদ্যুতের সংযোগ কেটে দিয়েছিল। চেষ্টা করেও জেনারেটর চালু করতে পারেননি তারা। তবে হারিকেন ছিল। প্রচণ্ড গোলাগুলিতে রাজারবাগে আগুনের ফুলকি উড়ছিল। অস্ত্র নিয়ে পুলিশ লাইনসের চারতলা ভবনের ছাদে অবস্থান নেন বাঙালি পুলিশ সদস্যরা।

“থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল নিয়ে ট্যাংক-মেশিনগানের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি। ফজরের আজান পর্যন্ত আমরা একশ জনের মতো টিকে ছিলাম। ভোর ৫টার দিকে আমাদের বন্দি করে আর্মি। ২৮ মার্চ পর্যন্ত আমাদের রাজারবাগেই আটক রাখা হয়”, বলেন কনস্টেবল শাহজাহান।

স্মৃতিচারণের এ পর্যায়ে আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। বলেন, “আমাদের বলা হত  সরকারের দালাল বাহিনী, কুত্তা বাহিনী। অথচ আমরাই মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছিলাম।

“এই সাহস আমরা পেয়েছিলাম সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে, এই শক্তি আমরা পেয়েছিলাম বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠের ভাষণে, – এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে।- আমরা তাই করেছিলাম।”

শাহজাহান মিয়ার ভাষ্য আনুযায়ী, সেই রাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের ওয়্যারলেস স্টেশনে কর্মরত দারোগা ইয়াছিন টেলিফোনে সেনাবাহিনীর আক্রমণের খবর তৎকালীন এআইজি এস এম নবাবকে জানিয়েছিলেন। এআইজি সন্তোষজনক কোনো নির্দেশনা না দিয়ে টেলিফোন রেখে দেন। ওই রাতে ঢাকা শহরের আটটি থানায় এবং তিনটি ভ্রাম্যমাণ টহল দলের কাছে ওয়্যারলেস সেট ছিল।

রাজারবাগ ওয়্যারলেস বেইজ স্টেশনে ছিলেন সহ-দারোগা ইয়াছিন আলী তরফদার, আর এস  মুসলিম আলী শরীফ, কনস্টেবল মনির হোসেন, কনস্টেবল মতিউর রহমান মতিন, কনস্টেবল আব্দুল লতিফ, কনস্টেবল  সোহরাব হোসেনসহ আরও অনেকে।

সেনাবাহিনীর আক্রমণের সময় রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে উচ্চপদস্থ কোনো কর্মকর্তা না থাকায় পুলিশ সদস্যরা নিজেদের পরিকল্পনাতেই প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নেন। তারা রিজার্ভ ইন্সপেক্টর (আরআই) মফিজউদ্দিনের বাসায় গিয়ে তার কাছ থেকে জোর করে অস্ত্রাগারের চাবি নিয়ে সেখান থেকে অস্ত্র ও গুলি বের করেন। মফিজউদ্দিন আত্মগোপনে চলে যান।

শাহজাহান বলেন, প্রতিরোধযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সদস্যরা রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের চারদিকে ভবনের ছাদে এবং একটি দল পাকমটর (বর্তমানে বাংলামটর) এলাকায় অবস্থান নেয়।

আর্মি কনভয় মূল ফটকের কাছাকাছি পৌঁছালে পুলিশ সদস্যরা গুলি করতে শুরু করেন। হঠাৎ আক্রমণে প্রথমে সেনারা একটু থমকে গেলেও ট্যাংক, মর্টার এবং ভারী-মেশিনগান দিয়ে পাল্টা আক্রমণ করে।

সেনাবাহিনীর গোলাগুলিতে পিআরএফএ-র চারটি ব্যারাকে আগুন ধরে যায়। পুলিশ সদস্যদের একটি অংশ আগুন এবং পাকিস্তানি বাহিনীর গুলি থেকে বাঁচতে ছোটাছুটি শুরু করেন। ভোরের দিকে সেনাবাহিনী ট্যাংক বহর নিয়ে পুলিশ লাইনসের প্যারেড গ্রাউন্ডে প্রবেশ করে। তখনও চারতলা ব্যারাকের ছাদ থেকে পুলিশ সদস্যদের গুলি চলছিল।

পাকিস্তানি সেনারা ফ্লেয়ার জ্বালিয়ে পুলিশ সদস্যদের অবস্থান চিহ্নিত করে গুলি করে হত্যা করতে থাকে। এই প্রতিরোধ যুদ্ধে সেরাতেই প্রায় দেড়শ পুলিশ সদস্য শহীদ হন।

এসআই, সুবেদার, নায়েক, হালিদার, সিপাহিসহ প্রায় দেড়শ বীরযোদ্ধা বন্দি হন পরদিন ভোরে। রাজারবাগের আক্রমণে অংশ নেওয়া সেনাদের সংখ্যা ছিল প্রায় আটশ।

পাশবিক নির্যাতন

সেই রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পৈশাচিকতা এবং নির্যাতনের বর্ণনা দেন অস্ত্রাগারে দায়িত্বে থাকা তৎকালীন পুলিশ কনস্টেবল এবং যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আবু শামা।

“সারারাত গোলাগুলি শেষে ভোরের আজানের পর পাকিস্তানি সেনারা পুলিশ লাইনসে প্রবেশ করে। তারা দুটি ট্যাংক নিয়ে ভেতরে ঢোকে। একটি ট্যাংকের পেছনে আসে ট্রাক। আমরা কয়েকজন চারতলার ছাদ থেকে দেখতে পেলাম আধো অন্ধকারেই সেনারা শহীদ পুলিশ সদস্যদের মৃতদেহগুলো ট্রাকে তুলতে শুরু করেছে।

“তারা ভেতরে আসার পর যাকে যেখানে পাচ্ছিল মারধোর করছিল। লাঠি, রাইফেলের বাট, লোহারপাত বসানো বুট দিয়ে আঘাত করছিল। তাদের আঘাতে আমরা রক্তাক্ত হয়ে যাই। তারা মারছিল আর উর্দুতে গালাগাল করছিল। ভেবেছিলাম সেদিনই মৃত্যু হবে।

“সেনাদের কয়েকজন হঠাৎই আমাদের এক ক্যান্টিন বয়কে তুলে আছড়াতে শুরু করে। আঘাতে আঘাতে তার থুতনি ফেটে যায়। সে কাঁপতে কাঁপতে বলছিল পানি! পানি! পানি না দিয়ে এক পাকিস্তানি সেনা ছেলেটার মুখে প্রস্রাব করে। অসহায় হয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করার ছিল না।”

আবু শামা বলেন, “রাজারবাগে আমরা শতাধিক পুলিশ সদস্য তিনদিন গ্রেপ্তার ছিলাম। এক ফোটা পানিও দেওয়া হয় নাই। এরপর ২৮ মার্চ আমাদের গেণ্ডারিয়ার মিলব্যারাকে পাঠানো হয়। যাওয়ার পথে সূত্রাপুরের লোহারপুলে দেখলাম অনেক মানুষের লাশ খালে পড়ে আছে।”

১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের পর কোতোয়ালি থানার কোনো বাঙালি পুলিশকে টহলে পাঠানো হত না। ৫ এপ্রিল কোতোয়ালি থানা থেকে তাদের রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে নেওয়া হয়। তারা দেখেন, সেখানকার ব্যারাক, ক্যান্টিন, আসবাবপত্র, পোশাক-পরিচ্ছদ সব পুড়ে ছাই। তিন নম্বর ব্যারাকের মেঝেতে পড়েছিল সিপাহী জাহাঙ্গীর ও আব্দুস সালামের বীভৎস লাশ।

আবু শামা বলেন, “চরম বাঙালিবিদ্বেষী বোস্তান খান ৬ এপ্রিল রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের দায়িত্বে এসেই বাঙালি পুলিশদের ওপর অত্যাচার শুরু করে। বোস্তান খান বেছে বেছে ভালো শারীরিক গঠনের বাঙালি কনস্টেবলদের ‘মুক্তিবাহিনী’ তকমা দিয়ে সেনানিবাসে পাঠাত। প্রতিদিন নির্র্দিষ্ট সংখ্যক বাঙালি পুলিশকে ঢাকা সেনানিবাসে ধরে নিয়ে যাওয়া হত। তারা আর পুলিশ লাইনসে ফেরেননি।”

রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে বাঙালি বিদ্বেষী পুলিশ সদস্যের অভাব ছিল না। তারা বিভিন্নভাবে বাঙালি পুলিশ সদস্যদের হেনস্তা করত। পুলিশ লাইনসের যাবতীয় খবর পাচার করত পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর কাছে। এমন একজন ছিলেন ওয়্যারলেস বিভাগের প্রধান এ আই জি নবাব। ওয়্যারলেস বিভাগের যোগাযোগ ছিল তার নজরদারিতে।

কনস্টেবল শাহজাহান মিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পুলিশ সদস্যদের মধ্যে আমরা যারা মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম, ওয়্যারলেস যোগাযোগের ক্ষেত্রে প্রতীকী শব্দ ব্যবহার করতাম, যাতে পাকিস্তানিরা বুঝতে না পারে।”

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এআইজি নবাবকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল। কিন্তু পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর জিয়াউর রহমানের সময়ে তাকে আবার চাকরিতে ফেরানো হয় বলে শাহজাহান জানান।

বাঙালি পুলিশ সদস্যদের অনেককেই একাত্তরের ২৮শে মার্চ পর্যন্ত রাজারবাগে বন্দি রেখে মিলব্যারাকে গিয়ে নির্দিষ্ট দিনে চাকরিতে যোগ দিতে বলা হয়। কিন্তু শাহজাহান মিয়া, আবু শামা দুজনই পালিয়ে ভারতে চলে যান। সেখান থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন।

শাহজাহান মিয়া তার দুই ভাইকে নিয়ে ১১ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেন। আবু শামা ৩ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধে অংশ নিয়ে আহত হন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে তারা চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর অবসরে যান।

পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মর্টার, কামান, ট্যাংক আর ভারী অস্ত্রের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রতিরোধ হয়েছিল শুধু থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল দিয়ে।

মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকাকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে রাজারবাগ পুলিশ স্মৃতিস্তম্ভের পাশেই দেড় বিঘা জমির ওপর নির্মিত হয়েছে পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর।

জাদুঘরে ঢুকলে প্রথমেই চোখে পড়বে বঙ্গবন্ধু গ্যালারি। দুপাশের দেয়ালে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর নানা সময়ের দুর্লভ সব আলোকচিত্র। পাশেই মুক্তিযুদ্ধের ওপর লেখা প্রায় ২ হাজার বইয়ের একটি গ্রন্থাগার। সেখানে মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের অবদান নিয়ে লেখা বিভিন্ন বই কেনার ব্যবস্থাও আছে।

পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবহৃত থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল, শহীদ পুলিশ সদস্যদের পোশাক, চশমা, টুপি, বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণার টেলিগ্রাম লেটার, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম আইজিপি আবদুল খালেকের ব্যবহৃত চেয়ার, মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত হ্যান্ড মাইক, সার্চ লাইট, রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের টেলিকম ভবনের দেয়াল ঘড়ি, যুদ্ধকালীন পুলিশ সদস্যদের চিঠিপত্রসহ বিভিন্ন ঐতিহাসিক নিদর্শন সংরক্ষণ করা হয়েছে এই জাদুঘরে।

জাদুঘরের পরিচালক পুলিশের সহকারী মহাপরিদর্শক তালিবুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মহান মুক্তিযুদ্ধে পুলিশ বাহিনীর অবদানের স্মৃতিচিহ্ন ধরে রাখতেই এ জাদুঘর।”

তিনি জানান, ২৫ মার্চ রাজারবাগে পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণে পুলিশ সদস্যদের তালিকা সম্বলিত সব রেকর্ড পুড়ে যায়। ফলে যুদ্ধের নয় মাসে কতজন পুলিশ সদস্য শহীদ হয়েছিলেন, তার সুনির্দিষ্ট তালিকা পাওয়া যায়নি। তবে বিভিন্ন তথ্যের ভিত্তিতে ৭৫১ জনের একটি তালিকা করা হয়েছে, রাজারবাগ স্মৃতিস্তম্ভে তা লিপিবদ্ধ রয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া পুলিশ সদস্যদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা করার পরিকল্পনা রয়েছে বলেও জানান তালিবুর।

দর্শনার্থীদের জন্য সপ্তাহে পাঁচ দিন সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৫টা এবং শুক্রবার বিকেল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকে পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। বুধবার সাপ্তাহিক বন্ধ। জাদুঘরের প্রবেশমূল্য ১০ টাকা। তবে জাতীয় দিবসগুলোতে সবার জন্য এবং ডিসেম্বর মাসে শিক্ষার্থীদের জন্য বিনামূল্যে প্রবেশের সুযোগ রয়েছে।

এই জাদুঘর নির্মাণের উদ্যোগ নেন ঢাকা রেঞ্জ পুলিশের উপমহাপরিদর্শক হাবিবুর রহমান। ২০০৯ সালে তিনি এই জাদুঘর নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। ২০১৩ সালের ২৪ মার্চ এটি দর্শনার্থীদের জন্য খুলে দেওয়া হয়।

হাবিবুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সাড়ে তিন বছর জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান জীবিত ছিলেন। ওই কটা বছর তিনি দেশ পুনর্গঠনে কাজ করেছেন। সেই সময় এই ইতিহাস সংরক্ষণের কাজ করার মত অবস্থা ছিল না।

“পঁচাত্তর সালে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারকে হত্যার ঘটনার পর দীর্ঘ ২১ বছর স্বাধীনতার বিপক্ষ ধারায় দেশ পরিচালিত হয়েছে। সেই কারণে একটি বিরাট বিরতি হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার ক্ষমতায় আসার পর ধীরে ধীরে এর কাজ শুরু হয়। মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের অবদানের ইতিহাস সংরক্ষণ, বিভিন্ন জেলা থেকে তথ্য, নিদর্শন সংগ্রহ করা হয়।”

মুক্তিযুদ্ধে পুলিশ বাহিনীর সাহসিকতা এবং তাদের অবদান সম্পর্কে সঠিকভাবে জানার জন্য নতুন প্রজন্মের পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ঘুরে দেখা উচিৎ বলে মনে করেন হাবিবুর রহমান।