সংখ্যালঘু মুসলিম রোহিঙ্গাদের ওপর ২০১৭ সালে সামরিক বাহিনীর ওই অভিযান নিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কয়েক বছরের অনুসন্ধান ও আইনি বিশ্লেষণের ওপর ভিত্তি করে রাখাইনে ‘গণহত্যা হয়েছিল’ এমন ঘোষণা দেওয়া হলে তা মিয়ানমারের জেনারেলদেরকে ‘নিপীড়নের দায়মুক্তি ভোগ করার সুযোগ নেই’ এমন বার্তা দিত বলে আশা করেছিলেন ট্রাম্প প্রশাসনের ওই কর্মকর্তারা।
পম্পেও শেষ পর্যন্ত ওই আহ্বানে কান দেননি। তিনি এ বছরের ২০ জানুয়ারি বিদায় নেন। এর দুই সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে মিয়ানমারের জেনারেলরা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাই দখল করে নেয়।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স লিখেছে, এক দশক আগে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী দেশটিতে গণতান্ত্রিক চর্চার সুযোগ খানিকটা উন্মুক্ত করে দিলেও যুক্তরাষ্ট্র যে দেশটির ক্ষেত্রে একটি উপযুক্ত নীতিমালা প্রণয়নে হিমশিম খেয়েছে, ট্রাম্প প্রশাসনের ভেতর এ নিয়ে একেবারে শেষ মুহুর্তের টানাপোড়েন তাই তুলে ধরেছে।
মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন, মিয়ানমারের ঘটনাবলীর ওপর প্রভাব বিস্তারে ওয়াশিংটনের সক্ষমতা খুবই কম। মিয়ানমারের ক্ষমতা দখলে সেনাবাহিনীর সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রেও যুক্তরাষ্ট্রের নীতিই ‘একমাত্র ফ্যাক্টর’ ছিল না।
তবে এরপরও রাখাইনে রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞকে ‘গণহত্যা’র মতো শক্তিশালী ভাষা ব্যবহার করে নিন্দা না জানানোর ফলে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশটির জেনারেলদের ওপর ‘মোটামুটি প্রভাব’ ফেলার একটি সুযোগ হাতছাড়া হয়েছে বলে মনে করেন ট্রাম্প প্রশাসনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গ্লোবাল ক্রিমিনাল জাস্টিস দপ্তরের প্রধান থাকা মোর্স ট্যান।
তিনিও রাখাইনে রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞকে ‘গণহত্যা’ অ্যাখ্যা দেওয়ার প্রস্তাবের সমর্থক ছিলেন।
“হয়তো এরপরও অভ্যুত্থান কোনো না কোনোভাবে হতই; কিন্তু আমার মনে হয় যুক্তরাষ্ট্র সেরকম সিদ্ধান্ত নিলে তা তাদের (মিয়ানমার সেনাবাহিনীর) চিন্তাভাবনায় প্রভাব ফেলতো,” বলেছেন ট্যান।
যুক্তরাষ্ট্র ২০১৭ সালে রাখাইনে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বর্বরতাকে ‘জাতিগত নিধনযজ্ঞ’ অ্যাখ্যা দিয়েছিল। কিন্তু ‘গণহত্যা’ অ্যাখ্যা দেওয়া হলে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের এ সিদ্ধান্ত একদিকে যেমন আন্তর্জাতিক সমর্থন পেত অন্যদিকে মিয়ানমারের জেনারেলদেরকে জবাবদিহিতার মুখে দাঁড় করাতে চাপও সৃষ্টি করা যেত বলে মনে করেন অনেক কর্মকর্তা।
সাড়ে তিন বছরেরও বেশি সময় আগে রাখাইনে সেনাবাহিনীর ওই দমনাভিযানের প্রতিক্রিয়ায় প্রায় সাড়ে ৭ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে চলে আসে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে মিয়ানমারে সংঘটিত নিপীড়নকে ‘গণহত্যা’ অ্যাখ্যা দেওয়ার একক এখতিয়ার ছিল পম্পেওর। কিন্তু কেন তা করেননি, ট্রাম্পের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কখনোই সেই ব্যাখ্যা দেননি বলেও জানিয়েছেন ট্যান।
পম্পেওর মুখপাত্রের কাছে এ বিষয়ে মন্তব্য চেয়ে ধারাবাহিক ইমেইল পাঠানো হলেও তারা তার জবাব দেয়নি; সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাক্ষাৎকার নেওয়ার ব্যবস্থাও করে দিতে পারেনি তারা।
মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর মুখপাত্রের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলতে চাইলেও তিনি ফোন ধরেননি। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশটির সেনাবাহিনী এর আগে ২০১৭ সালে রাখাইনে চালানো তৎপরতাকে ‘সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় অভিযান’ হিসেবে অভিহিত করেছিল।
সেসময় মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্র্যাসির (এনএলডি) প্রভাবশালী নেত্রী অং সান সু চিও রাখাইনে সেনাবাহিনীর কর্মকাণ্ডকে ‘গণহত্যা’ বলতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন।
চলতি বছর ১ ফেব্রুয়ারির অভ্যুত্থানের পর থেকে সু চিও সেনাবাহিনীর হাতে বন্দি।
রয়টার্স জানিয়েছে, তারা যুক্তরাষ্ট্র-মিয়ানমার নীতি নিয়ে কাজ করছেন বা করেছেন প্রশাসনের এমন ১৮ সাবেক-বর্তমান কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছে। দুই প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ভেতর মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে কিভাবে জবাবদিহিতার মুখোমুখি করা যাবে তা নিয়ে মতবিরোধও খুঁজে পেয়েছে তারা।
মার্কিন অনেক কর্মকর্তারই ধারণা ছিল, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিলে তা রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতির উন্নতির বদলে দেশটির গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে দুর্বল করবে।
অনেকের আবার মত ছিল, মিয়ানমারের জেনারেলদের শাস্তি দিলে তা দেশটিকে আরও বেশি চীনের দিকে ঠেলে দিতে পারে।
তবে যুক্তরাষ্ট্র যদি রাখাইনে সংঘটিত বর্বরতাকে ‘গণহত্যা’ অ্যাখ্যা দিত, তা শরণার্থী শিবিরগুলোতে আশ্রয় নেওয়া লাখো রোহিঙ্গাকে ঊদ্দীপ্ত করত বলে মন্তব্য করেছেন মিয়ানমারের সাবেক এক রাজনৈতিক বন্দি ও অ্যাক্টিভিস্ট ওয়াই ওয়াই নু।
“তাদের দুঃখকষ্ট, তাদের বিরুদ্ধে হওয়া অপরাধ যে স্বীকৃত হয়েছে তা বুঝতে পারতো তারা,” বলেছেন তিনি।