এ বেতার কেন্দ্র থেকেই স্বাধীনতার প্রথম ঘোষণা জানতে পারেন মুক্তিযোদ্ধারা। মুক্তিযুদ্ধের একদম শুরুতে এই বেতার কেন্দ্রই ছিল মুক্তিকামী মানুষের আশার ঠিকানা। অথচ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত এ বেতার কেন্দ্রে তখনকার কোনো স্মৃতিই সেভাবে সংরক্ষিত নেই।
বাংলাদেশ বেতার, কালুরঘাট, চট্টগ্রাম। এখানেই ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল স্বাধীন বাংলা ‘বিপ্লবী’ বেতার কেন্দ্র, যা পরে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার’ হিসেবে পরিচিতি পায়।
নিচতলার একটি কক্ষে শুধু নামফলক বসিয়ে দায়সারাভাবে ৫০ বছর আগের ঐতিহাসিক সেই স্মৃতি ধরে রাখার চেষ্টা হয়েছে। অথচ একাত্তরে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতিগুলো কালুরঘাট থেকে সরিয়ে রাখা হয়েছে চট্টগ্রামের পুরাতন সার্কিট হাউজ এলাকায় ‘জিয়া স্মৃতি জাদুঘরে’।
স্বাধীনতার ঘোষণার স্মৃতিবিজড়িত সেসব সরঞ্জাম কালুরঘাট বেতারে ফিরিয়ে এনে জাদুঘর হিসেবে সংরক্ষণের দাবি এসেছে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর মুহূর্তে।
চট্টগ্রাম নগরীর বহদ্দারহাট বাস টার্মিনালের বিপরীতে দোতলা ভবনটিতে ‘বাংলাদেশ বেতার, কালুরঘাট, চট্টগ্রাম’ অবস্থিত। সেখানেই ৫০ বছর আগে ২৬ মার্চ চট্টগ্রাম বেতারের সংগঠক বেলাল মোহাম্মদের নেতৃত্বে ১০ জনের একটি দল প্রতিষ্ঠা করেন ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’।
বাংলাদেশ বেতার, কালুরঘাট, চট্টগ্রাম। এখানেই ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল স্বাধীন বাংলা ‘বিপ্লবী’ বেতার কেন্দ্র, যা পরে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার’ হিসেবে পরিচিতি পায়।
বেলাল মোহাম্মদের লেখা ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ বইটি থেকে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিটে আবুল কাশেম সন্দ্বীপের কণ্ঠে প্রথম ঘোষিত হয় ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’ শব্দটি।
ওইদিন রাতেই চট্টগ্রামের তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন।
এর আগে ওইদিন দুপুরে আগ্রাবাদে চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রও ঘোষণাপত্রটি পাঠ করেছিলেন এম এ হান্নান। তবে সংবাদের সময় না হওয়ায় অধিকাংশ শ্রোতা তা শুনতে পাননি।
দুই দিন পর বেতারের নাম থেকে ‘বিপ্লবী’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। ১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ পর্যন্ত চলে এ বেতার কেন্দ্রের কার্যক্রম। এ কয়দিনে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হয়।
বাংলাদেশ বেতার, কালুরঘাট, চট্টগ্রাম। এখানেই ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল স্বাধীন বাংলা ‘বিপ্লবী’ বেতার কেন্দ্র, যা পরে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার’ হিসেবে পরিচিতি পায়।
প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে এ বেতার কেন্দ্র স্থানান্তর করা হয় ভারতের ত্রিপুরায়; পরে কলকাতায় স্থানান্তর করে সেখান থেকেই মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতারের কার্যক্রম চলে।
৫০ বছর আগে ১৯৭১ সালে যেখানে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, সেই কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র এখন ১০০ কিলোওয়াটের একটি বেতার কেন্দ্র। বেতারের মূল অনুষ্ঠান আগ্রাবাদে রেকর্ড করার পর কালুরঘাট কেন্দ্রের মাধ্যমে তা ছড়িয়ে দেওয়া হয়।
সম্প্রতি ওই দোতলা ভবন ঘুরে দেখা যায়, নিচতলায় নামাজের ঘরের বিপরীতে লাল কার্পেট বিছানো ১১১ নম্বর কক্ষের বাইরে লাগানো ফলকে লেখা রয়েছে ‘স্বাধীনতা ঘোষণা কক্ষ (স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র), বাংলাদেশ বেতার, চট্টগ্রাম’। এর পাশের কক্ষেই আছে বেতার কেন্দ্রের বর্তমান ১০০ কিলোওয়াট ট্রান্সমিটার।
অথচ একাত্তর সালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে ব্যবহৃত বিভিন্ন সরঞ্জাম, বিশেষ করে স্বাধীনতার ঘোষণায় ব্যবহৃত মাইক্রোফোন, টেবিল, চেয়ার, রেডিও কনসোল, মূল ট্রান্সমিটারসহ অন্যান্য সরঞ্জাম কালুরঘাট থেকে সরিয়ে চট্টগ্রামের পুরাতন সার্কিট হাউজ এলাকায় ‘জিয়া স্মৃতি জাদুঘর’ এ নিয়ে রাখা হয়েছে।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সম্প্রচার সরঞ্জামগুলো সরিয়ে নিয়ে রাখা হয়েছে চট্টগ্রামের পুরাতন সার্কিট হাউজ এলাকায় `জিয়া স্মৃতি জাদুঘরের’ নিচতলায়।
সেখানে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠরত জিয়াউর রহমানের একটি প্রতিকৃতিও রয়েছে।
কালুরঘাট বেতারকেন্দ্রের প্রধান আবাসিক প্রকৌশলী ভাস্কর দেওয়ান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাংলাদেশের জন্মের ঘোষণা এখান থেকে দেওয়া হয়েছিল। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সম্প্রচার যে কক্ষ থেকে হয়েছে তা সংরক্ষিত আছে।”
অন্যান্য সরঞ্জাম সেখানে নেই জানিয়ে তিনি বলেন, “এটি সংরক্ষণ করে কোনো কিছু করার ব্যাপারে আমার জানা নেই।”
বর্তমানে তিন একর জমির ওপর কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে টাওয়ার ও ভবন রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে নয় একর জমি জুড়ে এ স্থাপনা ছিল। পরে স্বাধীনতা পার্ক প্রতিষ্ঠার জন্য এর জমি ছেড়ে দেওয়া হয়।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সম্প্রচার সরঞ্জামগুলো সরিয়ে নিয়ে রাখা হয়েছে চট্টগ্রামের পুরাতন সার্কিট হাউজ এলাকায় `জিয়া স্মৃতি জাদুঘরের’ নিচতলায়।
চট্টগ্রামের মুক্তিযুদ্ধ গবেষক মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কালুঘাটের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র আমাদের মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতি। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসেও এটি এখনো সংরক্ষণ করা যায়নি, সেটি খুবই দুঃখজনক।”
তিনি বলেন, “কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের যেসব সরঞ্জাম নিয়ে গেছে, সেগুলো স্বস্থানে ফিরিয়ে এনে সংরক্ষণ এবং প্রদর্শন করা উচিত।”
মাহফুজুর রহমান অভিযোগ করেন, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেওয়া হলেও তা গৃহীত বা বাস্তবায়িত হয়নি।
চট্টগ্রামের সিটি মেয়রের অধীনে এসব স্মারক সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে বলেও পরামর্শ দেন তিনি।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের উদ্যোক্তা বেলাল মোহাম্মদ নগরীর এনায়েত বাজারের বাসিন্দা ডা. শফীর বাসায় বসেই ভেবেছিলেন কিছু একটা করার। এর নেপথ্যের উৎসাহদাতাদের মধ্যে ছিলেন ডা. শফী (যিনি পরে শহীদ হয়েছিলেন), তার স্ত্রী বেগম মুশতারী শফীসহ আরও কয়েকজন।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সম্প্রচার সরঞ্জামগুলো সরিয়ে নিয়ে রাখা হয়েছে চট্টগ্রামের পুরাতন সার্কিট হাউজ এলাকায় `জিয়া স্মৃতি জাদুঘরের’ নিচতলায়।
শহীদজায়া মুশতারী শফী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পরের প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরার জন্য সরকারের উচিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বিভিন্ন সরঞ্জাম স্বস্থানে ফিরিয়ে নিয়ে জাদুঘর তৈরি করা।”
‘‘হান্নান সাহেব যে মাইক্রোফান দিয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছিলেন, যেটি দিয়ে সম্প্রচারিত হয়েছিল, তা অবশ্যই পূর্বের স্থানে ফিরিয়ে এনে সংরক্ষণ করতে হবে ইতিহাসের প্রয়োজনেই। অন্য একটি জাদুঘরে এসব স্মৃতিস্মারক সংরক্ষণ উচিত নয়।’’