স্বপ্নের পথচলায়
ক্লাব ফুটবলের সীমানা ছাড়িয়ে এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও পা রেখেছেন পেদ্রি। গত
বৃহস্পতিবার গ্রিসের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে জাতীয় দলে অভিষেক হয় তার। এবার শুধুই সামনে
এগিয়ে যাওয়ার পালা।
পুরো নাম পেদ্রো
গনসালেস লোপেস।
২০১৯ সালের ১৮ অগাস্ট,
১৬ বছর বয়সে দ্বিতীয় সারির ক্লাব লাস পালমাসের মূল দলের প্রথম মাঠে নামেন পেদ্রি। এর
দেড় বছরের মধ্যেই তার গায়ে উঠল জাতীয় দলের জার্সি!
লাস পালমাসের মূল
দলে হঠাৎ জায়গা করে নেওয়া পেদ্রির পারফরম্যান্স নজর কাড়ে বার্সেলোনার। সিদ্ধান্ত নিতে
সময় নেয়নি তারা। ১৫ দিনের মাথায় গ্রীষ্মের দলবদলের একেবারে শেষবেলায় ২ সেপ্টেম্বর পালমাসের
সঙ্গে চুক্তি সারে কাতালান ক্লাবটি।
ওই মৌসুম অবশ্য পালমাসেই
থেকে যান পেদ্রি। পরে ২০২০ সালে ১ জুলাই যোগ দেন বার্সেলোনায়, করেন পাঁচ বছরের চুক্তি।
আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় এক ভবিষ্যৎ তারকার পথচলা, যিনি এরই মধ্যে নিজের নাম প্রতিষ্ঠিত
করেছেন।
শিরোপাশূন্য ব্যর্থ
এক মৌসুম শেষে নতুন কোচ রোনাল্ড কুমানের হাত ধরে দল পুনর্গঠনের মধ্যে দিয়ে যাত্রা শুরু
হয় বার্সেলোনার। যে অভিযানে শুরু থেকেই পেদ্রির ওপর ভরসা রাখেন কোচ। সেই আস্থার প্রতিদান
দারুণভাবে দিচ্ছেন পেদ্রি। লিওনেল মেসির সঙ্গে গড়ে তুলেছেন কার্যকর এক জুটি, সাফল্যও
আসছে নিয়মিত।
বল দখলে নেওয়ার তাড়না,
সঠিক সময়ে মাঠের সঠিক জায়গায় সতীর্থকে খুঁজে নেওয়া এবং তাকে পাস দেওয়া-সব মিলিয়ে আক্রমণ
গড়ে তোলার গুণই পেদ্রিকে কুমানের কৌশলের খুব গুরুত্বপূর্ণ অংশ করে তুলেছে।
চলতি মৌসুমে তার
সংখ্যাগুলোতেই যা ফুটে ওঠে। সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ৪২ ম্যাচ খেলে গোল করেছেন
তিনটি, করিয়েছেন ছয়টি। ইউরোপের শীর্ষ পাঁচ লিগে ২২ বয়সের নিচের খেলোয়াড়দের মধ্যে তিনিই
সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলেছেন। আর এই ৪২ ম্যাচের মধ্যে শেষ ২৯টি খেলেছেন টানা, এই মৌসুমে
যে কোনো ক্লাবেই যা সর্বোচ্চ।
ক্যারিয়ার শুরুর
দেড় বছরের চমক জাগানো এই অধ্যায়েই পেদ্রি খেলে ফেলেছেন দেশের বয়সভিত্তিক চারটি দলে।
খেলেছেন ২০১৯ সালে ব্রাজিলে হয়ে যাওয়া ফিফা অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপে।
সবখানেই তার ফুটবল
মেধা ও সামর্থ্য প্রমাণিত হয়েছে, যা নজর কেড়েছে লুইস এনরিকেরও। তাই স্পেন জাতীয় দলের
কোচ পেদ্রিকে নিয়ে বিশ্বকাপ বাছাইয়ের প্রথম পর্বের দল ঘোষণা করায় খুব বেশি অবাক হওয়ার
কিছু ছিল না।
দলগতভাবে জাতীয় দলের
হয়ে শুরুটা সুখকর হয়নি পেদ্রির জন্য; আক্রমণভাগের ব্যর্থতায় গ্রিসের বিপক্ষে ১-১ ড্রয়ে
বিশ্বকাপ বাছাই শুরু করেছে স্পেন। তবে, ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সে তিনি দেখিয়েছেন যে
থাকতেই এসেছেন তিনি।
প্রতিপক্ষের জমাট
রক্ষণ ভাঙতে দল লড়াই করছিল তখন পেদ্রিকে মাঠে নামাতে দ্বিতীয়বার ভাবতে হয়নি এনরিকেকে।
ম্যাচের ৬৪তম মিনিটে দানিয়েল ওলমোকে তুলে তাকে নামান কোচ। আগামী নভেম্বরে ১৯ বছর পূর্ণ
করতে যাওয়া পেদ্রি যদিও পারেননি দলকে কাঙ্ক্ষিত জয় এনে দিতে; তবে তার প্রচেষ্টায় খুশি
কোচ।
“তারা পেদ্রিকে ‘ম্যান টু ম্যান’ পাহারায় রেখেছিল। সে দুর্ভাগা।
মাঠে নেমে তার বলের খোঁজ করতে হচ্ছিল, ফলে বিষয়টি তার জন্য কঠিন হয়ে উঠেছিল।”
বাছাইয়ে নিজেদের
পরের ম্যাচে জর্জিয়ার বিপক্ষে খেলবে স্পেন। তিন দিন পর তাদের পরবর্তী প্রতিপক্ষ কসোভো।
প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিশ্চিতভাবেই বলে দেওয়া যায়, এই দুই ম্যাচের কোনো একটিতে অবশ্যই
শুরুর একাদশে থাকবেন পেদ্রি।
শুরুর একাদশের ডাক
যখনই আসুক না কেন, বল পায়ে অব্যর্থ সামর্থ্য এবং আক্রমণে রক্ষণচেরা পাস দেওয়ার ক্ষমতার
কারণেই স্পেনের জন্য মহাগুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবেন পেদ্রি। অনেকের ধারণা, আগামী জুন-জুলাইয়ে
হতে যাওয়া এবারের ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে এবং ২০২২ সালের কাতার বিশ্বকাপের পথে গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকা রাখবেন তিনি।
পেদ্রি নিজে অবশ্য
এখনই অত দূর নজর দিচ্ছেন না। এটা ঠিক যে ক্লাব ফুটবলে শুরুটা সাফল্যে রাঙানোয় জাতীয়
দলেও তার থেকে চাওয়াটা এখন অনেক। তবে লক্ষ্যটাকে আকাশছোঁয়া না করে সাধারণ রাখতে চান
তিনি।
“প্রথম জাতীয় ডাক পেলাম। সময়টা উপভোগ
করতে ও যতটা পারি সেরাটা দিতে চাই, যেন আবারও জাতীয় দলে সুযোগ পাই। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ
হলো, কঠিন সময়ে শান্ত থাকতে এবং সেভাবেই সমস্যার মুখোমুখি হতে চাই। মাঠে শুধু অন্য
একজন খেলোয়াড়ের মতোই হতে চাই। কারণ নিজের কাজকে উপভোগ করলে এবং তা থেকে আনন্দ পেলে
সফল হওয়া সম্ভব।”
জাতীয় দলে সুযোগ
পেয়ে বার্সেলোনা কোচ কুমানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন পেদ্রি। বলেন, তাকে ছাড়া আসতে
পারতেন না এই জায়গায়। কারণটা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ফিরে যান বার্সেলোনায় নিজের শুরুর
দিকে।
“একদিন তিনি আমাকে এক কোনে ডেকে
নিয়ে বললেন, তিনি আমার সম্পর্কে খুব বেশি জানেন না। আরও বললেন, এজন্যই তাকে আমার দেখাতে
হবে যে আমি কতটা কী করতে পারি। তার এই কথা আমাকে অনুপ্রাণিত করেছিল।”
নিজের সামর্থ্য দেখানোর
যে পরামর্শ কুমান দিয়েছিলেন সেই সহজ-সরল পথে হেঁটেই পেদ্রি আজ জায়গা করে নিয়েছেন জাতীয়
দলে। তবে সহজ পরামর্শ অনুসরণ করাটা যে কতটা কঠিন তা ভালো করেই জানেন বার্সেলোনার ডাচ
কোচ। তাই, পেদ্রির এমনভাবে নিজেকে মেলে ধরায় বেশ অবাক হয়েছেন তিনি।
“আমাকে সে যতটা অবাক করেছে, আর কেউ
করেনি। সে দলে জায়গা পেয়েছে কারণ সে এর যোগ্য। প্রতিপক্ষ ও তাদের কৌশলের ধরণ অনুযায়ী
সে অন্যরকম এক পজিশনে খেলে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, তার অনেক কিছু দেওয়ার আছে।
সে মেধাবী খেলোয়াড়।”
মাঠে পেদ্রিকে দেখে
অনেকের মনেই ভেসে ওঠে আন্দ্রেস ইনিয়েস্তার কথা। ফুটবল বিশেষজ্ঞদের আলোচনায় ওঠে স্পেনের
বিশ্বকাপ জয়ের নায়কের সঙ্গে তুলনা। বার্সেলোনার ম্যাচ চলাকালীন ধারাভাষাকারদের কণ্ঠেও
প্রায়ই শোনা যায় তা।
পেদ্রির এমন ঝলমলে
আগমন মনে করিয়ে দেয় ২০০৪-০৫ মৌসুমের ইনিয়েস্তার কথা। সত্যিই কি বার্সেলোনার পাশাপাশি
স্পেন জাতীয় দলেও ইনিয়েস্তার শূন্যতা পূরণ করবেন পেদ্রি?
যাকে নিয়ে এত আলোচনা,
তার ভাবনায় নেই ওসবের কিছুই। দেশের ইতিহাসের অন্যতম সেরা ফুটবলার ও ছেলেবেলা থেকে যাকে
আদর্শ মানেন, তার সঙ্গে নিজের তুলনা হতে দেখেই খুশি পেদ্রি।
“ইনিয়েস্তার কোনো ম্যাচ আমি মিস
করতাম না। ইউটিউবে তার সব ভিডিও দেখেছি আমি। মনে হয়, তার কিছু ধরণ আমার খেলায় চলে এসেছে।
তার খেলার ধরণ সবসময়ই আমার খুব প্রিয় এবং মাঠে ও মাঠের বাইরের মানুষ হিসেবে তাকে আমি
সম্মান করি। তিনি আমার রোল মডেল এবং তাকে আমি অনুসরণ করি।”
স্পেনের মানুষ ভাবে,
পেদ্রিই সেই খেলোয়াড় যে তাদেরকে আবারও শীর্ষে নিয়ে যাবে। ২০০৮-২০১২ স্বর্ণযুগে তাদের
ইউরো-বিশ্বকাপ-ইউরো জয়ে ইনিয়েস্তা যে অবদান রেখেছিল, পেদ্রিও সেই ভূমিকা রাখবেন। আদতে
কী হবে, পেদ্রি কতটা পারবেন, তা সময়ই বলে দেবে।