বাংলাদেশের ক্রিকেটে আজকে (বৃহস্পতিবার) বিশেষ দিন। আপনারা ৫ সিনিয়রের কাউকে ছাড়া ১৫ বছর পর মাঠে নামল বাংলাদেশ। কেমন দেখলেন?
সাকিব আল হাসান: নতুন যুগের শুরু, এটাই দেখলাম। এখানে খেলা দেখায় অনেক সমস্যা। কোনো টিভিতে দেখায় না, এমনকি ইউটিউবের ওই লিংকও ব্লকড। তার পরও আজকে ব্রডকাস্টারদের কাছ থেকে একটা লিংক পেয়ে আমাদের ব্যাটিংটুকু দেখলাম।
আমাদের জন্য আসলে ফরম্যাট যত ছোট, কাজটা ততই কঠিন। টি-টোয়েন্টিতেই আমাদের রেকর্ড ভালো নয়। সেখানে আজকে টি-টেন। স্বাভাবিকভাবেই আমাদের জন্য পরিস্থিতি কঠিন ছিল।
কিন্তু ক্রিকেটাররা তো সবসময় বলেন, সংস্করণ যত ছোট, বড় দল ও ছোট দলের ব্যবধান তত কম!
সাকিব: আইডিয়ালি সেটা ঠিক আছে। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়, আমাদের ক্ষেত্রে সত্যি নয়। টি-টোয়েন্টিতে আমরা কখনোই ওরকম কিছু করতে পারিনি। ওয়ানডে ফরম্যাটেই আমরা সবচেয়ে ভালো খেলি। আগেও… ধরেন ২০০০ সালের পর থেকে আমাদের যে দু-একটি বড় সাফল্য এসেছে, সব তো ওয়ানডেতেই। টেস্টে পরের দিকে আমরা অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ডকে হারিয়েছি, টি-টোয়েন্টিতে বড় দু-একটি জয় আছে। তবে ধারাবাহিকভাবে ভালো কিছু ওয়ানডেতেই করতে পেরেছি।
নতুন যুগের শুরু বলছিলেন, কেমন মনে হলো তা?
সাকিব: ১০ ওভারের মধ্যে অলআউট হয়ে যাওয়া তো ভালো কিছু নয় অবশ্যই। তবে এই শুরুটা এমন পরিস্থিতিতে হলো, যেটা এভাবে না হলে ভালো হতো। সফরে সব ম্যাচ হারার পর শেষ ম্যাচে, দলের অবস্থা ভালো নয়, অনেকে ইনজুরির পর বাধ্য হয়েই এটা করতে হয়েছে। বাধ্য হয়ে করতে না হয়ে যদি দলটাই এরকম গড়া হতো, তখন আলাদা ব্যাপার হতো। বিচার করা যেত। কিন্তু এখানে তো মুশফিক ভাই, রিয়াদ ভাইয়ের ইনজুরির কারণে হয়েছে। এভাবে বাধ্য হয়ে করা এক ম্যাচে ওদেরকে বিচার করা কঠিন।
ভবিষ্যতে কি তাহলে পরিকল্পনা করেই এমন দল দেখতে চাইবেন?
সাকিব: আমি মনে করি, সুযোগ আছে। টি-টোয়েন্টি এমন এক ফরম্যাট, যেখানে আপাতত পয়েন্ট হারানো বা পাওয়ার কিছু নেই। মানে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ বা ওয়ানডে লিগের মতো নয়। টি-টোয়েন্টি হয় বিশ্বকাপ ঘিরে। বিশ্বকাপের আগে সামনে অনেক টি-টোয়েন্টি আছে আমাদের। টেস্টে পরীক্ষা করা কঠিন, ওয়ানডেতে আগামী বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করার ব্যাপার আছে। পরীক্ষা-নিরিক্ষা তাই টি-টোয়েন্টিতেই করা যায়।
সেই পরীক্ষা-নীরিক্ষায় কি অধিনায়কত্বও থাকতে পারে?
সাকিব: সবকিছু নিয়েই পরীক্ষা-নীরিক্ষার সুযোগ আছে।
নিউ জিল্যান্ডে বাংলাদেশ কখনও পারে না কেন?
সাকিব: সত্যি বলতে… এটা আসলেই প্রশ্ন করার মতো। কেন পারি না আমরা একদমই! এমন নয় যে, আমরা কখনও কাছাকাছি যাইনি। ২০১৭ সালে (২০১৬-১৭) আমরা ওয়ানডে খুব ভালো খেলেছি, দুটি ওয়ানডেতে সম্ভাবনা সৃষ্টি করতে পেরেছি। টেস্টে একটি অন্তত ড্র করা উচিত ছিল (ওয়েলিংটনে)। এবারও দ্বিতীয় ওয়ানডেতে সুযোগ ছিল। কোনোবারই নিতে পারিনি সুযোগ।
নিউ জিল্যান্ড এমনিতে কঠিন জায়গা। সব দলের জন্যই কঠিন। তবে একদমই যে পারা যায় না, তা নয়। আমরা কেন পারিনি, এটা বড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন। সমাধান আমার জানা নেই।
আপনার কোয়ারেন্টিন কেমন চলছে?
সাকিব: কোয়ারেন্টিনের আজকে পঞ্চম দিন। দ্বিতীয় কোভিড পরীক্ষা হলো। এটায় নেগেটিভ হলে সপ্তম দিনে আরেকটি পরীক্ষা করানো হবে। ওটা নেগেটিভ এলেই বের হতে পারব। বাবলের ভেতরই থাকতে হবে, তবে ঘর থেকে বের হতে পারব। এখন পুরো ঘরবন্দি।
ঘরবন্দি থেকে একবার প্রচণ্ডরকম ডিপ্রেসড হয়ে গিয়েছিলাম। তার পর কালকে থেকে একটু রিকভারি করা শুরু হয়েছে। আজকে বেশ ভালো আছি।
ডিপ্রেশনের তো নানা ধরন আছে…
সাকিব: খুব বাজে রকমের ডিপ্রেশন ছিল, আমার আগে কখনও এরকম হয়নি। পরশুদিন একটা পর্যায়ে আমার মনে হয়েছে… লোকে যে আত্মহত্যা করে ডিপ্রেশনে, কেন করে, সেটা বুঝতে পেরেছি আমি। এতটাই বাজে অবস্থা হয়েছিল…।
আগে যে কোয়ারেন্টিনে থেকেছি, তখন তো ঘর থেকে বের হয়েছি, টিমমেটরা একসঙ্গে ছিলাম, এর-ওর রুমে গিয়েছি, ওরা এসেছে। একটা ফ্লোরে সবাই ছিলাম। মিশতে পেরেছি। এখানে একদম রুম কোয়ারেন্টিন, কারও সঙ্গে দেখা করা, কথা বলার উপায় নেই। দরজার বাইরে খাবার দিয়ে যায়। আমার এরকম অভিজ্ঞতা ছিল না আগে।
আমি ঘোরাফেরা করতে পছন্দ করি, কাজ-টাজ না থাকলে ভালো লাগে না কখনোই। জীবন সবসময়ই ব্যস্ততায় কাটে আমার। সেদিক থেকে খুব কঠিন হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ এরকম অবস্থায় পড়ে… পুরো জেলখানার স্বাদ পেলাম। যেটা বললাম, মানুষ ডিপ্রেশনের কোন পর্যায়ে গেলে আত্মহত্যা করতে চায় বা করে, সেটা অনুভব করেছি।
এত দ্রুত সেটি কাটিয়ে উঠলেন কীভাবে?
সাকিব: ওভারকাম করে ফেলেছি আর কী। একদিন যাওয়ার পর নিজেকে বোঝলাম যে এভাবে থাকা যাবে না। টিভি, নেটফ্লিক্স, অ্যামাজন প্রাইম, সবই চলছিল। কিন্তু এসব আর কত ভালো লাগে! এখন প্ল্যান করে ফেলেছি যে কী কী করা যায়, কোনটা কীভাবে করলে কোয়ারেন্টিনের সময়টা কাটবে। এমনিতে আমার কয়েকটা কাজ একসঙ্গে করার অভ্যাস। ধরেন, মুভি দেখার সময় কারও ম্যাসেজের রিপ্লাই দিলাম বা ই-মেইল করলাম বা অন্য কিছু। এখন একসময়ে একটিই করছি, যেন বেশি সময় ব্যস্ত থাকা যায়।
আরেকটা ব্যাপার ভালো হয়েছে, যখন থেকে এক্সারসাইজ করা শুরু করেছি, জুম কলে আমাদের ট্রেনার এক্সারসাইজ করায় প্রতিদিন, ওটা শুরু করার পর থেকে একটু ভালো লাগছে।
এখন পাঁচদিন হয়ে গেছে, আর দুই দিন মাত্র বাকি, ভাবতেই ভালো লাগেছ।
কোয়ারেন্টিন শেষ হওয়ার পর প্রথম কি করবেন?
সাকিব: সকালে যদি হয়, শুরুতে যাব জিম ও সুইমিং করতে। এটার পর বিকেলে ট্রেনিং। আর বিকেলে ছাড়া পেলে সরাসরি ট্রেনিংয়ে যাব।
অনুশীলনে কোন দিকটায় শুরুতে মনোযোগ দেবেন?
সাকিব: গ্যাপ যেহেতু পড়ল, নতুন করে শুরু করতে হবে সবকিছু আবার। আমি চাই না সামনে এরকম গ্যাপ আর দিতে।
ফিটনেসের কাজ রুমের ভেতরে যা করছি, একটু ভালো অবস্থায় চলে এসেছে। বের হওয়ার পর আরও করব। স্কিল নিয়ে অনেক কাজ করতে হবে। হিটিং প্র্যাকটিস বলেন, বোলিং ড্রিল, সবই করতে হবে।
আইপিএলের জন্য ছুটি চাওয়ার চিঠিতে আপনি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রস্তুতির জন্য আইপিএল খেলার কথা বলেছেন। কলকাতার একাদশে নিয়মিত খেলার সুযোগ আপনার নাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রস্তুতি কীভাবে নেবেন?
সাকিব: আইপিএলে ট্রেনিংয়ের সুযোগ-সুবিধা অনেক। ম্যাচ শুরু হয়ে গেলে অবশ্য সময় কতটা পাব, জানি না। তবে যথেষ্ট সুযোগ সাধারণত থাকে। আগেও সেটা কাজে লাগিয়েছি।
যদি ম্যাচ না খেলি, তাহলে ম্যাচ ডেতে প্র্যাকটিস করব। পুরো ট্রেনিং করতে পারব। আগেই জানা যায় যে কে খেলছে, কে খেলছে না। ওভাবেই প্রস্তুতি নেব। ম্যাচ খেললে তো ম্যাচেই প্রস্তুতি হলো। আর খেলি, না খেলি, ট্রেনিং ভালোভাবে হবেই।
একটা প্রশ্ন উঠছে যে আপনি শ্রীলঙ্কায় টেস্ট খেলে তারপর আইপিএলে যেতে পারতেন কিনা? মাসখানেক সময় থাকবে তখনও…
সাকিব: আমাদের কিন্তু ওয়ানডে সিরিজও আছে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। মে মাসের ১৮-১৯ তারিখে মনে হয় ওদের আসার কথা ঢাকায়। ওই সিরিজে আমি খেলব। এই কারণেই বিসিবি আমাকে ছুটি দিয়েছে ওই সিরিজের আগ পর্যন্ত। আমি তো ডেট ফিক্সড করে ছুটি চাইনি! আমি বলিনি যে এই তারিখ থেকে এই তারিখ পর্যন্ত ছুটি চাই।
বিসিবিই ঠিক করেছে, আপনাকে এই কদিনের ছুটি দেবে?
সাকিব: হ্যাঁ, বোর্ডই ছুটির সময়টা ঠিক করেছে।
বোর্ড যদি ছুটি না দিত?
সাকিব: অবশ্যই আমি চেষ্টা করতাম ছুটিটা নেওয়ার। যেভাবে বলে বা অনুরোধ করে সম্ভব হয়, সর্বোচ্চ চেষ্টা করতাম। তারপরও না দিলে তো আমার কোনো অপশন ছিল না। টেস্ট খেলতেই যেতে হতো।
তবে আমার মনে হয় না, এরকম পরিস্থিতি আবার আসবে বা বারবার হবে। নরম্যাল সময়ে যদি শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজটি হতো, যখন আমি নিষেধাজ্ঞার পর ফিরলাম দেশে, ওই সময়ে হলে এসবের প্রশ্নই আসত না। আইপিএলের এই পুরো সময় ফ্রি থাকতাম আমি। তখন এই কথাগুলো উঠতো না।
এই কথাগুলি ওঠায় সাকিব আল হাসান কি বিচলিত? বা কতটা গুরুত্ব পাচ্ছে তার কাছে?
সাকিব: বিচলিত… জানি না, ওরকম কিছু ভাবিই না। তবে আমার কাছে মনে হয়, ক্রিকেটারদের নিজেদেরও ব্যক্তিগত পছন্দ থাকতে পারে, থাকা উচিত এবং বিসিবি যে সেটাকে সম্মান করেছে, এজন্য তাদেরকে ধন্যবাদ জানাই।
আপনার আইপিএল খেলতে চাওয়া আর শ্রীলঙ্কা সফর থেকে ছুটি নেওয়া নিয়ে সম্প্রতি একটি সাক্ষাৎকারে আকরাম খানকে নিয়ে বেশ কিছু কথা বলেছেন আপনি। কিন্তু আপনার টেস্ট খেলতে না চাওয়ার কথা সবচেয়ে বেশি বলেছেন বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান। আকরাম খান বলেছেন এই সফরের কথা, বোর্ড সভাপতি কয়েকবারই বলেছেন, আপনার টেস্ট খেলারই আগ্রহ নাই। অথচ তাকে ধন্যবাদ দিয়েছেন…!
সাকিব: (উচ্চস্বরে হেসে) এটার উত্তর শুধু হাসিই হতে পারে। আর কোনো উত্তর নাই।
যদিও ভালো কিছুর প্রত্যাশা থাকবে, তারপরও ক্রিকেটীয় কারণেই হতে পারে যে আপনার বিশ্বকাপ বাজে গেল। তখন তো লোকে প্রশ্ন করবে যে আইপিএল খেলে লাভ হলো কি?
সাকিব: লোকে মনে করতেই পারে। আমি দোষ দেই না, ভাবিও না। তাদের ভাবনা থাকবে, সিদ্ধান্ত থাকবে। আমাদের দেশের মানুষরা খুব দ্রুত উপসংহারে চলে আসে, কিছু একটা ঘটার সঙ্গে সঙ্গেই। মুদ্রার একটা পাশ দেখেই সব বলতে পারে, অন্য পাশ দেখতে হয় না। তাদের কথা নিয়ে আমার টেনশন নেই।
আমার কাজ হলো, কতটা ভালো প্রস্তুতি নিতে পারি আর কতটা ভালো খেলতে পারি। দিনশেষে মাঠে যখন খেলতে নামব, তখন সবকিছু আমার হাতে থাকবে না। কিন্তু প্রস্তুতি আমার হাতে, সেটা আমি সেরাটাই নেওয়ার চেষ্টা করব। তার পর ভালো খেলতে পারলে আলহামদুলিল্লাহ, না পারলে নাই। কিন্তু প্রস্তুতি ভালো না নিয়ে গিয়ে যদি খারাপ করি, ওই আফসোস করতে চাই না।
আপনি একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে, আইপিএল খেলতে গেলে অন্যান্য দেশের ক্রিকেটারদের সম্পর্কে জানতে পারবেন, কাছ থেকে দেখতে পারবেন, কোথায় তাদের উন্নতি হলো বা কোথায় ঘাটতি… এসব বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলকে সহায়তা করবে। কিন্তু এখন তো অ্যানালিস্টদের ল্যাপটপে দুনিয়ার সবকিছু থাকে, ঘরোয়া ক্রিকেটারদের খুঁটিনাটিও থাকে। এটার জন্য আইপিএল খেলতে যাওয়া জরুরি?
সাকিব: তারপরও আমরা অনেক কিছু চাই না? হাতে কলমে দেখা ও জানার প্রয়োজন আছে না? এই যে এখানে সব দল ক্যাম্প করছে, দুই সপ্তাহ আগে থেকেই সবাই ট্রেনিং করছে, এসব তাহলে কেন করছে সবাই একসঙ্গে থাকে, ক্যাম্প করে, মানিয়ে নেওয়ার ব্যাপার থাকে। অ্যানালিস্ট দিয়ে তো এসব হয় না। জানার শেষ তো নাই।
আর এখানে একটা ব্যাপার হলো, প্রতিযোগিতা। লোকাল ক্রিকেটারদের একটা প্রতিযোগিতা তো আছেই, বিদেশি ক্রিকেটারদের প্রতিযোগিতা তীব্র। ১০ জন বিদেশি থেকে মাত্র চারজন খেলতে পারে। এটা যে একটা লড়াই তৈরি করে, এটা তো আর কোথাও পাওয়া যায় না।
আমাদের জাতীয় দলে একজন নতুন ক্রিকেটার এলে, তার হয়তো প্রতিযোগিতা করতে হয়। আমার তো জায়গা নিশ্চিত। যদিও এভাবে বলা ঠিক নয়, কিন্তু বাস্তবতা বললাম। জানিই যে দলে থাকব। জায়গা পাওয়ার চ্যালেঞ্জটা তো আসে না। কিন্তু এখানে আমি জানি না, ম্যাচ খেলব কী খেলব না।
আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, আমি একটা পরিকল্পনা করেছি যে সামনে যেহেতু টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ, আমি যত বেশি টি-টোয়েন্টি খেলব, তত বেশি জানতে পারব। এটার কোনো শেষ নেই। ১ হাজার টি-টোয়েন্টি খেলার পরও আরও একটি ম্যাচ খেললে আরও বেশি জানব।
আমি যদি ঠিকভাবে ট্রেনিং করতে পারি… ধরুন, আমাদের দেশে তো অত বিগ হিটার নাই। এখানে আমি যাদের সঙ্গে বা বিপক্ষে খেলব, আরও অনেক কোচ আছেন, তারা হয়তো অনেক টেকনিক দেখাতে পারেন, হতে পারে একটা ছোট্ট টিপসও বড় উপকার করতে পারে আমার, ওদের সঙ্গে কথা বলে একটা-দুইটা জিনিস হয়তো পিক করলাম, যা বিশ্বকাপে কাজে লাগবে। নাও হতে পারে, তবে হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
আর আর্থিক দিকটা?
সাকিব: অবশ্যই আছে। এখানেও দ্বিমত করব না। অবশ্যই আছে। আমার ক্যারিয়ার হয়তো খুব ভালোভাবে এগোলেও আর তিন বছর আছে বা চার বছর। ৩৪ পূর্ণ হলো। খারাপ খেললে আরও আগেও শেষ হতে পারে ক্যারিয়ার।
এর মানে এটাই নয় যে আমি জাতীয় দলকে ছোট করে দেখছি, বা গুরুত্ব দিচ্ছি না। কোনোভাবেই তা নয়। আমি এখনও চাই জাতীয় দলের সব ম্যাচে অ্যাভেইলেবল থাকতে। কিন্তু একমাত্র বাংলাদেশেরই মনে হয়, আইপিএল এলে সিরিজ চলে আসে। অন্যান্য দলের তা আসে না।
সেটার কারণ হতে পারে যে বাংলাদেশ থেকে কেবল আপনিই নিয়মিত খেলেন! মুস্তাফিজ মাঝে মধ্যে…
সাকিব: (একটু ভেবে)… হতে পারে, সেটা হতে পারে। তবে সবদিকই মাথায় রাখা উচিত। আমি নিশ্চিত যে এটা আরও পরিকল্পনা করে করা সম্ভব হবে পরের বার থেকে। এখন কোভিডের কারণে কোনো কিছুই কারও হাতে নেই। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ আদৌ হবে কিনা, সেটাও তো কেউ জানে না!
যেভাবে কোভিডের অবস্থা খারাপ হচ্ছে, শ্রীলঙ্কায় আমাদের দল যেতে পারবে কিনা বা ওরা বাংলাদেশে আসতে পারবে কিনা, কে জানে! ভারতের অবস্থাও তো ভালো নয়। আমি ফিঙ্গার ক্রসড রাখছি, আল্লাহর কাছে দোয়া করছি যেন সব দেশের কোভিডের অবস্থা ভালো হয়, সবকিছু নরম্যাল হয়। তখন আমরা পরিকল্পনা করতে পারি। এখন তো পরিকল্পনা করা কঠিন।
আমি তো এক বছর নিষিদ্ধ ছিলাম, খেলিনি। আমার ইনকার্ম সোর্স তো নেই! সামনেও যদি খেলা বন্ধ থাকে কোভিডের জন্য, আয় কোত্থেকে আসবে আমার! আমার তো এমন নয় যে ১০-১২টা ব্যবসা আছে। আমি কেন, সব ক্রিকেটারের ক্ষেত্রেই সত্যি এটা।
লোকে তো বলে আপনার শত শত কোটি টাকা!
সাকিব: এটা তো… (হাসি)… যারা বলেন, তারা যদি দেখিয়ে দেন যে কোথায় টাকা, তাহলে সুবিধা হয়। অবশ্য তাদের কথায় আমি মাইন্ড করি না, তারা আমার স্বপ্নটাকে বড় করে দেয়। ভাবে যে আমার অনেক টাকা। এটা আমার জন্য খুশির বিষয়। তবে তারা একটা-দুইটা শূন্য বেশি লাগিয়ে বলে আর কী।
যারা বলেন, তাদের কমনসেন্স থাকা উচিত। বাংলাদেশের মার্কেট কত বড়? বাংলাদেশে একটা বিজ্ঞাপন করে কত টাকা পেতে পারেন? ১৫-২০-২৫ বা ৫০ লাখ? কয়টা টিভি কমার্শিয়াল করেন জীবনে? কয়টা ম্যাচ খেলতে পারেন? কয় টাকা আয় হয়! বোর্ড থেকে কত বেতন, ম্যাচ ফি, এসব তো সবাই জানেই। আমাদের খরচও তো অনেক। কত থাকে তার পর?
লোকের পারসেপশন থাকে নানারকম। তারা আমাদের ভাবেন বাংলাদেশের ক্রিকেটার, আয় ভাবেন ভারতীয় ক্রিকেটারদের মতো। আপনারাই যেমন নিউজ করেন, অমুক ক্রিকেটার এত মিলিয়ন ডলারের চুক্তি সই করেছে, তমুক ক্রিকেটার করেছে। ওই নিউজ দেখে লোকে আমাকে ওই লেভেলের ভাবে। কিন্তু এটা চিন্তা করে দেখে না, ভারতে কোনো ক্রিকেটার যদি একটা চকলেটের বিজ্ঞাপন করে, তাকে যদি ৫০ কোটি টাকাও দেওয়া হয়, তবু পুষিয়ে যায়, এত বড় বাজার ওদের। লোকে দেখে বিরাট কোহলি ১০ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি করেছে। তখন মনে করে, সাকিবেরও এরকম। তারা বোঝেন না, এটা আসলে ১০ লাখ টাকা!
দেখা গেল, ২০১৯ বিশ্বকাপের মতো আপনি একা খুব ভালো করলেন। অন্যরা পারল না। তাহলে?
সাকিব: দল হিসেবে ভালো না করলে আমাদের খুব ভালো করার সম্ভাবনা নাই। আমাদের ওরকম ক্রিকেটার নাই যে একা ম্যাচ জিতিয়ে দিতে পারবে। দলীয় অবদান লাগবে, অন্তত চার-পাঁচজনের ভালো করতে হবে। এই ব্যাপারটিতেও আমাদের ক্রিকেটারদের দায়িত্ব আছে বদলানোর, যেদিন যে খেলবে, তার দায়িত্ব থাকবে জিতিয়ে নেওয়ার।
বিশ্বকাপের আগে আমাদের দেশে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, নিউ জিল্যান্ড আসবে। এটা আমাদের জন্য ভালো কাজে লাগবে ।
টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার ২১ বছর পরও বাংলাদেশে যে মিরপুরের বাইরে ভালো সুযোগ-সুবিধা নেই, এটা হতাশাজনক নয়?
সাকিব: অবশ্যই। এটা আসলে ডিভিশনগুলোর ওপর দায়িত্ব না দিলে হবে না। সুযোগ-সুবিধা আছে কিছু। কিন্তু ভালো মানের নয় যে সব জায়গায় বোলিং মেশিন পাবেন, গ্রানাইটের স্লাব পাবেন অনেক নেট বোলার পাবেন কিংবা উইকেট চাইলেই প্রস্তুত পাচ্ছি, ওগুলা একমাত্র মিরপুরেই আছে। এই মাঠের ওপরই অত্যাচার চলে, কোনো বিশ্রাম পায় না।
বিকেএসপিতে ভালো কয়েকটি মাঠ আছে, কিন্তু প্রতিদিন গিয়ে প্র্যাকটিস করা সম্ভব নয় যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে।
দেশের ক্রিকেটের কোন জায়গাটিতে উন্নতি করা সবচেয়ে জরুরি, যা করলে দ্রুত উন্নতি হবে?
সাকিব: আমাদের দেশের আসলে উইকেটগুলো ভালো করা উচিত। উইকেট ভালো হলে ব্যাটসম্যানরা আরও ভালো করবে, বোলাররা স্কিলফুল হবে।
লিমিটেড ওভারের জন্য একদম ট্রু উইকেট হওয়া উচিত। ওয়ানডেতে যেখানে রান হবে সাড়ে তিনশ, টি-টোয়েন্টিতে অন্তত ১৮০। দু-একটি ম্যাচ এদিক-সেদিক হবে। বেশির ভাগ সময়ই রান হবে। আপনি যত বেশি রান করবেন, আত্মবিশ্বাস তত বেশি বাড়বে। ট্রু উইকেটে ব্যাটসম্যানদের হাতে শট বেড়ে যায় অনেক।
আমরা দেশে ধীরগতির উইকেটে খেলি। এজন্য আমাদের শট কম থাকে, স্কিল লেভেলও কম। ওই জায়গায় উন্নতি করতে হলে ভালো উইকেট লাগবেই। কেবল বিপিএলের সময় চট্টগ্রামে ভালো উইকেট পাই, সিলেটে পাই।
২০১৯ বিশ্বকাপের আগে হায়দরাবাদে আমি যখন প্র্যাকটিস করেছি, এত ভালো উইকেট, আত্মবিশ্বাসই অন্যরকম হয়ে যায়। ব্যাটে বল লাগার শব্দই আলাদা, শান্তি লাগে। এ কারণেই ভারতীয় ক্রিকেটাররা এত মারতে পারে। ওদের শারীরিক গঠন তো আমাদের থেকে খুব আলাদা নয়। কিন্তু ওদের বিশ্বাস বেশি, স্কিল ভালো। মেরে মেরেই ওদের অভ্যাস।
আমাদের মেরে খেলার অভ্যাস নেই। এখানকার উইকেটে টিকে থাকার চিন্তা করতে হয়। বল নিচু হয়, বাউন্স অসমান, পিচ করে ধীরে আসে। আমরা কি এখানে টার্নের বিপক্ষে শট খেলতে পারব? মারতে গেলেই তো আউট। কারণ বল নিচু হবে, থেমে আসবে। ভারতীয় ব্যাটসম্যানরা দেখেন, টার্ন কী বা আউট সুইং কী, সমানে মেরে যাচ্ছে। মিড উইকেটে, স্কয়ার লেগে মারছে। কারণ বল ব্যাটে আসে ভালো।
ভালো ব্যাটিং উইকেটে বোলারদেরও উন্নতি হবে। কারণ স্কিল ভালো না হলে টিকে থাকতে পারবে না। তাদের কাজ করতেই হবে।
উইকেট ভালো করতে পারলে আমাদের জন্য খুব ভালো হবে।
ওয়ানডে অধিনায়ক তামিম ইকবালকে কেমন দেখলেন?
সাকিব: ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ওই তিন ম্যাচের প্রমাণের কিছু ছিল না। আর নিউ জিল্যান্ড সিরিজ তো দূর থেকে দেখলাম। আমার জন্য বলা মুশকিল। দলে থাকলে ভালোভাবে মূল্যায়ন করতে পারতাম।
আর একজন অধিনায়ককে ছয়-সাত ম্যাচে কতটাই বা মূল্যায়ন করবেন! অন্তত ১০টা ম্যাচ দেখলে বলা যায়।
অন্য দুই অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ ও মুমিনুল?
সাকিব: রিয়াদ ভাইয়ের নেতৃত্বে তো জাতীয় দলে খেলিনি। দূর থেকে বলা কঠিন। এবার বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টিতে যখন খেললাম, তখন ভালো লেগেছে। মুমিনুলের অধিনায়কত্বে তো একদিন খেলেই বের হয়ে গেলাম!
আমি কাউকে দেখার সুযোগ সেভাবে পাইনি। বাইরে থেকে একরকম মূল্যায়ন করা যেতেই পারে। তবে মাঠের ভেতর থাকলে বোঝা যায় কী হচ্ছে আসলে। তখন মূল্যায়ন করা সহজ।
টেস্টে হয়তো পাঁচ-সাত ম্যাচ দেখে, ওয়ানডেতে আট-দশ ম্যাচ, টি-টোয়েন্টিও ওরকম দেখতে পারলে ব্যক্তিগত ধারণা করতে পারতাম।
আপনাকে যদি আবার দেওয়া হয় নেতৃত্ব?
সাকিব: বিসিবি থেকে যদি দেয় আবার, অবশ্যই চেষ্টা করে দেখব। তবে এখনও পর্যন্ত ওরকম চিন্তা নাই। অধিনায়ক হলে একটাই সমস্যা, আপনাদের কাছ থেকে জ্বালা-যন্ত্রণা অনেক বেশি। এছাড়া আর যন্ত্রণা নেই।
জাতীয় দলের অধিনায়কত্ব করা আমার কাছে বরং আরও সহজ, ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্টের চেয়ে। আমি অনেক কমফরটেবল থাকি।
কিন্তু ওই যে যন্ত্রণার কথা বললাম, কে নেবে এই বয়সে এসে! ওই এসব নিয়ে ভাবার ব্যাপার আছে। যদি আলোচনা হয় কখনও, তখন বিবেচনা করব যে এই বয়সে এই জ্বালা নেব কিনা, দরকার আছে কিনা, আমার দরকার না থাকলে দলের দরকার আছে কিনা… প্রস্তাব পেলে সমীকরণ তখন ভাবা যাবে। আপাতত আমার চিন্তা আইপিএলে ভালো করা নিয়ে।
অবশ্য আইপিএল ভালো করলেও গালি খাব, না করলেও গালি খবি। তবে ওটা অন্য বাপার। একটা দলের প্রত্যাশা আছে আমার ওপর, সেটা পূরণ করার চেষ্টা করব।
ভালো করলেও গালি খাবেন, এই ধারণা হলো কেন?
সাকিব: তখন টেস্ট ম্যাচ চলবে না আমাদের শ্রীলঙ্কায়! বলা হবে যে আইপিএলে ভালো খেলছে, অথচ শ্রীলঙ্কায় যায়নি (হাসি…)। অবশ্যই আশা করি যে, দল শ্রীলঙ্কায় ভালো করবে। ভালো করবেও, আমার বিশ্বাস।
দল ভালো করলে হয়তো আমার রেহাই পাওয়ার একটা উপায় আছে। তখন লোকে বলবে, ‘ঠিক আছে, তাহলে সে খেলুক। দল ভালো করছেই।’
আমাদের কাছ থেকে জ্বালা-যন্ত্রণার কথা বলছিলেন, মিডিয়া সামলানোও তো অধিনায়কত্বের অংশ…
সাকিব: অবশ্যই। খুব সিরিয়াস হয়ে যে বলেছি, তা নয়। অধিনায়ক হলে তো সেসব মেনে নিয়েই হব।
নিষেধাজ্ঞার আগে আফগানিস্তান টেস্টের সময় আপনি বলেছেন যে নেতৃত্ব উপভোগ করেন না, জোর করে দেওয়া হয়েছে…
সাকিব: একেকসময় একেক বাস্তবতা থাকে, পরিস্থিতি তৈরি হয়। প্রতিদিন বদলায়। একটা সময়ের সঙ্গে আরেক সময়ের তুলনা করা কঠিন।
গত দুই বছরে জাতীয় দলের হয়ে বেশি ম্যাচ খেলতে পারিনি। এখন তাই ভাবনা অন্যরকম, মাথা অনেক ফ্রেশ, চিন্তা-ভাবনা আসতেই পারে। আবার টানা খেলা হতে থাকলে চিন্তা বদলে যেতে পারে। বলা মুশকিল।
কিন্তু এখন আমি ওপেন টু এনিথিং অ্যান্ড এভ্রিথিং।
নিষেধাজ্ঞার ঘটনায় আপনার সবচেয়ে বড় শিক্ষা কি?
সাকিব: (একটু ভেবে) কোনো কিছু হালকাভাবে না নেওয়া।
এই ঘটনা কি আপনি পুরো পেছনে ফেলে এসেছেন নাকি এখনও কাঁটা হয়ে বিদ্ধ করে?
সাকিব: মনে তো পড়েই। খুব বেশি খারাপ লাগে না। কোভিডের কারণে এক বছর খেলা হয়নি, সেদিক থেকে আমি ভাগ্যবান ছিলাম।
লোকে তো ভুল করেই, ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়াই আসল। এমন ভুল আর করব না কখনও।
আপনি ইদানিং নিয়মিতই বলছেন যে আর বেশি দিন খেলবেন না। কোনো নির্দিষ্ট সময়ের দিকে কি লক্ষ্য আছে?
সাকিব: ওরকম কোনো পরিকল্পনা নাই। যতদিন উপভোগ করছি, খেলতে থাকি। যেহেতু এখন তিনটি ফরম্যাট, একটা একটা করে হয়তো ছাড়ব, একসঙ্গে নয়।
সেক্ষেত্রে কোনটি আগে ছাড়বেন?
সাকিব: দেখতে হবে যে কোনটায় ভালো করছি , কোনটা অতটা ভালো করছি না। যেটা ভালো করব না, মনে হবে যে আমি না থাকলেই দলের ভালো, সেটাই আগে ছাড়ব। এখন তো আপাতত তিনটিই বেশ ভালো যাচ্ছে। টানা যখন খেলতে থাকব, তখন পরিস্থিতি অনুযায়ী ভাবব। তবে আগামী দুই বছর অন্তত কিছু নিয়ে ভাবতে চাই না।
অবসর যখন নেবেন, হুট করেই হবে নাকি ভেবেচিন্তে?
সাকিব: হুট করে হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি থাকবে। কিছুদিনের একটা প্ল্যান থাকতে পারে যে আর একটা বা দুই সিরিজ খেলব, এরকম।
অবসরের আগে একটি বড় ট্রফি না পেলে…
সাকিব: অবশ্যই চাই…এটাই একটা আশা… ট্রফি জিতে অবসরে যেতে না পারলে খুশি মনে যেতে পারব না। খুব খুব চাওয়া থাকবে, আশা থাকবে ট্রফি জয়ের।