সদর উপজেলার শিবগঞ্জ পারপুগী গ্রামে এই কারখানা
তৈরি করেছে ‘রাজ্জাক গ্রুপ’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান।
এই কারখানায় ইট তৈরিতে আগুনে পোড়াতে হয় না;
মেশিনের সাহায্যে চাপ প্রয়োগ করে ইট প্রস্তুত করা হয়।
কারখানার কাঁচামাল বালু আসে নদী থেকে; সিমেন্ট আসে
বাজারের। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে সংগ্রহ করা হয় পাথরকুচি এবং দিনাজপুরের
বড়পুকুরিয়া তাপ বিদুৎ কেন্দ্র থেকে সংগ্রহ করা হয় ফ্লাই অ্যাশ (কয়লার ছাই)।
সরেজমিনে দেখা যায়, কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত ‘ভাইব্রো
ক্যাভিটি’ যন্ত্রে উৎপাদিত হচ্ছে ইট। স্বয়ংক্রিয়ভাবে নির্দিষ্ট পরিমাণ অ্যাশ,
বালু, সিমেন্ট ও পাথরকুচি এসে মিশে যাচ্ছে। এরপরই যন্ত্রের চাপে তৈরি হচ্ছে
পরিবেশবান্ধব ইট। ইট পোড়ানোর প্রয়োজন পড়ছে না।
কারখানার ব্যবস্থাপক আসলাম হোসেন বিডিনিউজ
টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ব্যবসায়িক কাজে হাবিবুল ইসলাম মাঝেমধ্যে বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ
করেন। সেসব দেশে অবকাঠামো নির্মাণে পরিবেশবান্ধব ইটের ব্যবহার তার নজরে পড়ে। এরপর
তিনি বাংলাদেশে পরিবেশবান্ধব ইট উৎপাদনের পরিকল্পনা নেন।
তিনি জানান, গত বছরের ১৯ নভেম্বর এখানে ইট উৎপাদন
শুরু হয়। এই কারখানায় ইট তৈরিতে আনুপাতিক হারে ৪০ শতাংশ ফ্লাই অ্যাশ, ৪০ শতাংশ
বালু, ১৫ শতাংশ সিমেন্ট ও ৫ শতাংশ পাথরকুচি ব্যবহার করা হয়।
কারখানার ‘ভাইব্রো ক্যাভিটি’ নামের যন্ত্রে প্রতি
৮ ঘণ্টায় ২০ হাজার ইট তৈরি করা সম্ভব বলে জানান তিনি।
সম্প্রতি এই কারখানা থেকে ইট ক্রয় করে বাড়ি
নির্মাণ করেছেন শহরের কলেজপাড়ার সফিকুল ইসলাম।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন,
“পরিবেশবান্ধন এই ইট দিয়ে বাড়ি নির্মাণ করেছি। এর ফলে বাড়ির সৌন্দর্য যেমন বৃদ্ধি
পেয়েছে; পাশাপাশি খরচও কম হয়েছে।”
রাজ্জাক গ্রপের চেয়ারম্যান হাবিবুল ইসলাম বিডিনিউজ
টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, অন্যান্য ইটভাটাগুলোতে ইট তৈরির জন্য ফসলি জমি থেকে মাটি
কেটে আনা হয়। এরপর সেই মাটিকে ইটের রূপ দেওয়ার পর পোড়ানো হয়। আর জ্বালানি হিসেবে
সেসব ইটভাটায় কাঠ, গাড়ির পুরোনো টায়ার ও রাবার পোড়ানো হয়।
“এতে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হয়। পরিবেশ বাঁচাতে
পরিবেশবান্ধব ইটের বিকল্প নেই। এই চিন্তা থেকেই এই কারখানা চালু করেছি। আর আমার
কারখানা থেকে পরিবেশবান্ধন ইট তৈরি করছি।”
হাবিবুল ইসলাম জানান, এখানে ইট তৈরি করতে আগুনের
তাপ প্রয়োজন হয় না। অত্যাধুনিক মেশিনের মাধ্যমে চাপ প্রয়োগ করে পরিবেশবান্ধব ইট
প্রস্তুত করে বাজারজাত করা হয়।
“পরিবেশবান্ধব এই ইট তৈরির কাঁচামাল হলো নদীর
বালু,বাজারের সিমেন্ট, পাথরকুচি ও ফ্লাইঅ্যাশ। সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে পাথরকুচি
এবং দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া তাপ বিদুৎ কেন্দ্র থেকে কয়লার ছাই সংগ্রহ করা হয়।”
তিনি আরও জানান, সাধারণ ভাটায় ১ নম্বরের ১ হাজার
ইট তৈরিতে খরচ হয় কমপক্ষে সাড়ে ৮ হাজার টাকা, কিন্তু পরিবেশবান্ধব কারখানায় ১
হাজার ইট তৈরিতে খরচ হয় ৮ হাজার টাকা।
৩ থেকে ৪ একর জমি হলে পরিবেশবান্ধব কারখানা
নির্মাণ করা সম্ভব জানিয়ে তিনি বলেন, এই কারখানায় অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতিসহ
অন্যান্য যন্ত্রাংশ মিলে ৩৫ থেকে ৪০ লাখ টাকা খরচ হয়। আর
১০ থেকে ১৫ জন শ্রমিক দিয়ে এই কারখানাটি পরিচালনা করা যায়।
কারখানাটির দায়িত্বে থাকা প্রকৌশলী মোশারুল ইসলাম
বলেন, এই ইট মজবুত;,সব পাশ মসৃণ হওয়ায় দেখতেও আকর্ষণীয়। আবার স্বয়ংক্রিয়ভাবে
তৈরি হওয়ার কারণে এই ইট মৃষণ হয়, এতে আস্তর ও গাঁথুনির জন্য সিমেন্ট ও বালির
মিশ্রণ কম লাগে। এতে শ্রমিকের মজুরি ৪০ ভাগ সাশ্রয় হয়। এই
ইট দীর্ঘদিন পরও নোনা ধরে না, রং ফিকে হয় না। এখানে উৎপাদিত ইট আগুন প্রতিরোধী।
উৎপাদন প্রক্রিয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, নির্দিষ্ট
অনুপাতে কাঁচামাল প্রথমে ওজন করে মেশিনে মিশ্রণ করা হয়। এরপর তাতে পানি মিশিয়ে
ভাইব্রো মেশিনে পাঠানো হয়। সেখানে চাপের মাধ্যমে ট্রেতে থাকা ১২টি ইট একই সঙ্গে
তৈরি হয়। এরপর ট্রে-এর ইটগুলো কিউরিং এরিয়াতে রেখে ১৫ থেকে ২১ দিন নিয়মিত পানি
দ্বারা কিউরিং করা হয়। সকল প্রক্রিয়া শেষে ইটগুলো ক্রেতাদের কাছে সরবরাহ করা
হয়।
তার ভাষ্য, পোড়ামাটির ইটের স্থায়িত্ব দিন দিন কমে
আসে। আর এই ইটের স্থায়িত্ব দিন দিন বাড়ে। কারণ, এই ইট তৈরি হয় অ্যাশ,সিমেন্ট,বালু
ও পাথর দিয়ে। আর পোড়ামাটির ইট তৈরি হয় শুধু মাটি দিয়ে। সবকিছু চিন্তা করলে পুরো
ভবন নির্মাণে প্রচলিত ইটের চেয়ে খরচ কম হয়।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি)
ঠাকুরগাঁও কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী শাহারুল আলম মন্ডল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর
ডটকমকে বলেন, “পোড়ামাটির ইটের পরিবর্তে পরিবেশবান্ধব ইট দিয়ে অবকাঠামো নির্মাণ
বিষয়ে সরকারি পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এ উদ্যোগ কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে আমি মনে করছি।
বাংলাদেশে আর কোথাও ফ্লাই অ্যাশ দিয়ে ইট তৈরি হয় কি না, আমার জানা নেই।”
পরিবেশবান্ধব ইট তৈরি করে রাজ্জাক গ্রুপ দৃষ্টান্ত
স্থাপন করেছেন উল্লেখ করেন এবং দেখাদেখি অনেকেই এখন পরিবেশবান্ধব ইট তৈরিতে আগ্রহী
হয়ে উঠবে বলে আশা করছেন তিনি।
ঠাকুরগাঁওয়ের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক)
নুরু কুতুবুল আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রাজ্জাক গ্রুপের এ উদ্যোককে
আমরা সাধুবাদ জানাই। এ কারখানার ফলে একদিকে যেমন পরিবেশ ভালো থাকছে, অন্যদিকে
মানুষ অল্প খরচে তাদের ঘর নির্মাণ করতে পারছে।”
পরিবেশবান্ধব ইট কারখানা কর্তৃপক্ষকে সকল ধরনের
সহযোগিতা করার আশ্বাস দেন তিনি।