ক্যাটাগরি

সাঁওতালদের আদি উৎসব ‘বাহাপরব’

চৈত্র মাস। তাই গোটা শালবন সেজেছে নতুন সাজে। গাছে গাছে সবুজাভ কচি পাতা। ডালে ডালে ফুটেছে সাদা শালফুল।

এক সময় এই শালবনের বিস্তৃতি ছিল গোটা এলাকায়। তখন নানা ভাষাভাষী আদিবাসীরা বসতি গড়ে তুলে শালবনকে কেন্দ্র করেই। শিকার থেকে শুরু করে নানা কারণে শালবন আদিবাসীদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। সময়ের হাওয়ায় এখন বদলে গেছে অনেক কিছু। ঠমনিয়া শালবনটিও ছোট হয়ে এসেছে। তবুও আদিবাসী মানুষদের সঙ্গে এ শালবনের বন্ধুতা কমেনি এতটুকু।

আমাদের গন্তব্য মহেশপুর গ্রাম। দিনাজপুরের এ গ্রামটি আদিবাসী গ্রাম হিসেবেই বেশি পরিচিত। প্রায় দুইশ সাঁওতাল পারিবারের বাস এখানটায়। একদিকে চরম দারিদ্র্য আর অন্যদিকে ধর্মান্তরিত হওয়ার হাতছানি। তবু এখানকার আদিবাসীরা টিকিয়ে রেখেছে পূর্বপুরুষদের আচার, রীতিনীতি ও বিশ্বাসগুলোকে।

ঠমনিয়া শালবনের পাশেই মহেশপুর গ্রামটি। একটি মেঠোপথ চলে গেছে শালবনের পাশ দিয়ে। সে দিক দিয়ে খানিকটা পথ পেরোতেই পৌঁছে যাই মহেশপুরে।

এ গ্রামেই আজ বাহাপরব উৎসব। চৈত্রের শেষে এখানকার সাঁওতালরা আয়োজন করে এ অনুষ্ঠানটি। তাদের ভাষায় ‘বাহা’ মানে ফুল আর ‘পরব’ মানে অনুষ্ঠান বা উৎসব। অনেকেই এটিকে বসন্ত উৎসবও বলে থাকে। বসন্তে শাল, শিমুল, পলাশ, মহুয়া, চম্পা ফুল ফোটে চারদিকে। বিচিত্র সাজে সজ্জিত হয় প্রকৃতি। কিন্তু বাহাপরবের আগে সাঁওতাল নারীরা সে ফুল উপভোগ করে না। শালফুল তাদের ভাষায়- ‘সারজম বাহার’। এ উৎসবে সাঁওতালরা শালফুলকে বরণ করে নেয় কিছু আনুষ্ঠানিকতায়। এরপরই মেয়েরা খোঁপায় রং-বেরংয়ের ফুল পরতে পারে।

মহেশপুর যখন পৌঁছি তখন মধ্যদুপুর। গ্রামের একেবারে শেষ প্রান্তে নির্জন জায়গায় চলছে বাহাপরবের আনুষ্ঠানিকতা। গোত্রের প্রধান বা জগ মাঝি বাঠু সরেন। উপোস অবস্থায় তিনি পুজো দিচ্ছেন বোঙ্গার (দেবতা) সন্তষ্টি লাভের জন্য। উচ্চকণ্ঠে পড়ছেন মন্ত্র। বাঠুর ভাষায়, ‘জোহার এবে খানদো, মরেকু তুরেকু, আলেয়া আতু নুতুমতে …’।

একটু উঁচু জায়গায় তিনটি ধনুক গেড়ে দেয়া হয়েছে। একটি কুলার মধ্যে রাখা হয়েছে চাউল, সিঁদুর, ধান, দূর্বা ঘাস আর বেশকিছু শালফুল। পাশেই বলি দেয়া হয়েছে কয়েকটি লাল মুরগি। এটিই বাহাপরব পুজোর নিয়ম। বলি দেয়া মুরগি দিয়ে খিচুড়ি রান্নার আয়োজন শুরু করে দুয়েকজন। বাহাপরবকে ঘিরে বিকেলের দিকে এখানেই আশপাশের সাঁওতালদের সম্মিলন ঘটবে। সেই ফাঁকে আমাদের সঙ্গে আলাপ হয় বাঠু সরেনের। তিনি জানান এ উৎসবের নিয়মটি।

বাহাপরব উৎসবটি ৩ দিনের। প্রথমদিনের অনুষ্ঠানই প্রধান। এদিন পুজোর মাধ্যমে প্রথমে মুরগি বলি দেয়া হয়। তারপর সাঁওতাল নারীরা শালফুলকে গ্রহণ করে নানা আনুষ্ঠানিকতায়। তারা খোঁপায় পড়ে শালসহ নানা রঙের ফুল। দলবেঁধে নেচে-গেয়ে বরণ করে নেয় নতুন বসন্তকে। একই সঙ্গে সেদিনই বাড়ি বাড়ি গিয়েও বিলি করা হয় শালফুল।

দ্বিতীয় দিনে সাঁওতালরা একে অপরের গায়ে পানি ছিটানো অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।’ এদের বিশ্বাস পানি ছিটানোর মধ্য দিয়ে পুরনো যত হিংসা, বিদ্বেষ, শত্রুতা আছে তা দূর হয়ে যায়। ফলে পরস্পরের সঙ্গে তৈরি হয় বন্ধুত্বের সেতুবন্ধন। বাহাপরবের তৃতীয় দিনটিতে চলে শুধুই নানা আনন্দ আয়োজন।

কথায় কথায় অনুষ্ঠানস্থলে আসেন গোত্রের প্রধান বা মহত পারগান সরেন। আলাপ হয় তার সঙ্গে। বাহাপরব উৎসব আয়োজনের উদ্দেশ্যের কথা জানতে চাইলে উত্তরে মিলে মুচকি হাসি। তারপর তিনি গম্ভীর কণ্ঠে বলেন, ‘‘জাহেরএরা, গোসায়এরা, মরেকু, তুরইকু নামক দেবতা বা বোঙ্গার সন্তষ্টি লাভই উদ্দেশ্য।’

বিকেল হতেই আশপাশের সাঁওতালরা জড়ো হতে থাকে নানা সাজপোশাকে। গোত্রের মহতও ব্যস্ত হয়ে পড়েন নানা আচারে। বাঠু সরেন বসেন শালফুল সাজিয়ে। সব বয়সী আদিবাসীরা তাকে ভক্তি দেয়। তারপর বিশেষ ভঙ্গিতে তার কাছ থেকে একে একে গ্রহণ করে শালফুল।

শালফুল গ্রহণের পরই শুরু হয় আনন্দ নৃত্য। পুরুষেরা বাজায় মাদল-ঢোল। তালে তালে ঝুমুর নৃত্যে ব্যস্ত হয় আদিবাসী নারীরা। গোত্রের সত্তরঊর্ধ্ব বৃদ্ধা রাতনী সরেন আর অপনমই হাজদাও যোগ দেন সে নৃত্যে। খোঁপায় শালসহ নানা রঙের ফুল ঝুলিয়ে, হাত ধরাধরি করে নাচেন সবাই। কণ্ঠ আকাশে তুলে একদল সাঁওতাল গান ধরে;

‘তোকয় কোকে চিয়ে লেদা বীর দিসাম দ:

তোকয় কোকে টান্ডি লেদা বীর দিসাম দ:

ভাবার্থ: কে কে ওই জঙ্গলে গিয়েছিল, কে কে ওই জঙ্গলটা পরিষ্কার করেছিলো..।

সন্ধ্যা তখন ছুঁই ছুঁই। শুরু হয় বাড়ি বাড়ি গিয়ে শালফুল বিতরণ পর্ব। একদল সাঁওতাল নেচে-গেয়ে যায় প্রতিটি বাড়িতে। বাঠু সরেন বিতরণ করেন শালফুল। বাড়ির লোকেরা তাকে পা ধুয়ে ভেতরে নেয়। তারপর শালফুল গ্রহণ করে তাকে ভক্তি করেন। সাঁওতালদের বিশ্বাস এভাবে ফুলরূপে দেবতা বা বোঙ্গাই তার ঘরে প্রবেশ করে।

রাতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ে মাদলের ছন্দ। বাড়ে সাঁওতালি কণ্ঠগুলোও। নানা বৈষম্য, অপবাদ, দারিদ্র্য আর অবহেলায় কষ্ট পাওয়া মুখগুলো মেতে ওঠে প্রাণহারা আনন্দে। বাহাপরবের আনন্দ-উল্লাস আর বিশ্বাসের জোয়ারে ভেসে যায় সাঁওতালদের চিরচেনা দুঃখগুলো।

আগের পর্ব


মান্দিদের আদি উৎসব ‘ওয়ানগালা’
 


হাজংদের আদি উৎসব ‘প্যাক খেলা’
 

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!