ক্যাটাগরি

ভারতে কোভিড-১৯: ‘পার্টি করার আগে আইসিইউকর্মীদের কথা ভাবুন’

২০২০ সালের পুরোটা সময় তিনি হাসপাতালে কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের বাঁচিয়ে রাখারই লড়াই করেছেন। যে লড়াইয়ে নিজেদের সফলতাও তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন। অন্ধকার টানেলের শেষ মাথায় যেন একটু আলোর রেখাও দেখা যাচ্ছিল।

এ বছর জানুয়ারিতে ভারতে করোনাভাইরাস সংক্রমণ উল্লেখযোগ্য হারে কমেও যায়। দৈনিক শনাক্ত ২০ হাজারের নিচে নেমে আসে। ১৬ জানুয়ারিতে থেকে দেশটিতে গণ টিকাদান কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর এ মহামারীর বিরুদ্ধে জয়ের আভাস পাচ্ছিল দেশটি। ফেব্রুয়ারিতেও এ ধারা অব্যাহত ছিল।

কিন্তু মার্চে পরিস্থিতি পাল্টে যেতে শুরু করে। দ্রুত বাড়তে থাকে সংক্রমণ। বিশেষ করে ধনী রাজ্য মহারাষ্ট্রে।

গত ৪ এপ্রিল ভারতে প্রথমবারের মত দৈনিক শনাক্ত এক লাখ ছাড়িয়ে যায়। বুধবার সেখানে এক লাখ ১৫ হাজারের বেশি নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে।

ডা. পিন্টর ফোন এখন কয়েক মিনিট পরপরই বেজে উঠছে। লোকজন মরিয়া হয়ে কোভিড আক্রান্ত রোগীর জন্য হাসপাতালে একটি শয্যা খুঁজছেন।

এই চিকিৎসক বলেন, ‘‘নতুন রোগী ভর্তি করার মত অবস্থা আমাদের এখানে আর নেই। আগে থেকেই রোগী উপচে পড়ছে। আমাদের এখানে কোভিড-১৯ ইউনিটের সব শয্যা রোগীতে পূর্ণ।

‘‘চেষ্টা করছি শান্ত থাকার। কারণ, এতে তাদের দোষ নেই। যখন পরিবারের কারো জীবন সঙ্কটাপন্ন তখন আপনি তো মরিয়া হয়ে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে চাইবেনই।”

তার হাসপাতালের কর্মীরা মহামারীর ‍দ্বিতীয় এই ঢেউ মোকাবেলায় শারীরিক ভাবে আগের থেকে অনেক বেশি প্রস্তুত। বেশির ভাগই টিকা নিয়েছেন। চিকিৎসা পদ্ধতিও এখন অনেক বেশি গোছানো।

‘‘কিন্তু কেউ এখন আর মানসিকভাবে নিজেকে প্রস্তুত করতে পারছেন না”, বলেন তিনি। ‘‘আমরা আমাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। কিন্তু আমাদের কারো মধ্যেই আর গত বছরের মত একই মানসিক শক্তি অবশিষ্ট নেই।”

ভারতের রাজধানী দিল্লির হাসপাতালগুলোর চিত্রও প্রায় একই। সেখানেও গত কয়েক দিন ধরে প্রতিদিনই সাড়ে তিন হাজারের বেশি নতুন রোগী শনাক্ত হচ্ছে।

দিল্লি উপকণ্ঠে গুরুগ্রামের একটি হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. রেশমা তিওয়ারি বসু বলেন, ‘‘মুম্বাইয়ের যা অবস্থা, দিল্লির অবস্থাও প্রায় তাই।

সেখানে বেশিরভাগ প্রাইভেট হাসপাতালই রোগীতে পূর্ণ। গত রোববার আমার একজন স্বজনকে চারটি প্রাইভেট হাসপাতাল থেকে শয্যা খালি নেই দেখে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

‘‘অথচ দেখুন, কারো কোনো মাথাব্যাথা নেই। মহামারী যে এখনো শেষ হয়নি, এটা যেন সবাই ভুলে গেছে। সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। এখন স্বাস্থ্যকর্মীদের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার বোঝা বইতে হচ্ছে।”

বিবিসি জানায়, দিল্লির হাসপাতালগুলোর বাইরে জীবন একেবারে স্বাভাবিক। সব রেস্তোরাঁ ও নাইট ক্লাবগুলোতে ভিড় লেগে আছে। মার্কেটগুলো খোলা এবং লোকে পূর্ণ। খুব কম মানুষই করোনাভাইরাস প্রতিরোধে জারি করা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছে।

যা নিয়ে দারুণ ক্ষুব্ধ মেদান্তা হাসপাতালের ক্রিটিক্যাল কেয়ার ডিপার্টমেন্টের প্রধান ডা. যতিন মেহতা।

তিনি বলেন, গত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে (মহামারী থেকে পরিত্রাণের) যে সুযোগ ভারত পেয়েছিল তা হেলায় হারিয়েছে।

‘‘আমাদের উচিত ছিল স্বল্প ওই সময়ে আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে আরো জোরদার করা। টেস্ট এবং ট্রাকিং বাড়ানো এবং টিকাদান কার্যক্রম আরো দ্রুতগতিতে করা। কিন্তু আমরা সেটা করিনি এবং প্রাণঘাতী দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়ে গেছে।”

ফেব্রুয়ারিতে পরিবারের সঙ্গে কিছুটা সময় কাটানোর সুযোগ পেয়েছিলেন ডা. মেহতা। কিন্তু এখন তার ফোন ক্রামগত বেজে চলেছে। বিবিসিকে সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময়ও তার ফোন কয়েকবার বেজে উঠে।

তিনি বলেন, ‘‘লোকজনের মনে রাখা উচিত, স্বাস্থ্যকর্মীরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন এবং নিজেদের কর্মক্ষমতার শেষপ্রান্তে পৌঁছে গেছেন।

‘‘আমি জানি না আর কতদিন আমরা এভাবে কাজ করতে পারবো। আমরা আমাদের সাধ্যমত সবকিছু করেছি। কিন্তু দ্বিতীয় ঢেউ আমাদের ধৈর্যের চরম পরীক্ষা নিতে যাচ্ছে।”

স্বাস্থ্যকর্মীদের শুধু শারীরিক নয় বরং মানসিক সক্ষমতার পরীক্ষাও দিতে হচ্ছে। সহকর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে ডা. মেহতা বলেন, ‘‘আমরা যে কাজই করি, শুধু কল্পনা করুন, সেটা আমাদের সপ্তাহের সাত দিনই ২৪ ঘণ্টা করতে হচ্ছে এবং সেটাও আমরা যতটুকু চাপ নিতে অভ্যস্ত তার থেকে একশ গুণ বেশি চাপ নিয়ে। প্রতিটি চিকিৎসক, নার্স এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের এটা করতে হচ্ছে।”

ভারতের যেসব রাজ্যে নতুন করে সংক্রমণ বাড়ছে তার একটি কেরালা। অথচ করোনাভাইরাস মহামারীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এক সময় কেরালাকে সাফল্যের উদাহরণ হিসেবে দেখা হতো। কেরালার একটি হাসপাতালের নার্স বিদ্যা বিজয়ানান বলেন,  আমাদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা পিপিই পরে একসঙ্গে বেশ কয়েকজন গুরুতর রোগীকে সেবা দিতে হচ্ছে।

কেরালায় স্বাস্থ্য অবকাঠামো ভালো হলেও সিস্টেমে গলদের কারণে সেখানে হাসপাতালগুলো রোগীতে পূর্ণ হয়ে গেছে বলে মনে করেন তিনি।

ভারতের যে পাঁচটি রাজ্যে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন চলছে কেরালা তার একটি।

সেখানে বড় বড় নির্বাচনী র‌্যালি হচ্ছে। নেতা বা জনগণ কারো মধ্যেই স্বাস্থ্য সুরক্ষার নিয়মকানুন মানার বালাই নেই।

বিজয়ানান বলেন, ‘‘আমাদের গতবছর একটানা কাজ করতে হয়েছে। জানুয়ারিতে কিছুটা স্বস্তি পেয়েছিলাম। মনে হচ্ছে সেটা শেষ।

‘‘এখন আবার আমাদের যুদ্ধে নামতে হবে, আরো শক্তি নিয়ে। আমরা হাল ছাড়বো না। তবে আমি শুধু মানুষকে একটা কথাই বলতে চাই, পার্টিতে যাওয়ার আগে আইসিউতে যারা কাজ করছেন তাদের কথা একবার ভেবে দেখবেন।”