ক্যাটাগরি

ভ্রমণ কাহিনি: থিম পার্কের শহর অরল্যান্ডোতে

ছবি এঁকে ছবির মুখে কথা বলিয়ে, ছবিতে প্রাণসঞ্চার করিয়ে ছবিকে রীতিমত মানুষ বা নানা ধরনের পশু-প্রাণীতে রূপান্তরিত করে বিভিন্ন আনন্দদায়ক, শিক্ষামূলক বা প্রহসনমূলক অভিব্যক্তি দিয়ে উপস্থাপনের দুরূহ কাজটি করে যিনি মানুষের মনে স্থায়ী আসন করে নিয়েছেন তিনি ওয়াল্ট ডিজনি। যারা ওয়াল্ট ডিজনির নামও জানেন না, তাদের কাছেও কার্টুন কোন অংশেই কম জনপ্রিয় নয়।

ওয়াল্ট ডিজনি যেসময়ে কার্টুন সৃষ্টি করেছিলেন সেসময়ে কম্পিউটার প্রযুক্তিও ছিল না। একজন মানুষ কতটা মেধাসম্পন্ন হলে এমনটা সৃষ্টি করতে পারেন- সেটা ভাবলে সত্যি মনে বিস্ময়ের উদ্রেক হয়। ওয়াল্ট ডিজনি নাকি নিজের শিশুকন্যাকে ‘মেরি গো রাউন্ড’ বা নাগরদোলায় দুলতে দেখে ডিজনিল্যান্ডের পরিকল্পনা করেছিলেন।

ওয়াল্ট ডিজনির সবচেয়ে বড় এবং বিস্ময়কর সৃষ্টি ডিজনিল্যান্ড। ডিজনিল্যান্ডের নাম শুনলেই মনের পর্দায় ভেসে ওঠে কল্পকাহিনির স্বপ্নময় এক রূপকথার জগৎ। তো সেই রূপকথার জগতে যাওয়ার এবং দেখার সুযোগ হলো। অরল্যান্ডো যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের একটি শহর। শহরটি বিখ্যাত বিভিন্ন থিম পার্কের জন্য। ইউনিভার্সাল স্টুডিও, ডিজনিল্যান্ড, সি ওয়ার্ল্ডয়ের বিশ্ববিখ্যাত থিম পার্কগুলো অরল্যান্ডোকে দিয়েছে আলাদা মর্যাদা।  

তো অরল্যন্ডোতে আসা গেল এবং পরদিন থেকে শুরু হলো আমাদের রূপকথার জগতে বিচরণ! অরল্যান্ডোতে আমাদের ভিজিট ছিল চারদিনের। আমাদের পরিকল্পনা ছিল তিনদিনে এখানকার তিনটি থিম পার্ক যেমন ইউনিভার্সাল স্টুডিও, অপকটের ডিজনিল্যান্ড এবং সি ওয়ার্ল্ডের যতগুলো রাইড উপভোগ করা সম্ভব হয় তাই করা। পরিকল্পনা অনু্যায়ী প্রথমদিন ইউনিভার্সাল স্টুডিওর থিম পার্কের রাইডগুলোর দিকে নজর দেওয়া গেল।

রূপকথার জগতই বটে! পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই এমনকি বাংলাদেশেও থিম পার্ক গড়ে তোলা হয়েছে। ইন্টারনেটের তথ্যানুযায়ী বিশ্বের প্রাচীনতম থিম পার্কটি ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনে। ১৫৮৩ খ্রিস্টাব্দে এর সন্ধান পাওয়া গিয়েছিলো। বৈচিত্রের দিক থেকে অরল্যান্ডোর থিম পার্কগুলোই নাকি সারা দুনিয়ার মানুষের কাছে বেশি আকর্ষণীয়। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বছরে প্রায় পঞ্চাশ মিলিয়ন দর্শক এখানে ভিড় জমায়। এটাই বিশ্বের সর্বাধিক পরিদর্শিত থিম পার্ক।

প্রথমদিন আমরা গেলাম ইউনিভার্সাল স্টুডিওর ‘জুরাসিক পার্কে’। বিশাল লম্বা লাইন। প্রায় দু’ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে ইঞ্চিখানেক করে এগিয়ে ঢোকা গেল সে ভয়ংকর কল্পনার জগতে! গা ছমছম করা ভীতিকর জুরাসিক পার্ক। কাচঘেরা একটি গাড়ি চলতে শুরু করতেই শুরু হলো ভয়ঙ্কর গরিলা, বিশাল লোমশ ভালুক, আরো সব অতিকায় প্রাণীর আক্রমনাত্মক ভঙ্গিমায় এগিয়ে এসে থাবা দেওয়া এবং এদের থাবা থেকে নিজেদের বাঁচানোর প্রাণান্তকর চেষ্টা চললো কিছুক্ষণ ধরে।

৬৫ মিলিয়ন বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া ডাইনোসরের আস্ফালন দেখে ভয়ে আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হওয়ার যোগাড়। জুরাসিক পার্কের ভয়জাগানো রাইডের পরবর্তী রাইড ছিল হ্যারি পটার। কল্পকাহিনি নিয়ে আগ্রহী পাঠকমাত্রই প্রচণ্ড আকর্ষণ বোধ করেন জে কে রাউলিং এর বিশ্বব্যাপী তুমুল সাড়া জাগানো বই আর চলচ্চিত্র ‘হ্যারি পটার’ নিয়ে! এতিম বালক হ্যারির জাদুকরি সব কর্মকাণ্ড তাবৎ দুনিয়ার মানুষকে করে তোলে রোমাঞ্চিত।

আবার দীর্ঘ লাইন আর ইঞ্চিখানেক করে এগোনোর পর হ্যারি পটারের রাইডে চড়ার সুযোগ এলো। তবে রাইড চালু হওয়ার পর মনে হলো কেন এতে উঠলাম! আতংক আর ভয় এতটাই বেশি ছিল যে মনে হচ্ছিল আর হয়তো বেঁচে ফিরতে পারব না। জাদুশক্তির অধিকারী হ্যারি শুরু করলো তার ভয়ঙ্কর সব জাদুকরি কর্মকাণ্ড আর আমরা যেন শূন্যে ভর করে সম্মোহিত হয়ে ছুটে চলেছি হ্যারির পেছন পেছন। আতংকে মনে হচ্ছিল কখন এটা থামবে? অথচ পুরো রাইডে সময় ছিল হয়তো খুব বেশি হলে তিন বা চার মিনিটের। হ্যারির পেছনে জীবন হাতে নিয়ে ছোটা শেষ হলে মনে হলো যাক এ যাত্রা বেঁচে গেলাম। প্রথমদিন এই দুটি ভীষণ উত্তেজনাপূর্ণ রাইড শেষ করেই আমাদের ফিরতে হলো।

পরদিন আমাদের গন্তব্য এপকটের ওয়াল্ট ডিজনির থিম পার্কে। এটাই ওয়াল্ট ডিজনির কল্পনার জগত ডিজনিল্যান্ড। ডিজনিল্যান্ডে আমাদের প্রথম রাইড ছিল স্পেসশিপে নক্ষত্রলোকে বিচরণ। যখন রাইডে বসলাম, আমাদের বেল্ট দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলা হলো। আর যখন স্পেসশিপ ছুটতে শুরু করল তখন মনে হলো একটা কাঠের তক্তা জাতীয় কিছুর উপর খোলা আকাশের মাঝখানে উপুড় হয়ে শুয়ে ছুটে চলেছি আর আর আমার সামনে আর আশপাশ দিয়ে অসংখ্য নক্ষত্র তীব্র গতিতে ছুটে চলেছে। লক্ষ কোটি নক্ষত্রের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দিক-বিদিকে ছুটে চলা প্রচণ্ড ভয়ের অনুভূতি হলেও পুরো ব্যাপারটিই ছিল অসম্ভব রকমের রোমাঞ্চকর।

নক্ষত্রলোকের বিচরণ শেষে আমরা চড়লাম বোটে। এতগুলো অসম্ভব রকমের ভীতিকর রাইড শেষে শান্ত নৌকাভ্রমণটি ছিল দারুণ উপভোগ্য। প্রায় বিশ-বাইশ মিনিটের নৌকাভ্রমণে পৃথিবীর বিভিন্ন আবহাওয়ায় বেড়ে ওঠা গাছপালা, পশুপাখি, সরীসৃপ, পানিতে বিচরণকারী প্রাণীকূলের জীবনবৃত্তান্ত দেখতে দেখতে আর সঙ্গে সঙ্গে এদের বর্ণনা শুনতে শুনতে কখন যে সময় ফুরিয়ে গেছে বুঝতেই পারিনি।

শান্ত, নিরিবিলি বোট রাইড শেষ করে আমরা দৌড়ালাম ‘সোরিন অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড’ এর উদ্দেশ্যে। আমাদের লক্ষ্য সময় নষ্ট না করে যে কয়টা বেশি রাইড উপভোগ করা যায়। সোরিন এমন এক আশ্চর্যজনক ভ্রমণ যাতে এমন এক অনুভূতি তৈরি হয়, যেন কোন পর্বতমালাই বেশি উঁচু নয় বা সবুজে ছাওয়া কোন সমতলও বুঝি বা দূরে নয়। এ যেন বাতাসে ভর করে ছয় মহাদেশের উপর দিয়ে ছুটে চলা এবং প্রাকৃতিকভাবে তৈরি অথবা মানুষের সৃষ্টি সব আশ্চর্যজনক দৃশ্যাবলী উপভোগের এক বিরল সুযোগ। আল্পস পর্বতমালার উপর দিয়ে ছুটে যাওয়া, মিশরের পিরামিড, অস্ট্রেলিয়ার সিডনি হার্বার, রাতের আলো ঝলমলে প্যারিসের নিয়নবাতির আলোকচ্ছটায় রত্নখচিত আইফেল টাওয়ারের দ্যুতিময় বিচ্ছুরণ দর্শকদের মনে তৈরি করে এক অনবদ্য ভাল লাগার অনুভূতি।

চীনের মহাপ্রাচীর, কিলিমানজারো পাহাড় চড়ে বেড়ানো বুনোহাতির পাল, অ্যান্টার্কটিকায় দলবেঁধে পেঙ্গুইনের চলাফেরা অথবা শ্বেতভল্লুকের ঘুরে বেড়ানো দেখতে দেখতে মনে হয় যেন কোন স্বপ্নের দেশে পৌঁছে গেছি। আগ্রার তাজমহলের উপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় আতরের সুবাস এসে নাকে ঝাপটা দেয়, যা রীতিমত বিস্ময়ের উদ্রেক করে।

‘সোরিন অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড’ শেষে আমরা গেলাম ‘টেস্ট ট্র্যাক’ এর রাইডের জন্য। এখানেও মোটামুটি লম্বা লাইন এবং লাইনে দাঁড়িয়ে ট্রেলারে টেস্ট ট্র্যাকের যে গতিবেগ দেখছিলাম তাতে ভয়ে বুকের ভেতরটি ফাঁকা হয়ে যাচ্ছিল। তবে বিস্ময়ের ব্যাপার হলো যখন ভয়ংকর ‘টেস্ট ট্র্যাক’ ছুটতে শুরু করল তখন ভয়ের ‌অনুভূতিটা আর তেমন কাজ করছিল না। হয়তো অনেকগুলো ভয়ঙ্কর রাইডে চড়ার পর ভয়ের অনুভূতিটা খানিকটা ভোঁতা হয়ে গিয়েছিল।

‘টেস্ট ট্র্যাকের’ পরবর্তী গন্তব্য হলো ডিজনির রেলভ্রমণ। যথারীতি লম্বা লাইন। ট্রেনজার্নি শুরু হলো। দারুণ উপভোগ্য সে জার্নি। ট্রেনে ওঠার পরই যথারীতি বেল্ট দিয়ে শক্তভাবে বেঁধে ফেলা হলো সবাইকে। ভাবলাম এমন শান্ত ট্রেনজার্নিতে বেঁধে ফেলার প্রয়োজন কি? বুঝলাম কিছুক্ষণ পরই। পাহাড়, পর্বত, বনজঙ্গল ডিঙিয়ে কিছুক্ষণ চলার পরই ট্রেন ঢুকলো এক সুড়ঙ্গে! সুড়ঙ্গের মধ্যে পানির ভেতর দিয়ে চলছে ট্রেন বেশ ধীরগতিতে। চমৎকার আলো ঝলমলে আঁকাবাঁকা রাস্তায় চলছে ট্রেন। রাস্তার দুই পাশে হাজারো রকমের গাছপালা, কৃত্রিম পশুপাখি, পুতুলনাচ আর সেইসঙ্গে চমৎকার বাদ্যের তালে তালে সব কৃত্রিম প্রাণীর অঙ্গ-ভঙ্গিতে দর্শকদের মন হরণের চেষ্টা।

এসব দেখতে দেখতে কখন যে এক ভয়ঙ্কর খাদের কিনারায় পৌঁছে গেছি, বুঝতেই পারিনি। কিছু বুঝে ওঠার আগে মুহূর্তেই শুরু হলো সেই ভয়ঙ্কর খাদ ধরে সবেগে পতন। শান্ত সুবোধ ট্রেন যেন রীতিমত পাগলা হয়ে গেল। তীব্র পানির স্রোত যেন প্রবল জলপ্রপাতের রূপ ধারণ করে খাড়া পাহাড় থেকে আছড়ে ফেলল গভীর খাদে। আশপাশের পানির ঝাপটায় কাপড় চোপড় ভিজে একাকার। মনে হলো বেঁচে গেছি সেটাই অনেক।

ভীতিকর ট্রেনজার্নির পরের রাইডটি ছিল মিশন স্পেস এবং আমার মনে হয়েছে ইউনিভার্সাল স্টুডিও, ডিজনিল্যান্ড এবং সি ওয়ার্ল্ডের সবগুলো রাইডের মধ্যে অবশ্যই যেগুলোতে আমাদের চড়ার সুযোগ হয়েছে মিশন স্পেসই ছিল সবচেয়ে আকর্ষণীয়, বৈচিত্রময় এবং রোমাঞ্চে ভরপুর। মিশন স্পেস রাইডের জন্যও ছিল দীর্ঘ অপেক্ষা। প্রায় ঘণ্টা দেড়েক লাইনে অপেক্ষার পর ঘোষণা করা হলো কোন কারণে ওইসময় আর রাইডটি চালু করা সম্ভব হবে না। ঘোষণার পর অনেকেই ফিরে যেতে শুরু করেছিল। প্রথমে হতাশ হলেও আমরা দাঁড়িয়েই থাকলাম ধৈর্য ধরে। ততক্ষণে দীর্ঘ লাইন অনেকটাই ছোট হয়ে গেছে। আমাদের ধৈর্যের সুফলও মিলল। একটুপরই আবার ঘোষণা এলো ‘মিশন স্পেস রাইড’ চলবে। আমাদের মন খারাপের পর দ্বিগুণ আনন্দ আরকি!

মিশন স্পেসে দুই ধরনের রাইড। একটি ‘অরেঞ্জ মিশন’, আরেকটি ‘গ্রিন মিশন’। সম্ভবত ‘অরেঞ্জ মিশনটি’ বেশি ভীতিকর। একারণে রাইডটিতে ওঠার আগে বারবার ঘোষণা করা হচ্ছিল, যেসব দর্শকদের হার্টের সমস্যা, উচ্চ রক্তচাপ বা অন্যকোন শারীরিক জটিলতা আছে তারা যেন ‘অরেঞ্জ মিশনে’ ওঠার ঝুঁকি পরিহার করে ‘গ্রিন মিশনে’ ওঠেন। এমনকি ‘অরেঞ্জ মিশনে’ আরোহনের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করার পরও রাইডটি চালু করার আগ মুহূর্তেও বারবার ঘোষণাটি চলছিল। আমরা ঘোষণাটিতে পাত্তা না দিয়ে ‘যা থাকে কপালে’ এমন ভাব নিয়ে ‘অরেঞ্জ মিশনই’ বেছে নিলাম।

রাইডে উঠে বসার পর এবারে আর সাধারণ সিট বেল্ট নয়, নভোচারীদের বেল্টের মতই রীতিমত ক্যাপসুলের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়ার মতো অবস্থা। সামনে বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি দেখেতো ভিরমি খাওয়ার যোগাড়। এমন একটা ধারণা দেওয়ার চেষ্টা যেন নভোচারীদের ট্রেনিং এর ব্যবস্থা চলছে। নামটাও খুব জমকালো ধাঁচের, ‘মিশন টু মার্স’, রীতিমত মঙ্গলগ্রহে অভিযান। পরে বুঝলাম আসলে দর্শক নভোচারীদের কিছুই করতে হয় না। সবকিছু অপারেটররাই নিয়ন্ত্রণ করে। রাইড চালু হওয়ার পরই নভোযান বা রকেট ছুটে চলল এবং কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে বরফাচ্ছাদিত হিমালয়ের চূড়া পার হয়ে, কায়রো, টোকিও এমনকি নর্দান লাইট বা মেরুজ্যোতি প্রদক্ষিণসহ পৃথিবীর সাত মহাদেশ পাড়ি দিয়ে পৃথিবীর কক্ষপথের সীমানা ডিঙিয়ে রকেট ছুটে চলল মঙ্গলগ্রহের দিকে।

মঙ্গলগ্রহে অবতরণের পর মঙ্গলের মাটিতে কিছুক্ষণের যাত্রাবিরতি। আমরা রকেটের কাচের ভেতর দিয়ে দেখলাম, পৃথিবীর নিকটতম গ্রহ মঙ্গলের এবড়ো-থেবড়ো পাথুরে মাটি। দেখে মনে হয় শক্ত পাথুরে মাটি শাবল বা ওই জাতীয় যন্ত্রপাতি দিয়ে ভাঙ্গার চেষ্টা করা হয়েছে এবং ব্যর্থ হয়ে ওভাবেই ফেলে রাখা

হয়েছে। কোথাও কোথাও পানিও চোখে পড়লো। পাঁচ মিনিট আটত্রিশ সেকেন্ডের মঙ্গল অভিযানের রোমাঞ্চকর অনুভূতি মনে নিয়ে আমরা চললাম সেদিনের মতো ‘ম্যাজিক কার্পেট অব আলাদিন’ এর মতো শান্ত একটি রাইডের দিকে এবং শান্ত রাইডটি দিয়ে সেদিনের মতো আমাদের ‘রূপকথার রাজ্যে ভ্রমণ’ শেষ করলাম।

তৃতীয়দিন অর্থাৎ শেষদিনটি ছিল ‘সি ওয়ার্ল্ড’ দর্শন। সি ওয়ার্ল্ডের প্রথম রাইডটি ছিল বেশ চমকপ্রদ। ‘জার্নি টু অ্যাটলান্টিস’ নামে এই রাইডটি দ্রুততম এবং দীর্ঘতম পতনের জন্য বিখ্যাত। যে যানটিতে আমাদেরকে উঠানো হলো সেটি যেমন ডাঙ্গায় চলতে পারে তেমনি পানিতেও। খানিকক্ষণ পানির মধ্যে শান্তভাবে চলার পর রাইডটি খাড়া উঠতে শুরু করলো। এমনভাবে উঠতে লাগলো রীতিমত আতংক হচ্ছিল এই বুঝি খাড়া পাহাড় থেকে পপাত ধরণীতল হতে যাচ্ছি। প্রায় সত্তর আশি ফুট ওঠার পর আবার শুরু চড়াই ধরে নামা। নামাটা মনে হচ্ছিল আরও বিপদজনক। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত কোন অঘটন ছাড়াই আমরা নিরাপদে ভূমি স্পর্শ করলাম। সি ওয়ার্ল্ডের আরও কয়েকটি রাইডের মধ্যে ছিল হন্টেড হাউস ও রোলার কোস্টার।

তবে সি ওয়ার্ল্ডের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ইভেন্টটি ছিল ‘কিলার হোয়েল’ গেম শো। বড় বড় কয়েকটি সুইমিংপুলে সাতটি ‘কিলার হোয়েল’ (ডলফিনের একটি জাত) যখন তাদের প্রশিক্ষকদের নির্দেশনা মেনে বিভিন্ন ধরনের কৌশল প্রদর্শন করছিল, অসংখ্য দর্শকের মুহুর্মুহু করতালিতে ভরে উঠছিল গ্যালারি। মাঝে মাঝেই ডলফিনগুলো তাদের মুখ থেকে পানি ছুড়ে দর্শকদের ভিজিয়ে দিচ্ছিল। এক কথায় দারুণ উপভোগ্য হয়েছিল ‘কিলার হোয়েল শো’, সি ওয়ার্ল্ডের আরও একটি আকর্ষণীয় রাইড ছিল অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশ ভ্রমণ। শ্বেতভল্লুক আর ঝাঁকে ঝাঁকে পেঙ্গুইনের চলাফেরা মোহমুগ্ধ করে রাখে দর্শকদের।

‘কিলার হোয়েল শো’ এবং আরও দু’একটি রাইডের মাধ্যমে শেষ হয়েছিল আমাদের অরল্যান্ডো ভ্রমণ। এক কথায় আমাদের অরল্যান্ডো ভ্রমণটি হয়েছিল বর্ণনাতীত উপভোগ্য। তিনদিন ধরে ওয়াল্ট ডিজনির রূপকথার স্বপ্নরাজ্যে ঘুরেফিরে এক সীমাহীন স্বপ্নিল ভাল লাগায় মন ভরিয়ে ফিরে গেলাম বাস্তব জগতে।

লেখক পরিচিতি: প্রাক্তন উপ পরিচালক, বিএনডব্লিউএলএ, জেনেভা, সুইজারল্যান্ড