কোভিড-১৯ সংক্রমণের বিস্তার রোধে গত বছর ভারতে লকডাউন জারির পর হাজার হাজার শ্রমিককে পায়ে হেঁটে শত শত মাইল পাড়ি দিয়ে নিজ নিজ এলাকায় ফিরতে দেখা গেছে। লকডাউনে সব বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সেখানে শ্রমিকরা মানবেতর পরিস্থিতিতে পড়েছিলেন। পায়ে হেঁটে ফিরতে গিয়ে ক্লান্তিতে পথে বেশ কয়েকজনের মৃত্যুও হয়।
ভারতে গত মাস থেকে আবারও করোনাভাইরাসের সংক্রমণ দ্রুতগতিতে বাড়তে শুরু করেছে; বিশেষ করে মহারাষ্ট্রে। সংক্রমণের বিস্তার রোধে মহারাষ্ট্রের মুম্বাইয়ে এরইমধ্যে বার, শপিংমল এবং রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
মুম্বাই উপকণ্ঠে একটি রেস্তোরাঁয় রাঁধুনীর কাজ করতেন সুরেন্দ্রর পুরি। সম্প্রতি তিনি চাকরি হারিয়ে বাড়ির পথ ধরেছেন। হতাশ কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘‘বাড়ি ফিরে যাওয়া ছাড়া আমার সামনে অন্য কোনো পথ খোলা নেই। একমাত্র রান্নার কাজ ছাড়া আমি আর কোনো কাজ জানি না। এই কাজের ভরসায় আমি মুম্বাই এসেছিলাম।”
পরিযায়ী এই শ্রমিকদের সঙ্গে বড় নগরী থেকে ভারতের ছোট ছোট শহর ও গ্রামগুলোতে করোনাভাইরাস সংক্রমণ আরো দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
ভারতে সংক্রমণের প্রথম ঢেউয়ের তুলনায় দ্বিতীয় ঢেউ যে অনেক বেশি দ্রুত গতির সেটা এরইমধ্যে প্রমাণ হয়ে গেছে। গত বছর সেপ্টেম্বরে প্রথম ঢেউ চূড়ায় উঠেছিল। সে সময় দৈনিক গড়ে লাখ ছুঁই ছুঁই রোগী শনাক্ত হত।
কিন্তু এবার এরই মধ্যে দৈনিক শনাক্ত লাখ ছাড়িয়ে গেছে এবং প্রায় প্রতিদিনই আগের দিনের তুলনায় বেশি রোগী শনাক্ত হচ্ছে। শুক্রবার ভারতে এক লাখ ৩১ হাজার ৯৬৮ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়। মারা গেছেন ৭৮০ জন। মৃত্যুর এ সংখ্যা গত পাঁচ মাসের বেশি সময়ের মধ্যে সর্বোচ্চ। শনাক্ত এবং মৃত্যু উভয় ক্ষেত্রেই মহারাষ্ট্র অন্য রাজ্যের তুলনায় অনেক এগিয়ে।
ভারতে এখন পর্যন্ত মোট শনাক্ত এক কোটি ৩৬ লাখের বেশি। যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রাজিলের পর যা সর্বোচ্চ। মোট মৃত্যু এক লাখ ৬৭ হাজার ৬৪২ জন।
অথচ বছরের শুরুতে অর্থাৎ, জানুয়ারি মাসে ভারতে দৈনিক শনাক্ত ২০ হাজারের নিচে নেমে এসেছিল। গত ১৬ জানুয়ারি থেকে দেশটিতে গণ টিকাদান কার্যক্রমও শুরু হয়ে যায়। ফলে এই মহামারীর শেষ দেখার অপেক্ষায় ছিল দেশটির নাগরিকরা।
কিন্তু সংক্রমণ কমতে শুরু করলে লোকজন আবার স্বাভাবিকভাবে চলাফেলা শুরু করে। জোরেশোরে নানা উৎসব আয়োজন শুরু হয়। লোকজনের মধ্যে সংক্রমণ প্রতিরোধে স্বাস্থ্যবিধি মানার বালাই নেই। এমনকি তারা মাস্ক পরতে এবং দূরত্ব বজায় রাখতেও অনীহা দেখায়। পাঁচটি রাজ্যে শুরু হয় স্থানীয় সরকার নির্বাচনের প্রচার ও ভোট।
যার ফল হাতে হাতে পেতে শুরু করেছে ভারত। মার্চের শুরুতেই সংক্রমণ বাড়তে শুরু করে, যা এখন লাগামহীন গতি পেয়েছে।
এদিকে, ভারতের হাতে পূর্ণগতিতে টিকাদান কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত টিকার মজুদ নেই বলে খবর প্রকাশ পেয়েছে।
ভারতের স্বাস্থ্যমন্ত্রী হার্শ বর্ধন অবশ্য টিকার স্বল্পতার বিষয়টি অস্বীকার করে বৃহস্পতিবার বলেছেন, এখনো তাদের হাতে চার কোটি ৩০ লাখের বেশি ডোজ টিকা মজুদ আছে বা পাইপলাইনে আছে।
ভারতে প্রতিদিন ৪০ লাখ মানুষকে টিকা দেওয়া হচ্ছে। তবে এখনো দেশটিতে সম্মুখসারির যোদ্ধা এবং ৪৫ বছরের উপরে যাদের বয়স কেবল তারাই টিকা পাচ্ছেন।
তবে রাজ্য সরকারগুলো স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সঙ্গে একমত প্রকাশ করেনি। বিশেষ করে যেসব রাজ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর দল ক্ষমতায় নেই সেইসব রাজ্যের সরকার থেকে বলা হচ্ছে, টিকাদান কার্যক্রম পূর্ণগতিতে চালিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় টিকা কেন্দ্র থেকে তাদের দেওয়া হচ্ছে না। ফলে তাদের টিকার রেশনিং করতে হচ্ছে।
ভারতের প্রধান বিরোধীদল কংগ্রেস পার্টির জ্যেষ্ঠ নেতা রাহুল গান্ধী টিকার সংকটের জন্য মোদী সরকারকে দায়ী করে বলেছেন, সরকার নিজের দেশে টিকাদান কার্যক্রমের দিকে মনযোগ না দিয়ে কোটি কোটি ডোজ টিকা রপ্তানি করেছেন।