স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সরকারি-বেসরকারি ‘কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালের’ শয্যা সংখ্যার যে পরিসংখ্যান প্রতিদিন সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে গণমাধ্যমে পাঠানো হয়, তা সাধারণত ‘দুয়েকদিন আগের তথ্য’।
এসব তথ্য সংগ্রহ করা হয় ফোনে, যেখানে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি ব্যবহার করে হাসপাতালগুলোর শয্যা পরিস্থিতির প্রতি মুহূর্তের হালনাগাদ জানা ও তা জনগণের সামনে প্রদর্শন করা সম্ভব।
প্রতিদিন দুপুর ১২টা পর্যন্ত হাসপাতালগুলোর মোট শয্যা, ভর্তি রোগীর সংখ্যা এবং কতটি শয্যা খালি আছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সমন্বিত নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র সে হিসাব দেওয়া হয়।
শুক্রবার পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ঢাকার সরকারি-বেসরকারি ১৯টি হাসপাতালের ৩৬২২টি সাধারণ শয্যার মধ্যে ৪৩০টি খালি থাকার এবং ৩০৫টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে ১৭টি খালি থাকার তথ্য তুলে ধরা হয়।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী শয্যা খালি আছে, এমন কয়েকটি হাসপাতালে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করে কোনোটিতেই শয্যা খালি থাকার তথ্য পাওয়া যায় নাই।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কোভিড আইসোলেশন ওয়ার্ডের বুধবার দুপুরের চিত্র। করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দিনে দিনে বাড়তে থাকায় হাসপাতালটির কোভিড ওয়ার্ডে কোনো শয্যাই খালি ছিল না এদিন। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) করোনাভাইরাস ইউনিটের সাধারণ শয্যা দেখানো হয়েছে ১৮০টি, যার ৪টি খালি।
এই তথ্যকে ‘বিভ্রান্তিকর’ হিসেবে বর্ণনা করে বিএসএমএমইউর পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জুলফিকার আহমেদ আমীন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “তারা আমাদের আইসিইউ বেড দেখাচ্ছিল ১৪টি। কিন্তু আমাদের এখানে বেড সংখ্যা ২০টি। আর আমাদের ফিভার ক্লিনিকে আরও ৫০টি সাধারণ শয্যা যোগ হয়েছে।”
৪টি সাধারণ শয্যা খালি থাকার তথ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দিলেও জুলফিকার আলী আমিন বলেন, “এখানে কোভিড ইউনিটে কেনো শয্যাই খালি নেই।”
শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের কোভিড ইউনিটে ১৯০টি সাধারণ শয্যার মধ্যে ৫টি এবং ১০টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে ৪টি খালি ছিল বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছিল।
এই ‘তথ্য সঠিক নয়’ জানিয়ে হাসপাতালটির পরিচালক ডা. খলিলুর রহমান বলেন, “বর্তমানে কোনো আইসিইউ বেড খালি নাই। এটা আগের নিউজ। আমাদের এখানে পরশুদিন কয়েকটা সিট খালি ছিল।
“কাল থেকে কোনো সিট খালি নাই। আর জেনারেল বেডের একটাও খালি নাই। অতিরিক্ত রোগী আছে।”
বৃহস্পতিবার ৭৪ জন কোভিড-১৯ রোগীর মৃত্যুর খবর দিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, যা গতবছর ৮ মার্চ দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর পর একদিনে মৃত্যুর সংখ্যায় সর্বাধিক।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কোভিড আইসোলেশন ওয়ার্ড রোগীতে পরিপূর্ণ, তাই সামনে নোটিস ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি
প্রথম প্রথম রোগী শনাক্তের ১০ দিন পর গত বছরের ১৮ মার্চ প্রথম মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছিল সরকার। এ বছর ৩১ মার্চ তা ৯ হাজার ছাড়িয়ে যায়।
সংক্রমণ ধরা পড়ার এক বছর পর এ বছর মার্চের শেষে প্রথমবারের মতো দেশে এক দিনে পাঁচ হাজারের বেশি রোগী শনাক্তের খবর আসে।
দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে বুধবার দেশে রেকর্ড ৭ হাজার ৬২৬ জন নতুন রোগী শনাক্তের খবর দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এর মধ্য দিয়ে দেশে মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যা সাড়ে ছয় লাখ ছাড়িয়ে যায়।
এমন পরিস্থিতে হাসপাতালে শয্যা সংকট যেমন রয়েছে, তেমনি কোথায় কোথায় শয্যা খালি রয়েছে সেই বিষয়ে সঠিক তথ্যের সংকট থাকায় করোনাভাইরাসের জটিল রোগীরা হাসপাতালে ঘুরতে ঘুরতে অবস্থার অবনতি হয়ে সময়মতো চিকিৎসার অভাবে মারা যাচ্ছেন বলে একাধিক হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
কোভিড-১৯: ‘হাসপাতালে ঘুরে ঘুরেই’ বাড়ছে মৃত্যু
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীর বেসরকারি এভার কেয়ার হাসপাতালে ৫৮টি সাধারণ শয্যার মধ্যে খালি আছে ৯টি। একইভাবে ২১টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে ১০টি খালি আছে বলে জানানো হয়।
তবে নতুন করে করোনাভাইরাস সংক্রমণ বাড়তে শুরু করলে ১৯ মার্চের পর এই হাসপাতালের কোনো শয্যাই ফাঁকা থাকছে না বলে জানিয়ে আসছে এভারকেয়ার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
বৃহস্পতিবার থেকে শুক্রবার বেলা ১২টা পর্যন্ত এভারকেয়ার হাসপাতালের কতটি বেড খালি ছিল জানতে চাইলে জ্যেষ্ঠ মহাব্যবস্থাপক ডা. আরিফ মাহমুদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কোনো আইসিইউ বা সাধারণ বেড খালি নাই। তারা কীভাবে এই তথ্য দিচ্ছে বুঝতে পারছি না।”
“আমার এখানে ১২টি আইসিইউ ৯টি এইচডিইউ। একটাও খালি নাই। এভারকেয়ার হাসপাতালের কোভিড রোগীদের জন্য সাধারণ শয্যা ৫৮টি নয়, ৮০টি। এর সবগুলোতেই রোগী ভর্তি আছে।
“আমার বন্ধুর মা, এছাড়াও প্রতিদিন প্রচুর রোগী ফেরত দিয়েছি আজকে।”

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কোভিড আইসোলেশন ওয়ার্ডের বুধবার দুপুরের চিত্র। করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দিনে দিনে বাড়তে থাকায় হাসপাতালটির কোভিড ওয়ার্ডে কোনো শয্যাই খালি ছিল না এদিন। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি
স্কয়ার হাসপাতালের শয্যার যে তথ্য দেওয়া হয়েছে তাও ভুল। এদিন স্কয়ার হাসপাতালের ৬৫টি সাধারণ শয্যার এবং ১৯টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে ১১টি সাধারণ ও ৪টি আইসিইউ শয্যা খালি রয়েছে বলে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়।
তবে এই তথ্য সঠিক নয় জানিয়ে স্কয়ার হাসপাতালর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইউসুফ সিদ্দিক শুক্রবার রাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কোভিডের জন্য ডেডিকেটেড আইসিউ বেড ১৭টি। সাধারণ শয্যা রয়েছে ৭৫টি। এক সময় ১০০টি শয্যা থাকলেও করোনাভাইরাস সংক্রমণ কমে যাওয়ায় মাঝখানে শয্যাসংখ্যা কমিয়ে ফেলা হয়েছিল। সংক্রমণ বাড়তে শুরু করলে করোনা ইউনিটে শয্যা আবার বাড়ানো হয়েছে।
“আর এই ইউনিটের সাধারণ বা আইসিইউ কোনো বেডই ফাঁকা নেই। খালি শয্যার হিসাবটা কিভাবে দেয় বুঝলাম না। আমার এখানে এখন কোনো বেড খালি নাই। এখন ৫-৬ রিকোয়েস্ট পেন্ডিং। একটা বেড খালি হবে আর সেখানে আরেকজন ভর্তি হয়ে যাবে। খালি তো থাকে না।”
হাসপাতাল শয্যা নিয়ে তথ্যের এমন গরমিলের বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে তথ্য সংগ্রহ করার সময় হাসপাতালগুলো যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে সরবরাহ করে তার ভিত্তিতে তালিকা করা হয়। পরবর্তীতে যে কোনো সময় রোগী ভর্তি হয়ে যেতে পারে।
“এসব তথ্য আমাদের কন্ট্রোল রুম থেকে ওরা কালেক্ট করে। যখন রিপোর্ট করে তখন তারা ফোন করে জেনে নেয় কোথায় কয়টা বেড আছে। এখন আইসিইউ বেড খালি পড়ে থাকবে এটা খুবই ‘আনলাইকলি’। যখন খালি থাকে তখন হয়তো ওরা লিখে দেয়। পরবর্তীতে হয়তো ফিলাপ হয়ে যায়।”