ক্যাটাগরি

গিলক্রিস্টের ‘সেরা সেঞ্চুরি’ ও বাংলাদেশের আক্ষেপের ১৫ বছর

ফতুল্লায় গিলক্রিস্টের সেই ইনিংসটিই আবার বাংলাদেশ ক্রিকেটের এমন যন্ত্রণা
ও আক্ষেপের অধ্যায়, ওই সময়কার অধিনায়ক হাবিবুল বাশার মনেই করতে চান না ওই ইনিংসটি।

২০০৬ সালে ফতুল্লায় ১৪৪ রানের ইনিংসটি খেলেছিলেন গিলক্রিস্ট। তার ১৭ টেস্ট
সেঞ্চুরির মধ্যে সেটি ছিল ষোড়শ। স্মরণীয় সেই ইনিংসের ১৫ বছর পূর্ণ হলো রোববার।

রেকর্ড গড়া সেঞ্চুরি, ডাবল সেঞ্চুরি, ম্যাচের রঙ পাল্টে দেওয়া বিধ্বংসী সব
ইনিংস গিলক্রিস্ট অনেক খেলেছেন। ফতুল্লার ওই সেঞ্চুরি তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে ধীরগতির
সেঞ্চুরি। অথচ সেটিই তার মনে দাগ কেটে আছে বেশি।

২০১৭ সালে ‘ট্রিপল এম’ রেডিওকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে গিলক্রিস্ট বলেছিলেন ইনিংসটি নিয়ে।

সেঞ্চুরির পর গিলক্রিস্টের উদযাপন, তার কাছে এটি ক্যারিয়ারের সেরা সেঞ্চুরি। ছবি : ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া।

সেঞ্চুরির পর গিলক্রিস্টের উদযাপন, তার কাছে এটি ক্যারিয়ারের সেরা সেঞ্চুরি। ছবি : ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া।

“আমার সেরা সেঞ্চুরি
বাংলাদেশের বিপক্ষে। ফাজলামো করছি না, সত্যি। সেবারের গ্রীষ্ম ছিল আমাদের জন্য বেশ
কঠিন ও লম্বা। দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়েছিলাম আমরা, যেখানে তুমুল লড়াই হয়েছিল। এরপর বাংলাদেশে
দুই টেস্টের ছোট্ট সফরে আমরা এই ভেবে গিয়েছিলাম যে, ‘এখানে জিতেই যাব, ওই দুর্বলদের
উড়িয়ে দেব, কিছু করতে পারবে না ওরা।’ কিন্তু ওরা আমাদের বিপাকে ফেলে দেয়। আমি যখন ক্রিজে যাই… খুব বিপদের সময় তখন।”

বোলিংয়ের আগে অস্ট্রেলিয়াকে বাংলাদেশ চমকে দেয় সেবার ব্যাটিংয়ে। ব্রেট লি,
জেসন গিলেস্পি, স্টুয়ার্ট ক্লার্ক, শেন ওয়ার্ন ও স্টুয়ার্ট ম্যাকগিলকে নিয়ে গড়া বোলিং
আক্রমণ গুঁড়িয়ে বাংলাদেশ করে ৪২৭ রান। ১৩৮ রানের অবিস্মরণীয় ইনিংস খেলেন শাহরিয়ার নাফীস,
অধিনায়ক হাবিবুল করেন ৭৬, রাজিন সালেহ ৬৭।

উজ্জীবিত বাংলাদেশ এরপর বোলিংয়ে আরও চেপে ধরে অস্ট্রেলিয়াকে। ম্যাথু হেইডেন, মাইকেল
হাসি, রিকি পন্টিং ও ডেমিয়েন মার্টিন বিদায় নেন দ্রুত। গিলক্রিস্ট যখন উইকেটে যান,
অস্ট্রেলিয়ার রান তখন ৪ উইকেটে ৬১।

একটু পর মাইকেল ক্লার্ক ও শেন ওয়ার্নের বিদায়ে স্কোর হয়ে যায় ৬ উইকেটে ৯৩।
টেস্টের শীর্ষ দলকে ফলো-অন করানোর সম্ভাবনা, বড় লিডের আশায় তখন টগবগ করে ফুটছে বাংলাদেশ।
কিন্তু গিলক্রিস্টের ব্যাটে প্রবল চোট লাগে বাংলাদেশের আশায়।

সপ্তম উইকেটে ব্রেট লিকে নিয়ে ৬৩ রানের জুটি গড়েন গিলক্রিস্ট, যেখানে লির অবদান
মোটে ১৫। অষ্টম উইকেটে গিলেস্পির সঙ্গে জুটি ৭৩ রানের। এমনকি শেষ দুই জুটিতেও আসে গুরুত্বপূর্ণ
৪০ রান, যেখানে স্টুয়ার্ট ক্লার্ক ও ম্যাকগিলের কোনো রানই ছিল না। গিলক্রিস্ট একাই
দারুণ ব্যাটিংয়ে কমান ব্যবধান।

ইনিংসটি শুরু হয়েছিল ১০ এপ্রিল। সেদিন অপরাজিত ছিলেন ৫১ রানে। পরদিন ইনিংস
পায় পূর্ণতা। সেঞ্চুরি স্পর্শ করেন ১৬০ বলে। তার আগের মন্থরতম সেঞ্চুরি ছিল ১৪৩ বলে,
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। সেঞ্চুরির পর তোলেন ঝড়।

মোহাম্মদ রফিকের পঞ্চম শিকারে পরিণত হয়ে অবশেষে যখন ফিরলেন গিলক্রিস্ট, তার
নামের পাশে তখন জ্বলজ্বল করছে ২১২ বলে ১৪৪ রান। ১৫ চারের সঙ্গে ইনিংসে ছক্কা ছয়টি।
সেঞ্চুরির পর মারেন চারটি ছক্কা।

এই সংখ্যাগুলোর মাহাত্ম আরও বেড়ে যায় ইনিংসটি নিয়ে গিলক্রিস্টের বর্ণনা শোনার
পর।

হাবিবুল বাশার এখন আর মনে করতেও চান না সেই আক্ষেপময় টেস্ট।

হাবিবুল বাশার এখন আর মনে করতেও চান না সেই আক্ষেপময় টেস্ট।

“লোয়ার অর্ডারে কয়েকজন
আমাকে সঙ্গ দেয়, আমি সেঞ্চুরি করতে পারি। সেটি ছিল আমার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে ধীরগতির,
সবচেয়ে কঠিন লড়াইয়ের সেঞ্চুরি।”

বাংলাদেশের হয়ে রফিকের পাঁচ উইকেটের সঙ্গে এনামুল হক জুনিয়র ও মাশরাফি বিন
মুর্তজা নেন দুটি করে উইকেট।

গিলক্রিস্টের ব্যাটিং প্রদর্শনীর আগে দারুণ বোলিং করেছিলেন দুই স্পিনার রফিক
ও এনামুল। কিন্তু গিলক্রিস্ট মাঠের চারপাশে শট খেলে এলোমেলো করে দেন বাংলাদেশের বোলিং-ফিল্ডিং।
ওই ম্যাচের অধিনায়ক হাবিবুল বাশার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বললেন, ১৫ বছর পরও ওই
সময়ের অনুভূতি তার মনে পড়ে পুরোপুরি।

“ওটা তো মনে করতে চাই
না (হাসি)… সত্যি বলতে, অসহায় লাগছিল। গিলক্রিস্ট এমন একজন ব্যাটসম্যান, যে প্রতিপক্ষের
সব পরিকল্পনা ধ্বংস করে দেয়। ৬ উইকেট পড়ে গেছে, রফিক ও এনাম খুব ভালো বল করছে, তখন
অধিনায়ক হিসেবে আমার আক্রমণ করার কথা। কিন্তু গিলক্রিস্টকে আক্রমণ করতে গেলে সে পাল্টা
আক্রমণ করে। তার জন্য মাঠ সাজানোই মুশকিল হয়ে পড়ে।”

“ওই ইনিংসটি যদি না খেলত, আমাদের লিড অনেক বড় হতো। অন্য কোনো ব্যাটসম্যান এই
ইনিংস খেলতে পারত না। অন্য কেউ হলে হয়তো এই অবস্থায় ধুঁকত, সময় নিত। কিন্তু গিলক্রিস্ট
তো এরকম অবস্থায় এমন ইনিংস অনেক খেলেছে।”
বাংলাদেশের মূল দুই স্পিনারই ছিলেন সেই ম্যাচে বাঁহাতি, তাই বাঁহাতি ব্যাটসম্যান গিলক্রিস্টের
একটু সুবিধা হওয়ার কথা। তবে হাবিবুল সেটাকে বড় ব্যাপার মনে করেন না এখনও।

“গিলক্রিস্ট তো অফ স্পিনও
ভালো খেলত। হ্যাঁ, যদি মুত্তিয়া মুরালিধরন বা ওরকম বিশ্বমানের অফ স্পিনার থাকত, তাহলে
অন্য কিছু হতে পারত। আর গিলক্রিস্ট এরকম খেলতে থাকলে আসলে কোনো ধরনের বোলিংই খুব কাজে
দেয় না।”

৩০০ বা অন্তত ২৫০ রানের লিডের আশায় থাকা বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত লিড পায় ১৫৮
রানের। দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিং ধসে বাংলাদেশ গুটিয়ে যায় ১৪৮ রানে। শেষ ইনিংসে পন্টিংয়ের
অসাধারণ ইনিংসে বাংলাদেশের হৃদয় ভেঙে ৩০৭ রানের জয়ের লক্ষ্য ছুঁয়ে ফেলে অস্ট্রেলিয়া।
১১৮ রানে অপরাজিত থাকেন অস্ট্রেলিয়া অধিনায়ক, দল জেতে ৩ উইকেটে।

শেষ ইনিংসের নায়ক পন্টিং হলেও হাবিবুলের চোখে ম্যাচের ভাগ্য গড়ে দেয় গিলক্রিস্টের
ওই ইনিংসই।

“পন্টিংয়ের ইনিংস শেষ
ইনিংসে জিতিয়েছে, তবে ম্যাচের প্রেক্ষাপটে বড় পার্থক্য গড়ে দিয়েছে গিলক্রিস্টের ইনিংস।
গিলক্রিস্ট ওই ইনিংসটি না খেললে হয়তো পন্টিংয়ের কোনো সুযোগই থাকত না।”

ম্যান
অব দা ম্যাচের স্বীকৃতিও পন্টিং নন, পেয়েছিলেন গিলক্রিস্টই। টেস্টে কিপার-ব্যাটসম্যান
হিসেবে রেকর্ড সাতবারের ম্যাচ সেরা তিনি। সেটিই ছিল শেষবার।