আবার জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংক্রমণ কমাতে সাতদিনের ‘লকডাউন’ তেমন কার্যকর হবে না। জনগণকে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে কঠোর হতে হবে।
আগামী ১৪ এপ্রিল থেকে সাত দিনের ‘কঠোর লকডাউনের’ পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। এসময় জরুরি সেবার প্রতিষ্ঠান ছাড়া সরকারি-বেসরকারি সব অফিস বন্ধ থাকবে বলে জানিয়েছেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন।
এর আগে গত ৫ এপ্রিল থেকে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত সারাদেশে শপিং মল, দোকান-পাট, হোটেল-রেস্তোরাঁ, গণপরিবহনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল সরকার। পরে তা শিথিল করে দোকানপাট ও শপিংমল খোলা রাখা এবং সিটি করপোরেশন এলাকায় সকাল-সন্ধ্যা গণপরিবহন চলাচলের অনুমতি দেওয়া হয়।
করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকায় দেশে চলছে ‘লকডাউন’। ঢাকার বিএসএমএমইউ হাসপাতালে চিকিৎসক দেখিয়ে সাভারের হেমায়েতপুরের বাড়ি ফিরছেন মো. মাহাবুব, গণপরিবহন না চলায় হেঁটে তাকে আমিন বাজার সেতু পার হতে হয়। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি
এর মধ্যে গত বুধবার দৈনিক সংক্রমণ বৃদ্ধির এবং শনিবার মৃত্যুর সংখ্যায় রেকর্ড হয়েছে।
এদিকে চলমান এক সপ্তাহের লকডাউন শেষ হচ্ছে ১১ এপ্রিল রাত ১২টায়। এরপর ১৪ এপ্রিল থেকে সর্বাত্মক লকডাউন শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু মাঝখানের ১২ ও ১৩ এপ্রিল কিভাবে চলবে সে ব্যাপারে এখনও কোনো দিকনির্দেশনা মেলেনি সরকারের তরফ থেকে।
এমন পরিস্থিতিতে কোভিড-১৯ মোকাবেলায় জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ড. নজরুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সাতদিনের লকডাউনে কিছু হবে না। সাতদিন এরকম করলেন, সাতদিন পর যখন লকডাউন তুলে দিবেন, তখন তো সবাই উৎসব করতে বের হবে।”
সংক্রমণ কমাতে স্বাস্থ্যবিধি বাস্তবায়নে আইনশৃংখলাবাহিনী নামানোর পরামর্শ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই উপাচার্য।
“মাস্ক পরাটা কম্পলসারি করতে হবে আর দূরত্ব মানতে হবে। একটা দোকানের সামনে ১০ ফিট জায়গা আছে, সেখানে দুইজন খরিদ্দার যেন থাকে। দুইজনের কাজ শেষ হয়ে গেলে আরও দুইজন আসবে। এভাবে মানতে পারলে ৯৬ ভাগ প্রটেকশন হবে। এটা করার জন্য সেনাবাহিনী নামিয়ে দিক। আর্মি গাড়িতে করে টহল দিচ্ছে, দেখবেন সবাই মাস্ক পরবে।”
রাজধানীর মেরাদিয়া এলাকার বাসিন্দা গুরুচরণ সরকার করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গত তিন দিন ধরে চিকিৎসাধীন ছিলেন বনশ্রীর একটি বেরসরকারি হাসপাতালে। অবস্থার অবনতি হলে শনিবার দুপুরে তাকে নিয়ে আসা হয় মুগদা জেনারেল হাসপাতালে। ছবি: মাহমুদ জামান অভি
লকডাউন বাস্তবায়নের জন্য ব্যাপক প্রস্তুতির প্রয়োজন ছিল বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক বে-নজির আহমেদ।
তিনি বলেন, “বড় সমস্যা হল, সরকার প্রস্তুতি না নিয়ে এই ঘোষণাগুলো দেয়। ১৭ কোটি মানুষকে আপনি সাতদিনের জন্য গৃহবন্দি রাখতে চাচ্ছেন, এটা তো বিরাট প্রস্তুতির বিষয়। বহু সংখ্যক মানুষকে এর সাথে যুক্ত করতে হবে। সংশ্লিষ্টদের (মেয়র, স্বাস্থ্যমন্ত্রী, স্থানীয় সরকার মন্ত্রী) নিয়ে বসে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত ছিল।
“রাস্তাগুলোতে ফাঁকে ফাঁকে বাজার বসবে, একটা দোকান থেকে আরেকটা দোকান ২০ মিটার দূরত্বে বসাবে, জনগণের মধ্যে দূরত্ব বাজায় রাখতে দাগ দিয়ে রাখবে। এগুলো অনেক প্রস্তুতির বিষয় আছে।”
বে-নজির আহমেদ মনে করেন, স্বাস্থ্যবিধি মানতে জনগণের উদাসীনতা ঠেকাতে নিম্ন আয়ের মানুষকে প্রণোদনা দেওয়া উচিত ছিল।
“বস্তির একটা মানুষ তার একদিন কামাই না করলে চলে না। আমাদের উচিত ছিল এতদিনে তালিকা বানানো। অথবা তালিকা থাকলে প্রত্যেককে যদি ১০ হাজার টাকা করে দিয়ে দেয়, তাহলে তো সে আর বের হবে না।”
করোনাভাইরাসে আক্রান্তরা যাতে পরিবারের সদস্যদের আক্রান্ত না করে সেজন্য আইসোলেশন নিশ্চিতে টিম তৈরির পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
ঢাকার মুগদা হাসপাতালে শনিবার এই অপেক্ষা ছিল করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষার জন্য। ছবি: মাহমুদ জামান অভিঢাকার মুগদা হাসপাতালে শনিবার এই অপেক্ষা ছিল করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষার জন্য। ছবি: মাহমুদ জামান অভি
“ঢাকা শহরে যদি ৫০০টা টিম পাঠায়, বাড়িতে গিয়ে দেখবে রোগীর কী অবস্থা। আইসোলেশনের সুযোগ আছে কিনা, সচেতনতার বিষয়ে বোঝাবে- এরকম ম্যানেজমেন্টের জন্য টিম লাগবে। সবমিলিয়ে যদি আমরা করি, তাহলে কঠোর লকডাউন বাস্তবায়ন হবে।”
তবে সাতদিনের লকডাউনে দৃশ্যত অগ্রগতি হবে না জানিয়ে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, “এটা যদি ১৪ দিন করা যায় তাহলে ভালো হয়। ২১ দিন করলে, ২১ দিন পরে দেখা যাবে সংক্রমণ আরও অনেক কমে আসছে। আরও সুবিধা নিতে চাইলে এটা আরও বাড়াতে হবে।”
যা ভাবছেন সাধারণ মানুষ
বিভিন্ন পেশার সংশ্লিষ্টরা ‘কঠোর লকডাউনে’ আপত্তি জানিয়ে এতে তাদের সম্ভাব্য আর্থিক ক্ষতির কথাই বলছেন।
নিউ মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি দেওয়ান আমিনুল ইসলাম শাহীন বলেন, “রমজান এবং ঈদকে কেন্দ্র করে আমাদের সবচেয়ে বেশি বেচাকেনা হয়। গত লকডাউনের ক্ষতি পোষাতে আমরা এই পহেলা বৈশাখ, রমজান এবং ঈদকে কেন্দ্র করে কেউ ঋণ করে, কেউ সঞ্চয়ের টাকা খরচ করে দোকানে নতুন মালামাল সাজিয়েছি।
করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকানোর বিধিনিষেধ শিথিল করে শপিং মল খুলে দেওয়ার পর শুক্রবার ঢাকার নিউ মার্কেট এলাকায় ছিল যানজট। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি
“শবে বরাতের পর দুয়েক দিন আমাদের ভালো বেচাকেনা চলছিল। হঠাৎ লকডাউন ঘোষণায় সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। আবার সর্বাত্মক লকডাউনের কথা শুনছি। এমনটা হলে আমরা খুবই বিপদে পড়ে যাব।”
তিনি বলেন, “এখন যে অবস্থা তৈরি হয়েছে, পথে বসে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। দোকানপাট খোলা রাখার একটা বিকল্প ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায় সরকারের প্রণোদনা দেওয়া উচিত।”
গাউছিয়া দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ কামরুল হাসান বাবু বলেন, “যেই মাত্র আমাদের দোকানদাররা ঈদের বাজারকে কেন্দ্র করে মালামাল তুলেছে, সেই মুহূর্তে আবারও কড়াকড়ি লকডাউন আসছে। এতে আমাদের খুবই ক্ষতির মুখে পড়তে হবে।
“আমরা আবারও দোকান মালিক সমিতিগুলো নিয়ে বসব। এই অবস্থায় কী করা যায়, সবার মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেব।”
গুলিস্তানের ফুটপাতের কাপড় বিক্রেতা রুবেল হোসেন বলেন, “রমজানে আমাদের বেচাকেনা ভালো হয়। এই সময়ে এমন লকডাউন দিলে আমাগো উপায় থাকব না। এখন আমরা কী করব, বুঝতে পারছি না।”
তবে ব্যবসার ক্ষতি হলেও বৃহৎ স্বার্থে সরকারের সিদ্ধান্তকে মেনে নিচ্ছেন ঠিকাদার কে এম কাদের।
“আমাদের তো ক্ষতি হবেই, কিন্তু জাতির স্বার্থে এটা মেনে নিতে হবে। দিন দিন যা পরিস্থিতি হচ্ছে, লকডাউন ছাড়া উপায় নাই। তবে প্রান্তিক শ্রেণির মানুষের কথা সরকারের ভাবতে হবে।”
তরুণ উদ্যোক্তা খন্দকার আসাদুজ্জামান মনে করেন, ‘লকডাউনের’ নামে জীবন বাঁচাতে জীবিকা নষ্ট হচ্ছে।
“জীবিকা না চললে জীবন চলবে কিভাবে? যাদের বেসরকারি চাকরি তাদেরও তো সংসার করতে হয়। জীবন-জীবিকা বাঁচাতে সমন্বয় দরকার। লকডাউন আমাদের জন্য গজবের মতো বিষয়।”
‘লকডাউনের’ মধ্যে ‘কঠোর স্বাস্থ্যবিধি’ প্রতিপালনসাপেক্ষে দোকানপাট ও শপিংমল খোলা রাখার অনুমতি দিয়েছে সরকার। তবে শুক্রবার নিউ মার্কেট এলাকায় কেনাকাটার ভিড়ে সেই স্বাস্থ্যবিধি ছিল উধাও। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি
“আমরা তরুণ উদ্যোক্তারা এতদিনে নিঃস্ব হয়ে গেছি। লকডাউন কন্টিনিউ করতে থাকলে ব্যবসায়ী হওয়াটাই অভিশাপ হয়ে দাঁড়াবে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী প্রজন্ম সরকারি চাকরি করে নিশ্চিত ভবিষ্যৎ চাইবে, এদিকে আর কেউ আসবে না,” বলেন তিনি।
ঢাকার কামরাঙ্গিরচরের সেভ দ্য ট্রিট ক্লিনিকের দন্ত চিকিৎসক ফিরোজ কবির বলেন, “আমরা চেম্বারে সন্ধ্যায় বসি, লকডাউনের সময় তখন রাস্তা জনশূন্য থাকে; তখন নিরাপত্তার কারণে মানুষ বের হতে চায় না। এসব দিক দিয়ে আমাদের পেশায় একটা প্রভাব পড়বে।”
সর্বাত্মক লকডাউনকে ‘গরিবের পেটে লাথি’ হিসেবে দেখছেন নিম্ন আয়ের মানুষরা।
মিরপুরের বিকল্প পরিবহনের কর্মী আনোয়ার বলেন, “লকডাউনে কাম বন্ধ হয়ে গেলে খামু কী? আমাদের তো রোজের আয়। আমাদের জন্য সরকারের কিছু করা উচিত। গতবছরও আমাদের অবস্থা বেগতিক ছিল।”
রিকশাচালক আবুল হাশেম বলেন, “আমরা দিন আনি দিন খাই। লকডাউন দিলে না খেয়েই মরে যাব। এইটা গরিবের পেটে লাথি ছাড়া কিছু না, গরিব মারার ব্যবস্থা হইতেছে। সরকারি চাকরিজীবীরা তো ঘরে বসে বেতন পাইব, আমাগো কী হইব?”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার ভ্রাম্যমাণ চা বিক্রেতা মান্নান মিয়া বলেন, “লকডাউন দিলে নিজে না হয়, এখান থেকে সেখান থেকে কষ্ট করে পেট চালাইলাম। কিন্তু বউ-বাচ্চা কী খেয়ে বাঁচব? সরকার আমাদের কথা বিবেচনা করুক।”