উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, নারী ও শিশু ছাড়া আর কেউ বাড়ি নেই। নারী ও শিশুদের চোখেমুখে দেখা গেছে ভয়ের ছাপ। তারা বাইরের কাউকে দেখলেই ভয়ে দৌড়ে পালাচ্ছে। ফসলের মাঠেও দেখা মেলেনি কোনো কৃষকের।
গত ৫ এপ্রিল সন্ধ্যায় উপজেলা প্রশাসনের লোকজন রামকান্তপুর এলাকায় লকডাউন বাস্তবায়ন করতে গেলে স্থানীয়দের সঙ্গে বাগবিতণ্ডা হয়। পরে সালথা থানা, উপজেলা পরিষদ ও সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কার্যালয়ে হামলা চালিয়ে আগুন দেওয়া হয়। গুজব ছড়িয়ে এ ঘটনা ঘটানো হয় বলে প্রশাসন ও স্থানীয়দের ভাষ্য।
এ ঘটনায় ৬১ জনকে গ্রেপ্তার এবং পাঁচ মামলায় ২৬১ জনের নাম উল্লেখসহ কয়েক হাজার জনকে আসামি করা হয়েছে।
রোববার সালথা বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, সাপ্তাহিক হাটের দিন বিভিন্ন গ্রামের নারীরা পেঁয়াজ-পাটসহ নিত্যপণ্য কেনাবেচা করছেন। কেউ কেউ বাজার করতে এসেছেন।
পেঁয়াজ বেচতে আসা সালমা বেগম নামে এক নারী বলেন, “বাড়িতে কোনো পুরুষ সদস্য নেই। ওই ঘটনার পর থেকে ভয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে সবাই। বাড়িতে পেঁয়াজ ছিল। সেগুলো বিক্রি করতে এসেছি। বিক্রি করে যে টাকা পাব তাই দিয়ে বাজার-সদাই করব আর কিস্তি দেব।”
যেখান থেকে ঘটনার শুরু সেই ফুকরা বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, সব দোকানপাট বন্ধ। সেখানে কথা বলার মত কোনো পুরুষকে পাওয়া যায়নি।
স্থানীয় হাসি বেগম নামে এক নারী বলেন, “সব সময় ভয়ে আছি। কোন সময় পুলিশ আসে এই আতঙ্কে দিন কাটে। বাড়িতে কোনো পুরুষ লোক নেই। সবাই গ্রেপ্তারের ভয়ে পালিয়ে রয়েছে।”
অনেকেই সংকোচ কাটিয়ে বাজারে যেতে পারছেন না।
মিলি আক্তার নামে এক গৃহবধূ বলেন, “ভয়ে বাড়ির সবাই পলাতক রয়েছে। বাড়িতে রয়েছি আমি ও শিশুসন্তানরা। বাড়িতে বাজার-সদাই নেই। কোনো পুরুষলোক নেই যে তাকে দিয়ে বাজার করাব। ঘরে যা ছিল তা দিয়েই কোনো রকমে চলছি।”
মারুফা নামে আরেক গৃহবধূ বললেন ক্ষেতের ফসল নিয়ে দুশ্চিন্তার কথা।
“ফসল ওঠানোর সময় এখন। পুরুষমানুষ বাড়িতে না থাকায় মাঠের ফসল ঘরে তুলতে পারছি না। এই ফসল বিক্রি করেই সারা বছর সংসার চলে। এখন কী করব ভেবে পাচ্ছি না।”
শৌলডুবি গ্রামের মালেকা বেগম বলেন, “ভয়ে আমার স্বামী বাড়িতে থাকেন না। ছেলেকে আগেই বাইরে আত্মীয়র বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছি। জমিতে ফসল রয়েছে। সেগুলো কেটে ঘরে তুলতে হবে। কিন্তু পারছি না।”
‘কোনো সহিংস ঘটনা ঘটলে কয়েক দিনের জন্য বিভিন্ন গ্রামে এজাতীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়’ বলে জানালেন ফরিদপুরের ডিসি অতুল সরকার।
তিরি বলেন, “আশা করি দ্রুতই এ অবস্থা কেটে যাবে।”
আর জেলার পুলিশ সুপার মো. আলিমুজ্জামানের দাবি, পুলিশ কাউকে হয়রানি করছে না।
তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “যারা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত নয় তাদের আতঙ্কিত হয়ে বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার কোনো কারণ নেই। পুলিশ কাউকে হয়রানি করছে না। সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে জড়িতদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।”
গ্রেপ্তারের বিষয়ে জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. জামাল পাশা জানিয়েছেন, এখন পর্যন্ত মোট ৬১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের দুইজন গুলিবিদ্ধ। তাদের পুলিশ পাহারায় চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। আর মিরান মোল্লা (৩৫) নামে একজন গ্রেপ্তারের পর ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন।
তাছাড়া হামলার সময় জুবায়ের হোসেন (২০) নামে আহত একজনের মৃত্যু হয় চিকিৎসাধীন অবস্থায়।
জামাল পাশা বলেন, গ্রেপ্তারকৃতদের আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানোর পর ৪৮ জনকে রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
পুলিশের গুলিতে দুইজন নিহত ও এক মওলাকে মারধরের গুজব ছড়িয়ে এলাকাবাসীকে উত্তেজিত করা হয় মাইক থেকে। তাছাড়া বেশ কয়েকটি মোবাইল ফোন থেকে ফেইসবুক লাইভে গুজব ছড়ানো হয়। পরে রাত ৮টা থেকে ১১টা পর্যন্ত তিন ঘণ্টা ধরে উপজেলা কমপ্লেক্স, উপজেলা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) দপ্তর তছনছ করার পাশাপাশি আগুন দেয় হামলাকারীরা। তাতে কয়েক হাজার মানুষ অংশা নেয়।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্য যোগ দেয়। তারা সাত শতাধিক গোলাগুলি নিক্ষেপ করে।
আরও পড়ুন
সালথা তাণ্ডব: নতুন চার মামলা, গ্রেপ্তার বেড়ে ২৬
সালথা তাণ্ডব: আসামি ৪ হাজার, গ্রেপ্তার অব্যাহত
ফরিদপুরে আগুন-হামলা: আসামি ৩-৪ হাজার
সালথায় হামলা গুজব ছড়িয়ে, ভাষ্য স্থানীয়দের
ফরিদপুরে আগুন-হামলা পরিকল্পিত: ইউএনও