সোমবার দেশে প্রথমবারের মত এলপি গ্যাসের দাম নির্ধারণ করে দেয় বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)।
এই আদেশের বিরুদ্ধে ভোক্তা অধিকারের পক্ষে সোচ্চার নাগরিক সমাজ ও ব্যবসায়ী প্রতিনিধি উভয় পক্ষই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে।
সোমবার ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে বিইআরসি বেসরকারি পর্যায়ে প্রতিকেজি এলপি গ্যাসের দাম ৮১ টাকা ৩০ পয়সা নির্ধারণ করে দেয়। এ হিসাবে ১২ কেজি বোতলের দাম ধরা হয়েছে ৯৭৫ টাকা। সরকারিভাবে সরবরাহ করা ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম হবে ৫৯১ টাকা।
রেটিকুলেটেড পদ্ধতিতে সরবরাহ করা বেসরকারি এলপিজির দাম হবে প্রতিকেজি ৭৯ টাকা ০১ পয়সা। আর ভোক্তা পর্যায়ে প্রতি লিটার অটোগ্যাসের সর্বোচ্চ দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৪৭ টাকা ৯২ পয়সা।
তিন দশক ধরে দেশে এলপিজির ব্যবসা চলে আসলেও নানান কারিগরি জটিলতার কারণে এতদিন দাম নির্ধারণ করা যাচ্ছিল না। সর্বশেষ আদালতের নির্দেশনা মেনে দাম নির্ধারণে শুনানিসহ অন্যান্য প্রক্রিয়া শেষ করে বিইআরসি, যা ঘোষণার পর থেকেই সারাদেশে কার্যকর হবে।
জানতে চাইলে কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বেআইনি প্রক্রিয়ার এই আদেশের মাধ্যমে ভোক্তাদের অধিকার ক্ষুন্ন করা হয়েছে, ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষা করা হয়েছে।
জ্বালানি খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থার সিদ্ধান্ত মনপুত হয়নি এ খাতের মালিকদের সংগঠন এলপিজি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আজম জে চৌধুরীও। তিনি বলেন, “দাম নির্ধারণে যাবতীয় ব্যয়ভার বিবেচনায় না নিয়ে বিইআরসি কারিগরি জ্ঞানের শূন্যতার পরিচয় দিয়েছে। এই আদেশ বাস্তবায়ন করতে গেলে অচিরেই বাজারে সঙ্কট সৃষ্টি হবে।“
অটোগ্যাসের যে দাম নির্ধারণ করা হয়েছে তা নিয়ে কোনো আপত্তি নেই বলে জানিয়েছেন তিনি।
দাম ঘোষণার সময় আদেশের পক্ষে যুক্তি দিয়ে বিইআরসির চেয়ারম্যান মো. আব্দুল জলিল বলেন, এলপিজির বাজার পরিস্থিতি যাচাই করতে গিয়ে তারা বারবার পক্ষগুলোর সঙ্গে বসে আলোচনা করেছেন। দীর্ঘ তিনমাস ধরে মাঠের প্রকৃত চিত্র ও বাস্তবতা সম্পর্কে ধারনা নিয়েছেন। সার্বিক দিক বিবেচনা করেই আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে ভারসাম্য রেখে একটি মূল্য কাঠামো ঠিক করেছেন। অন্যসব ব্যয়ভার ঠিক রেখে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম উঠানামা সাপেক্ষে প্রয়োজন অনুযায়ী যে কোনো সময়ে এই দাম পুনঃনির্ধারণের সুযোগ রেখেই আদেশটি দেওয়া হয়েছে।
গৃহস্থালীতে ও বাণিজ্যিকভাবে দেশে এখন এলপিজির ব্যবহার বাড়ছে। পাইপলাইনে সরবরাহ করার গ্যাসের সংকটের কারণে তরল রূপান্তরিত এই গ্যাসের চাহিদাও বেড়েছে দেশজুড়ে। প্রতিবছরই দাম নিয়ে ভোক্তা ও খাত-সংশ্লিষ্টদের মধ্যে অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগ লেগেই থাকে।
এমন প্রেক্ষাপটে দাম নির্ধারণের আলোচিত এই পদক্ষেপের প্রক্রিয়া শেষ হয় বিএসইসির আদেশের মধ্য দিয়ে। সোমবার আদেশের পর পুরো বিষয়টি নিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম এবং এলপিজি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আজম জে চৌধুরী।

অধ্যাপক শামসুল আলমের বক্তব্য
অবৈধ উপায়ে ব্যবসায়ীরা নিজেদের খেয়াল খুশি মত এতদিন মূল্য নির্ধারণ করত। এ নিয়ে আইনি লড়াই শেষে আদালতের নির্দেশে দাম নির্ধারণের যাত্রা শুরু হলো। সেজন্য আমরা সন্তষ্ট।
কিন্তু আমরা অনেকখানি উদ্বিগ্ন। কারণ, ১৪ জানুয়ারির গণশুনানি যে পরামর্শক দিয়ে দাম মূল্যায়ণ করা হয়েছিল, তারা ১২ কেজি এলপিজি বোতলের দাম নির্ধারণ করে করেছিল ৮৪০ টাকা। পরে বিইআরসির টেকনিক্যাল কমিটি সেটা ৮৬৬ টাকার প্রস্তাব শুনানিতে তুলে ধরে। সেখানে আমরা বলেছিলাম, এলপিজির দামের সঙ্গে যেসব ব্যয়ের হিসাব যোগ করা হয়, তা যথাযথভাবে মূল্যায়ন করলে ১২ কেজির বোতলের দাম ৮৬৬ টাকা থেকে কমিয়ে আনা সম্ভব। তবুও যেহেতু এটা প্রথম পদক্ষেপ, তাই আমরা এই দামের ওপর কিছুটা শিথিলতা দেখিয়েছিলাম।
কিন্তু তখন সেই আদেশ দেওয়া হয়নি। আইনের অজুহাত দেখিয়ে তিনমাস অপেক্ষা করে বসে আছে।
বিইআরসির আইনের যেই ধারায় বলা আছে, বছরে একবারের বেশি মূল্য বৃদ্ধি করা যাবে না, সেখানেই তিনমাসের কথাটি বলা আছে। কিন্তু যেখানে প্রতিমাসে এলপিজির মূল্য বৃদ্ধি করা হবে বলা হচ্ছে, সেখানে প্রথমেই তিনমাস অপেক্ষা করার মানে কী?
জানুয়ারির আন্তর্জাতিক বাজারের সাপেক্ষে যেই মূল্যটা নির্ধারণ করা যেত সেটা না করে এখন মার্চ মাসের সাপেক্ষে মূল্য নির্ধারণ ব্যবসায়ীদের বাড়তি আয়ের সুযোগ করে দিল। তখন মূল্য নির্ধারণ করা হলে ৮৬৬ টাকায় ভোক্তারা এলপিজি পেত। প্রয়োজনে পরের মাসে দাম বাড়লে বাড়ানো যেতো। প্রয়োজন হলে কোম্পানিগুলো ‘ইনক্রিমেন্টাল বেনিফিটসগুলো’ পেত। ভোক্তাও অনেকখানি ন্যায় বিচার পেত। তাহলে বিইআরসির কার্যক্রমে ভোক্তাদের ঠকানো হলো, ন্যায় বিচার বঞ্চিত করা হলো, বিষয়টি এখন স্পষ্ট।
এই আদেশ ভোক্তাদের অধিকার বিপন্ন করেছে। ব্যবসায়ীদের অবৈধভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে।
দ্বিতীয়তঃ যে বিপত্তিটি দাঁড়িয়েছে তা হলো, কথা ছিল গণশুনানির ভিত্তিতে মূল্যহার নির্ধারণ করতে হবে। কিন্তু তারা শুনানি শেষে একটা কমিটি করে দিয়ে মূল্য নির্ধারণ করেছে। এই রকম পদ্ধতিতে মূল্য নির্ধারণের সুযোগ বিইআরসির আইনে নেই।
ব্যবসায়ীদের নিজস্ব বিবেচনায় মূল্য নির্ধারণ প্রক্রিয়াকে অবৈধ বলে আদালতের আদেশে মাধ্যমে শুনানির সূচনা হয়েছিল। এখন বিইআরসি নিজেই অবৈধ পদ্ধতি অবলম্বন করে মূল্য নির্ধারণের নতুন পথ এই আদেশের মাধ্যমে সূচনা করল। বিষয়টি দেখে এবং প্রমাণ পেয়ে আমরা ভয়ঙ্করভাবে উদ্বিগ্ন।
তৃতীয়তঃ মূল্যহার নির্ধারনে সরকারি কোম্পানির গ্যাসের দাম কম রাখা হয়েছে, এটা ভালো কথা। আমরা বলেছিলাম বিদ্যুতের ক্ষেত্রে সরকার যেভাবে প্রান্তিক অঞ্চলের মানুষের জন্য ভূর্তকি দিয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে, কম দামের গ্যাসও যেন একইভাবে প্রান্তিক গ্রাহক; বিশেষ করে বস্তিবাসী, নিম্ন আয়ের মানুষ পেতে পারে সে ব্যবস্থা করে আদেশ দেওয়া হউক।
বিইআরসি কম দাম নির্ধারণ করেছি ঠিকই, কিন্তু আগের মতোই সুবিধাভোগীদের জন্য উন্মুক্ত রেখেছে। ভোক্তার স্বার্থ সুরক্ষার কিছুই দেখা যাচ্ছে না।

আজম জে চৌধুরীর বক্তব্য
এলপিজির মতো পরিবেশবান্ধব জ্বালানির বাজার সৃষ্টির জন্য ব্যবসায়ীরা ৩২ হাজার কোটি টাকার মতো বিনিয়োগ করেছেন। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম ভোক্তা পর্যায়ে ফেয়ার প্রাইস এবং সারাদেশে একই প্রাইস থাকা উচিত। এ নিয়ে বিইআরসির সঙ্গে কমপক্ষে ১৫ থেকে ২০ বার বৈঠক হয়েছে।
মূল্য নির্ধারণে কোন কোন ‘ফ্যাক্টগুলো’ বিচেনায় নিতে হবে সেটা নিয়ে বিস্তারিত আলাপ করেছিলাম। কিন্তু তারা যখন দাম ঠিক করে তখন আমরা যে বিষয়গুলো বলেছি সেগুলো আমলে নেয়নি। এতে আমরা বিস্মিত হয়েছি। তারা কোনো ‘জাস্টিফিকেশন’ করেনি।
৯৭৫ টাকার এই দামটা কিভাবে আসলো, ব্রেকডাউনটা কী, কোন খাতে কত খরচ হয়, মূল্য নির্ধারণ প্রস্তাবে এগুলোর কিছুই নেই। তাই এটা আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। একটা ফেয়ার প্রাইসের জন্য তাদের চিঠি দেব। যাতে আবার আমাদের সঙ্গে বসে মতপার্থক্যগুলো দূর করে নেয়।
অপারেটরদের গাড়ি দিয়ে এগুলো ডিস্ট্রিবিউটরদের কাছে পৌঁছে দিতে হয়। ১২ কেজি সিলিন্ডার পরিবহনে ব্যয় হয় ৫০ টাকা। বিষয়টা তারা হিসাবেই ধরেনি। এরকম অনেকগুলো ইস্যু আছে যেগুলো বিইআরসি বিবেচনাতেই নেয়নি।
সৌদি আরামকোর সিপি এডজাস্ট হওয়ার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেটা নিয়ে কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু যেগুলো ফ্যাক্টর, সেগুলোর অনেক কিছুই বাদ দেওয়া হয়েছে। এটা হচ্ছে মিসলিড করা। আমাদের আশঙ্কা, এত কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে একটা খাতে, সেটাকে ধ্বংস করার একটা ব্যাপার চলছে। উনারা তো ‘টিকনিক্যাল’ কিছু জানেন বলে মনে হচ্ছে না।
আমরা চিঠি দিয়ে এই প্রাইসটা কিভাবে আসলো জানতে চাইবো। আমাদের মনে হয় ভোক্তাদের একটা চাপ আছে, আদালতের আদেশের একটা সময়সীমা আছে। এটাকে ‘মিট’ করার জন্য তারা আন্দাজি একটা আদেশ দিয়ে দিয়েছে। সবগুলো ফ্যাক্টর এখানে বিবেচনায় আনা হয়নি।
সবচেয়ে মজার বিষয় হলো এই আদেশে কোনো প্রফিট কনসিডারেশনে নেওয়া হয়নি। আমরা তো চ্যারিটি করার জন্য ব্যবসায় আসিনি। তারা যখন বসেছেন তখন আমাদের অনেকগুলো ব্রেকডাউনের ক্ষেত্রে ‘না’করেন নাই। কিন্তু প্রাইস যখন বসিয়েছে, তখন আর এগুলো উল্লেখ করে নাই।
একটা সিলেন্ডারের দাম আছে দুই হাজার টাকার ওপরে। কিন্তু তারা সিলিন্ডারের দাম বিবেচনা করেছে এক হাজার টাকা। এই দাম নিয়ে যে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে তা নিয়ে আরেক দফা আলোচনা করতে চাই। আলোচনায় ফল না এলে একটা ‘লিগেল রিমেডির’জন্য যেতে হবে। আপনি নিজের ইচ্ছেমত একটা প্রাইস বসিয়ে দেবেন, এটা তো হবে না। আমরা আগে আনুষ্ঠানিক চিঠি দেব। সেটির উত্তরের পর পরবর্তী ব্যবস্থা নেব।
আরও পড়ুন:
১২ কেজি এলপিজি সিলিন্ডারের সর্বোচ্চ দাম ৯৭৫ টাকা
১৪ এপ্রিলের মধ্যে এলপিজির দাম নির্ধারণ: আদালতে জানাল বিইআরসি