আর ইলিশ মাছ যে বাঙালির ঐতিহ্য- সেটার শুরু তো নব্বই দশকে।
পহেলা বৈশাখ হলেও বের হওয়ার উপায় নেই, মহামারী ছোঁবল। তাহলে উপায় একটাই ঘরে থেকেই রসনা তৃপ্ত করা। সেখানেও এবার জটিলতা; রোজার প্রথম দিন।
তাহলে ইফতারেই হতে পারে বাঙালি খাবার দিয়ে টেবিল সাজানো। তাই বলে পান্তা ভাত! নাকি অন্যকিছু?
বাঙাল খাবারের আয়োজন যদি করতেই চান ইফতারে, তবে ফিরে যেতে হবে ১৯শ’ সালের দিকে।
১৯৪৫ সালে প্রকাশিত ঢাকার বিখ্যাত বাসিন্দা হাকিম হাবিবুর রহমানের লেখা বই ‘ঢাকা পাঁচাশ বারাস পাহেলে’ অনুসারে সাহিত্যিক সাংবাদিক আনিস আহমেদ তার ‘ঢাকাইয়া আসলি’ বইতে তুলে ধরেছেন চমকপ্রদ তথ্য। যেখানে বাঙালি খাবার বলতে আমারা যা বুঝি সেগুলোর মধ্যে সেহরিতে ভাতের কথাই এসেছে বারবার। ইফতারে মাছ বা পানিতে ভেজানো ভাতের কোনো নাম-নিশানা নেই।
সেই সময়েও সেহরিতে গরম ভাত রান্না করে পরিবেশন করা হত। অন্যান্য তরকারি রান্না করে রাখা হত দিনের সময়ে। ঢাকার বাসিন্দারা তখন সেহরিতে কোরমা ও শীরবেরেঞ্জ (দুধ, চিনি, মাওয়া, কিশমিশ প্রভৃতি মেশানো মজার খাবার) খেতেন।
প্রথম রোজার সেহরিতে কোফতা দিয়ে কোরমা রান্না করা হত, কোথাও বা কালিয়া। আর সেটা পুরুষরা রুটি দিয়ে খেতে পছন্দ করতেন। আর নারীরা খেতেন ভাত দিয়ে।
সেই সময়ে সবে চায়ের প্রচলন হয়েছে। তবে সেটা খালি মুঘল অভিজাত ও কাশ্মিরীদের মধ্যে। সর্বসাধারণের জন্য নয়। তাই অভিজাত এসব মানুষেরা চা পান করতেন। তাদের মতে, এতে নাকি দিনে তেষ্টা কম পায়।
আহসান মঞ্জিলের খাজাসাহেবরা সাধারণত শীরবেরেঞ্জ পছন্দ করতেন। অন্যান্যরা এই মিষ্টান্নর পরিবর্তে তৈরি করতেন ক্ষীর বা ফিরনি। আর এই মিষ্টি খাবার তৈরির জন্য বাজার থেকে কিনে আনা হত মালাই।
ইফতারির আয়োজন দুপুর থেকেই শুরু হয়ে যেত। ভেজানো ছোলা থেকে বুট বের করে ভালোভাবে পিষে তৈরি করা হত তেলে ভাজা ফুলুরি। পেঁয়াজ, মরিচ তেল দিয়ে মাখানো মুড়ি-ভর্তার প্রচলন তখনই ছিল।
বনেদি ঘরের ইফতারিতে মুড়ি-ভর্তার সঙ্গে থাকতো ভাজা পনির। আরও ছিল তেলে ভাজা মাখনার খই।
রোজা শুরুর আগেই জমজমের পানি মক্কা থেকে আনিয়ে রাখা হত। ইফতারের শরবতে কয়েক ফোঁটা জমজমের পানি মিশিয়ে পরিবেশ করার রীতি ছিল। কোনো কোনো সময় দেওয়া হত খোরমার কুচি।
শরবতের নানান রকমও থাকতো। পেস্তার শরবত, তোকমার শরবত। আবার যাদের মেজাজ গরম বলে চিহ্নিত ছিল তারা লেবুর বা আমলী গুড়ের ঘন টক মিষ্টি শরবত দিয়ে রোজা খুলতেন।
ফালুদার প্রচালন ছিল সবখানেই।
ঘরে তৈরি খাবারের মধ্যে থাকতো মুড়ি, নিমকি, মিষ্টি সমুসা, কাঁচা ও ভুনা ছোলা বুট, ফল, ফুলুরি। আর বাজার থেকে কেনা পদের মধ্যে ছিল গোলাবী ওখরা, ভুনা চিড়া, টিপা ফুলুরি, ডালের বড়া, বুট। আর থাকতো বাখরখানি।
আরও থাকতো কাবাব ও টাটকা কচি শসা বা ক্ষীরা। সঙ্গে পুদিনা পাতা।
ফলের মধ্যে জনপ্রিয় ছিল পানিফল; যার প্রাচীন নাম কাঁটা শিঙ্গারা। আর গরমের সময়ই এই ফল খুঁজে নিয়ে আসা হত।
যেকোনো মৌসুমে রোজা হোক না কেনো, অবশ্যই থাকতো আখ বা গেন্ডারি।
সেই সময়েও চকবাজারে ইফতারির বাজার বসতো।
হাকিম হাবিবুর রহমান তার বইতে আরও লিখেছেন, তার সময় থেকে পঞ্চাশ বছর আগে, (অর্থাৎ বর্তমান সময় থেকে প্রায় দেড়শ বছর আগে) আলাউদ্দিন হারওয়াই লক্ষ্ণৌ থেকে এসে চকবাজারে দোকান খুলেন। নিমক পারা, সামুসা ও লক্ষ্ণৌ শিরমাল তার দোকানেই পাওয়া যেত। তাই এটা প্রাচীন ঢাকার জিনিস নয়। বরং পরোটা কাবাব পুরান ঢাকার খাবার, যা কিনা ঘরে ঘরেই তৈরি হয়।
ঠাণ্ডা পানি পান করার জন্য ধনীরা কলমি শোরাতে পানি ঠাণ্ডা করতেন। যারা এই শোরা কিনতে পারতে না, তারা কলসি বা মটকাতে পানি ভরে, মুখ বন্ধ করে ভোরে বা দুপুরে রশি দিয়ে কুয়াতে ডুবিয়ে রাখতো। তখন সবার বাড়িতেই কুয়া বা কুপ ছিল। আর ইফতারের আগে সেটা তুলে পরিবেশন করা হত শীতল খাবার পানি।
রমজান মাসে কাবাবের নানান পদের আয়োজন করা হত বেশি। বাজারে বিক্রি হওয়া সেসব কাবাবের মধ্যে আছে শিককাবাব, নার্গিসি কাবাব বা বটি, শিকের ও হান্ডির মোরগ কাবাব। আর এসব খাওয়ার জন্য বাসায় তৈরি হত রুটি ও পরোটা।
রুটির মধ্যে জনপ্রিয় ছিল নানরুটি। আর যাদের সামর্থ কম তাদের ওই সেহরিতেও ভাত, ইফতারেও ভাত।
তাহলে পান্তা-ভাত!
প্ল্যাটার।
বাঙালির খাদ্যাভ্যাসে পান্তার প্রচলনটা আসলে কৃষক সমাজের মধ্যেই ছিল বেশি।
অধ্যাপক মুহাম্মদ এনামুল হকের ‘বাংলা নববর্ষ বা পয়লা বৈশাখ’ প্রবন্ধেও এর সমর্থন পাওয়া যায়;
“বৈশাখ মাসে প্রাতে এক থাল ‘পান্তা’ খেয়ে মাঠে লাঙল দিতে বের হতে আমিও বাংলার কয়েক জেলার চাষিকে দেখেছি। তাই বলছিলাম হয়ত অনুষ্ঠানটি একসময় দেশের সর্বত্র প্রচলিত ছিল।”
আর ঐতিহাসিক সাবাসি-য়ানো মানরিকের স্মৃতিকথায় লিখেছেন, “ষোড়শ শতকে গরিব বাঙালিরা নুন আর শাক দিয়ে ভাত খেতেন। ঝোল জুটত সামান্যই।”
চতুর্দশ শতকের শেষ ভাগের একটা বই, প্রাকৃত ভাষার গীতি কবিতার সংকলিত গ্রন্থ ‘প্রাকৃত পৈঙ্গল’য়ে আছে- ‘ওগগারা ভত্তা গাইক ঘিত্তা’। মানে হল, খাঁটি ঘি সহযোগে গরম ভাত!
নৈষধচরিতে ভাতের আরও বিস্তারি বর্ণনা আছে, ‘পরিবেশিত অন্ন হইতে ধুম উঠিতেছে, তাহার প্রতিটি কণা অভগ্ন, একটি হইতে আরেকটি বিচ্ছিন্ন! সে অন্ন সুসিদ্ধ, সুস্বাদু আর শুভ্রবর্ণ, সরু ও সৌরভময়!’
এসব কিছু থেকে এটা অনুমান করা যায় যে, বাঙালির রীতি ছিল গরম ফেনায়িত ভাত ঘি সহযোগে খাওয়া!
ভাতের সঙ্গে আর কী খেত?
‘ওগগারা ভত্তা রম্ভা পত্তা গাইক ঘিত্তা দুদ্ধ সজুক্তা, মোইলি মচ্ছা নালিত গচ্ছা দিজ্জই কান্তা পুনবস্তা!’
মানে হল, যে রমণী কলাপাতায় গরম ভাত, গাওয়া ঘি, মৌরলা মাঝের ঝোল, নালিতা মানে পাটশাক প্রতিদিন পরিবেশন করতে পারেন, তার স্বামী পুণ্যবান!
মোট কথা ভাত সাধারণত খাওয়া হত শাক দিয়ে! নিম্নবিত্তের প্রধান খাবারই ছিল শাক!
তাই নববর্ষে ভালো ও সুস্বাদু খাবার খাওয়ার প্রচলনই থাকাই স্বাভাবিক।
খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য মোগল সম্রাট আকবর (১৫৪২-১৬০৫ সাল) বঙ্গাব্দ প্রচলন করেছিলেন। কারণ আরবি বর্ষ চাঁদের সঙ্গে মিলিয়ে তৈরি। ফলে বদ্বীপ অঞ্চলে কৃষি নির্ভর মৌসুমের সঙ্গে মিলত না চাঁদের বর্ষ। চাঁদের বর্ষ অনুসারে খাজনা দিতে গেলে কৃষকদের চাপ পড়ে যেত। সেই অসুবিধা দূর করতেই শুরু হয় বঙ্গসাল।
তবে মোগলদের আগে যে নববর্ষ পালিত হত না তা নয়।
সাহিত্যিক আতোয়ার রহমান পণ্ডিতদের বরাত দিয়ে লিখেছেন, ‘নববর্ষের উৎসব প্রাচীনকালের বাংলায়ও ছিল, কৃষির প্রথম যুগে। তখনকার নববর্ষের দিন-তারিখ বেঁধে রাখত না কেউ, নববর্ষ তখন উদ্যাপিত হতো চাষ মৌসুম শুরুর দিনটিতে, গ্রামের সবার সামাজিক ভোজের মাধ্যমে।’
আর ভোজ মানেই যে সুস্বাদু ভালো খাবার তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
আবার বছর শেষে তিতা খাবার খাওয়ার প্রচলন ছিল।
এই বিষয়ে প্রাবন্ধিক, সাহিত্যিক আহমদ ছফা লিখেছেন, ‘৩১ চৈত্র, যেদিন বছরের শেষ, রাতে খাওয়ার সময় সকলে সামান্য পরিমাণে হলেও তিতা খাবার খেয়ে থাকেন। এই তিতা খাবারের মধ্যে একটা প্রতীকী ব্যাপার রয়েছে। যে বছরটি পার হয়ে এলাম, সে বছরের ব্যথা-বেদনা-দুঃখ-শোক সবকিছুই বিসর্জন দিয়ে নতুন একটা বছরে নতুনভাবে জীবন শুরু করতে যাচ্ছি। তিতা খাওয়া হচ্ছে সে দুঃখ-বেদনা ধুয়ে ফেলার প্রতীক। আমরা ছোটবেলায় দেখেছি, ৩১ চৈত্র পুকুরে জাল ফেলে মাছ ধরা হত এবং পহেলা বৈশাখে খাওয়ার জন্য মাছ রান্না করে রাখা হত।’
আর পান্তার সঙ্গে ইলিশ খাওয়ার প্রচলনটা তো নব্বই থেকে।
রমনার বর্ষবরণ উৎসব এবং চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা জমে যাওয়ার পরে যখন এ এলাকা ঘিরে লোক সমাগম হতে থাকে তখন কিছু অস্থায়ী মেলার সঙ্গে খাওয়ার দোকানও বসে।
মাটির সানকিতে পান্তা-ইলিশ খাওয়া মূলত এইসব দোকানীদের আবিষ্কার। যা পরে খুব দ্রুত অন্যরাও গ্রহণ করে। প্রাচীন বাংলা বা বাংলা সনের সঙ্গে এই ইলিশ খাওয়ার কোনোই সম্পর্ক নেই।
আর ইতিহাসেও তেমন কোনো তথ্য নেই। হয়ত কোনো ঐতিহাসিকই ‘ইলিশ প্রেমী’ ছিলেন না।
অষ্টাদশ শতাব্দীর কবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের আগে এই মাছের নাম-নিশানা পাওয়া যায়নি। এমনকি এপার বাংলার কবি বিজয়গুপ্তের কাব্যেও নেই ইলিশের উপস্থিতি।
আঠারো শতকে সংকলিত বৈয়াকরণিক ম্যানুয়াল বা ন্যাথানিয়েল ব্র্যাসি হ্যালহেড়ের মুনশির অভিধানেও ইলিশের নাম নেই।
আর এসবের জন্য দায়ী করা যেতে পারে ইলিশের কাঁটাকে।
এই কাঁটা সমীহ করে চলেছে ভারত বিজয়ী ইংরেজরা। এমনকি অলিখিত আইন করে ইলিশ থেকে যোজন যোজন দূরেই ছিলেন সাহেবসুবারা।
সে সমস্যা থেকে মুক্তি দিতেই যেন ‘স্মোকড হিলসার’ আবিষ্কার। বাষ্পীয় পদ্ধতিতে রান্না করা ইলিশই ইংরেজদের ছাড়পত্র দিয়েছিল এর স্বাদটুকু নির্বিঘ্নে আস্বাদন করতে।
প্রখ্যাত সাতিহ্যিক শংকর ‘স্মোকড হিলসা’কে আখ্যায়িত করেছেন ‘বিলিতি মেম সাহেব এবং দিশি রাঁধুনীদের সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধনের শ্রেষ্ঠতম নিদর্শন’ হিসেবে।
৮৪ বছর আগে প্রকাশিত সুশীল কুমার দে সংকলিত ‘বাংলা প্রবাদ’ বইয়ে রয়েছে প্রায় ৯ হাজার প্রবাদ। সে সবের মধ্যে মাত্র একটি প্রবাদে দেখা মেলে ইলিশের।
‘ইলিশো খলিশশ্চৈব ভেটকির্মদগুর এবচ। রোহিতো মৎস্যরাজেন্দ্রঃ পঞ্চ মৎস্যা নিরামিষাঃ।’
এতে দেখা যায় খলিশা, ভেটকি, মাগুর আর রুই মাছের সঙ্গে উচ্চারিত হচ্ছে ইলিশের নাম।
তবে মধ্যযুগ থেকেই নাকি ঢাকাবাসীরা পান্তা ভাতের সঙ্গে ইলিশ ভাজা খেয়ে থাকত। সেই সূত্র ধরেই কি পান্তা ভাতের সঙ্গে ইলিশ মাছ খাওয়ার চল চালু হয়েছে? ইতিহাস অবশ্য নিশ্চিত করে কিছু বলে না।