শুধু আইনশৃঙ্খলা
বাহিনী, গণমাধ্যম, ওয়াসার গাড়ি, অ্যাম্বুলেন্স, পণ্যবাহী ট্রাক, সরকারি
কর্মকর্তাদের বহনকারী যানবাহনসহ বিশেষ সেবায় নিয়োজিত যানবাহন চলাচল করতে দেখা
গেছে। বিভিন্ন সড়কে এবং অলিগলিতে বিক্ষিপ্তভাবে কিছু রিকশা ও ঠেলাগাড়ি দেখা গেছে-
বেশিরভাগই বাজারের মালামাল পরিবহনে নিয়োজিত।
ফুটপাতের
অধিকাংশ পথচারীই হয় বাজার করতে যাওয়া স্থানীয় বাসিন্দা অথবা হাসপাতালের বা জরুরি
সেবা সংস্থার কর্মী।
সকালে গুলিস্তান, তোপখানা
রোড, বিজয়নগর, নয়াপল্টন, ফকিরেরপুল, রামপুরা, মালিবাগ, শান্তিনগর, রাজারবাগ, বেইলি
রোড, কাকরাইল, মগবাজার ঘুরে এ রকম চিত্রই দেখা গেছে।

পুলিশ
ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সড়কের মোড়ে মোড়ে টহলে ছিলেন। বিভিন্ন মোড়ে মাইকিং
চলেছে, “অযথা কেউ বাসার বাইরে আসবেন না। স্বাস্থ্যবিধি মেনে বাসায় থাকুন। মাস্ক
পড়ুন।”
নিউমার্কেট,
কারওয়ান বাজার, পান্থপথ, ধানমন্ডি, আসাদগেট, কল্যাণপুর, মিরপুরের বিভিন্ন সড়ক ঘুরে
দেখা গেছে সেখানে কোন গণপরিবহন চলছে না। রাস্তায় দু-একটা প্রাইভেট কার চলছে।
রিকশার সংখ্যাও অন্যান্য সময়ের তুলনায় কম।
এলাকার
ওষুধের দোকান খোলা থাকলেও শপিংমলগুলো ছিল বন্ধ।
মহানগরীর
বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাস্তায় বসানো হয়েছে পুলিশের তল্লাশি চৌকি। গাড়ি থামিয়ে
পরিচয় জানছেন তারা। দেখা গেছে, যারা জরুরি সেবার আওতায় কর্মরত তাদের যেতে দেওয়া
হচ্ছে, অন্যদের ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

অনেক
সড়কে কাঁটাতারের ব্যারিকেড বসিয়ে রাস্তা বন্ধ রাখতে দেখা গেছে। তবে ওইসব সড়কে
জরুরি সেবা সংস্থার যানবাহন চলাচলের জন্য বিকল্প রাস্তা খোলা রাখা হয়েছে।
সকাল
সাড়ে ৯টায় মালিবাগ রেলগেইটের কাছে দেখা গেছে, দুই রিকশা চালককে রিকশা নিয়ে রাস্তায়
নামতে দেখে পুলিশ বাঁশি বাজিয়ে ধাওয়া দেয়। তারা দ্রুত গলিতে ঢুকে যায়।
নিউমার্কেট,
কাঁটাবন, আসাদগেট এলাকায়ও পুলিশ সদস্যদের তৎপরতা ছিলো চোখে পড়ার মতো। লকডাউনে
যারাই বের হয়েছেন, তাদের সঙ্গে কথা বলতে দেখা গেছে।
নিউমার্কেট থানা
এলাকায় দায়িত্বপ্রাপ্ত মহানগর পুলিশের উপপরিদর্শক মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন,
“করোনাভাইরাস মহামারিতে জনগণের সুরক্ষা নিশ্চিতে আমরা মাঠে আছি। কেউ প্রয়োজন ছাড়া
বাড়ির বাইরে বের হচ্ছেন কিনা সেই খোঁজ নিচ্ছি।”
বিভিন্ন অলিগলির গেইট বন্ধ
করে রাখা হয়েছে। বাজার না গিয়ে অনেকেই গলির ভেতরে ঠেলাগাড়ি থেকে কাঁচা বাজারের
দ্রব্যসামগ্রী কিনেছেন।

শান্তিনগর
ও মালিবাগ রেল গেইটের বাজার ঘুরে দেখা গেছে, কাঁচাবাজার করতে এসেছেন কেউ কেউ। একটি
বেসরকারি কলেজের শিক্ষক আবদুল হালিম বলেন, “আমি বাজার করতে এসেছি। কিছু কাঁচা আম ও
তরমুজ কিনবো। দ্রুতই চলে যাবো বাসায়।”
“লকডাউন
চলছে, কয়েক জায়গায় প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়েছি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যরা
অনুরোধ করেছেন, দ্রুত বাজার করে বাসায় ফিরতে। এবারের লকডাউনটা অন্য সময়ের চেয়ে
কড়াকড়ি। রাস্তা-ঘাটের অবস্থা থেকে মনে হচ্ছে ঢাকায় কারফিউ চলছে।”
শান্তিনগরের
বাজারের সামনে বাজার ব্যবসায়ী সমিতি মাইকে প্রচার চালায়, ‘‘সকাল ৯টা থেকে বিকাল
তিনটা পর্যন্ত স্বাস্থ্য বিধি মেনে বাজার খোলা থাকবে। বাজার শেষ করে দ্রুত বাসায়
চলে যান। ভিড় করবেন না।”
কাকরাইলে ইসলামী ব্যাংক
হাসপাতালের কর্মচারী সুলায়মান মালিবাগের বাসা থেকে হাসপাতালে ডিউটি করতে যাচ্ছেন।
তিনি বললেন, “আজকের লকডাউন অন্যরকম। মনে হচ্ছে, ঢাকায় কারফিউ জারি হয়েছে। দেখছেন
না মোড়ে মোড়ে কত ব্যারিকেড, যে কাউকে দেখলে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদ- কেনো
বেরিয়েছেন।”

“কয়েকদিন
আগেও লকডাউন ছিলো তবে এতো কড়াকড়ি দেখিনি।”
রিকশা
চালক হাফিজ মিয়া মালিবাগের মোড়ে বসে আছে দুই ঘণ্টা। একজন যাত্রীও পায়নি সে। “কি
কমু স্যার। লকডাউন আমাগো পেটে লাথি মারছে। সারাদিনে রোজগার কি হইবো বুইঝা গেছি।
খামু কি কন?”
ঠেলাগাড়ি
চালক কামাল বললেন, “স্যার রিকশা ও ঠেলাগাড়ির মালিকদেরও পুলিশ রাতে বলে গেছে যেন
রিকশা ও ঠেলাগাড়ি ভাড়া না দেয়। এই যে দেখতাছেন রিকশা ও ঠেলাগাড়ি কিছু তারা
মালিকদের অনেক বইলা, কইয়া রিকশা ও ঠেলাগাড়ি নামাইছে রাস্তায়।”
করোনাভাইরাস সংক্রামণ সামাল
দিতে সোমবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে কঠোর ‘লকডাউন’ ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারি করা
হয়। লকডাউন মধ্যে পালনের জন্য ১৩টি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে।

লকডাউনে
১৪ থেকে ২১ এপ্রিল মধ্যরাত পর্যন্ত সারাদেশে সব ধরনের অফিস ও গণপরিবহন,
বাজার-শপিংমল, দোকানপাট, হোটেল-রেস্তোরাঁ প্রভৃতি বন্ধ থাকবে। তবে জরুরি সেবার
প্রতিষ্ঠানগুলো খোলা থাকবে। খোলা থাকবে শিল্প-কলকারাখা। সীমিত পরিসরে ব্যাংকিং
সেবাও খোলা থাকবে।
এই
সময়ে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের হওয়া যাবে না। খোলা স্থানে কাঁচাবাজার ও
নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যদি কেনাবেচা করা যাবে ৬ ঘণ্টা।
মিরপুরের
রূপনগরে বুধবার লকডাউনের প্রথম দিনে সকালে রাস্তায় রিকশা ও অন্যান্য অন্যান্য
যানবাহন চলতে দেখা গেছে। তবে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে এদের সংখ্যা কম ছিল।
সকাল থেকে এলাকায় অন্যান্য
দোকান না খুললেও বেলা বাড়ার সাথে সাথে নিত্যপণ্যের দোকান খুলেছে। তবে সকাল ৯টার
আগে প্রধান সড়কের দুই ধারে সবজির দোকানগুলো প্রতিদিনের মতোই পণ্যের পসরা নিয়ে বসে।

সবজি
বিক্রেতা মো. শাহজাহান বলেন, “রূপনগর থানার টহল গাড়ি এসে আমাদের বলে গেছে অবশ্যই
মাস্ক পরে দোকানদারি করতে হবে।”
এই
এলাকায় সড়কের দুই পাশে বসা ফলের দোকানগুলোও অন্যান্য দিনের মতোই দোকান খোলা
রেখেছে।
স্থানীয় একটি মুদি দোকানের
ব্যবস্থাপক সুমন বলেন, “থানা থেকে আমাদের এখনো কিছু জানায়নি। তবে গণমাধ্যম থেকে
আমরা জেনেছি বেলা ৩টা পর্যন্ত নিত্যপণ্যের দোকান খোলা রাখা যাবে।”
“আমরা
সরকারের নির্দেশনা মেনেই দোকান খুলেছি; বিকেল ৩টার মধ্যে বন্ধ করে দেব।”
মোহাম্মদপুর থানার ডিউটি অফিসার এএসআই কামরুল ইসলাম জানিয়েছেন,
নির্দেশনা উপেক্ষা করে দোকান খোলা রাখায় সাতজনকে আটক করা হয়েছে এলাকার বিভিন্ন স্থান
থেকেভ

ধানমন্ডি ২৭ নম্বরে দায়িত্বরত পুলিশ সার্জেন্ট সাহিন আলম
জানান, চলাচলের কোনো প্রয়োজনীয়তা বা মুভমেন্ট পাস দেখাতে না পারায় ফিরিয়ে দেওয়ার
সময় একটি বাসের বিরুদ্ধে ট্রাফিক আইন অমান্যের অভিযোগে মামলা করা হয়েছে।
ওই এলাকার তল্লাশি চৌকিতে দায়িত্বরত মোহাম্মদপুর থানার এসআই
নাজমুল ইসলাম বলেন, “যেসব গাড়ি বা মানুষ চলছে তারা কোনো প্রয়োজনীয়তা বা মুভমেন্ট
পাস দেখাতে না পারলে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
“হাসপাতাল কর্মচারী, ওষুধ কোম্পানি, ব্যাংকার বা গার্মেন্ট
কর্মীদের চলাচলে ছাড় দেওয়া হচ্ছে।”

লকডাউনের প্রথম দিনে গাবতলী ছিল
জনমানবহীন। একই পরিস্থিতির দেখা গেছে টেকনিক্যাল মোড়, কল্যাণপুর, মিরপুর-১, মিরপুর-১০, আগারগাঁও, শ্যামলী
ও মহাখালী এলাকায়।
গাবতলী এলাকায় ট্রাফিক পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান,
আমিনবাজার সেতুর দুইটি তল্লাশি চৌকি বসানো হয়েছে। পণ্য পরিবহনের বাইরে যেকোনো ব্যক্তিগত
গাড়ি যথাযথ তল্লাশি করে, পাস থাকা সাপেক্ষে যেতে দেওয়া হচ্ছে।
মাজার রোডে একটি অটোরিকশার দেখা পেলেও চালক দুলাল চন্দ্র
বিশ্বাস জানান, সকালে তার এলাকার এক গৃহবধূ অগ্নিদগ্ধ হওয়ার পর তাকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেল
কলেজ হাসপাতালের উদ্দেশ্যে বের হয়েছিলেন। সে কারণে দুপুর পর্যন্ত তিনি রাস্তায় থেকে
গেছেন।
“এখন কোনো রোগী বা অন্য কোনো বিপদগ্রস্ত যাত্রী পেলেই
কেবল নিব,” বলেন দুলাল।

মিরপুর-১০ নম্বরে ট্রাফিক পুলিশের
এডিসি সোহেল রানা বলেন, “ট্রাফিক পুলিশ অনুমোদনহীন গাড়িগুলো থামাচ্ছে আর পথচারীদের
বিষয়টি দেখভাল করছে থানা পুলিশ।”
মিরপুরের ওই এলাকায় কিছু ব্যক্তিগত
গাড়ি ও মোটর সাইকেল চলতে দেখা গেলেও ফুটপাতের দোকানগুলো বন্ধ থাকায় রাস্তায় তেমন
ভিড় নেই। কয়েকজন পথচারী যারা রাস্তায় এসেছেন যানবাহন না পেয়ে তারা পড়েন বিপাকে।
মিরপুর ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনে চিকিৎসাধীন স্বজনের
কাছ থেকে গুলিস্তানের বাসায় ফিরতে বের হয়েছিলেন মাসুদ রানা। কোনো উপায় না পেয়ে
সকাল থেকে কয়েক ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করছিলেন মিরপুর-১০ নম্বর গোল চত্বরে।

একই সমস্যায় পড়েন কিশোর হৃদয়
হোসেন। উত্তরার একটি ডেলিভারি কোম্পানিতে চাকরি হলেও প্রথম দিনেই যেতে পারেননি যানবাহনের
অভাবে। হৃদয়ের কাছে ইমার্জেন্সি পাস থাকলেও তিনি উত্তরায় যেতে পারেননি।
রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকা মহাখালীও সুনসান দেখা গেছে।
মহামারির
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এরআগে ৫ এপ্রিল ভোর ৬টা থেকে ১১ এপ্রিল রাত ১২টা পর্যন্ত
সারাদেশে শপিং মল, দোকান-পাট, হোটেল-রেস্তারাঁসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা
আরোপের পাশাপাশি গণপরিবহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল।