ক্যাটাগরি

কী ঘটেছিল মুজিবনগরে?

১৭ এপ্রিল ১৯৭১। এখানেই স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের সূর্য উদিত হয়। দেশি-বিদেশি সাংবাদিক ও হাজারো জনতার সামনে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ (প্রবাসী) সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীরা শপথ নেন। সেই থেকে ইতিহাসের হাত ধরে বৈদ্যনাথতলা হয়ে যায় মুজিবনগর।

ভারত সীমান্তের সব অংশে আশ্রয় লাভকারী যুব-তারুণ্য অস্ত্র প্রশিক্ষণের জন্য রাজনৈতিক নেতাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। ভারত সরকারের সঙ্গে আলোচনা চালানোর জন্যও তখন একটি আনুষ্ঠানিক কর্তৃপক্ষ জরুরি হয়ে ওঠে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে কার নেতৃত্বে সরকার গঠন করা হবে, কারা এর উদ্যোগ নেবেন- এসব নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়।

শেষ পর্যন্ত হাল ধরেন আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ও বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠজন তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও এএইচএম কামরুজ্জামান, জহুর হোসেন চৌধুরী, আব্দুল মান্নান, আব্দুস সামাদ আজাদ প্রমুখ। তারা পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করেন।

আরও সিদ্ধান্ত হয় সৈয়দ নজরুল ইসলাম হবেন উপরাষ্ট্রপতি, যিনি বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করবেন। তাজউদ্দীন আহমদ যুদ্ধকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বে থাকবেন। সেদিনই গভীর রাতে (১১ এপ্রিল) পশ্চিমবঙ্গের কোনও এক অজ্ঞাত স্থান থেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদের রেকর্ড করা একটি ভাষণ গোপন বেতারকেন্দ্রের মাধ্যমে প্রচারিত হয়। এই বেতার ভাষণের মধ্য দিয়েই আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের সরকার বিশ্ববাসীর সামনে আত্মপ্রকাশ করে।

মুজিবনগরে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়। গার্ড অব অনার প্রদানকারী বারোজনের মধ্যে বেঁচে আছেন মাত্র চারজন আনসার সদস্য। মো. সিরাজ উদ্দীন ও মো. হামিদুল হকের বয়স ষাট পেরোলেও মো. আজিমুদ্দীন ও মো. লিয়াকত আলীর বয়স সত্তরোর্ধ্ব। তাদের মুখে শুনি ওই দিনের আদ্যপান্ত।

‘২৬ মার্চের পরেই আমরা বৈদ্যনাথতলা ইপিআর ক্যাম্পটি দখলে নিই। ক্যাম্পে ওড়ানো পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে আগুন ধরিয়ে দিই। এরপর থেকেই ক্যাম্পের দায়িত্বে থাকি আমরা, ১২ জন আনসার।’ এভাবেই কথা শুরু করেন আজিমুদ্দিন শেখ। তিনি ছিলেন ভবরপাড়া গ্রামের সে সময়কার আনসার কমান্ডার। শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের কথা উঠতেই তিনি বলেন, ‘১৬ এপ্রিল আছরের একটু পরই ক্যাম্পে আসেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, কামরুজ্জামান, এম মনসুর আলী, ওসমানী, তৌফিক-ই-ইলাহী সহ (বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা) অনেকেই। তৌফিক-ই-ইলাহী ছিলেন মেহেরপুরের তৎকালীন এসডিও। ক্যাম্পের পেছনের গেট দিয়ে তারা চলে যান আম্রকাননে। সেখানে অনুষ্ঠানের জায়গা নির্ধারণ করে আবার ফিরে আসেন ক্যাম্পে। তৌফিক-ই-ইলাহী কিছু নির্দেশনা দিয়ে বলেন, ‘আগামীকাল এখানে কিছু মেহমান আসবেন। আপনারা আজ একটু সজাগ আর কাল সকালে রেডি থাকবেন।’

মঞ্চ তৈরির দায়িত্ব ছিল স্থানীয় সংগ্রাম কমিটির। মোমিন, জজ মাস্টার, আইয়ুব ডাক্তার, সৈয়দ মাস্টার, রফিক মাস্টার, রুস্তম উকিল, জামাত মাস্টার, সুশীল কুমার বিশ্বাস প্রমুখের নাম জানালেন। মঞ্চ তৈরি শুরু হয় রাত ১০টার পর। আমরা তখন টহলে ছিলাম। গ্রাম থেকে লোক আসে। মাটির ওপরে তক্তা বিছানো হয়। কাপড়, দড়ি, বাঁশ, দেবদারুর পাতা দিয়ে সাজানো হয় অনুষ্ঠানস্থল। দুটি বাঁশ পুঁতে দেবদারুর পাতায় তৈরি করা হয় গেট। চেয়ার, মাইক আর টেবিল আসে ভারত থেকে। শেষরাতের দিকে আমাদের ক্যাম্প থেকে আনা হয় চৌকি।

ভোররাতের কথা বলেন হামিদুল হক, ‘আমরা তখনও জানি না, এখানে কী হবে। শেষরাতে শুনি, চারপাশে গাড়ির শব্দ। ক্যাম্প থেকে কিছুই ঠাহর করতে পারি না। ভোরের দিকে দেখি, শত শত ভারতীয় বিএসএফ। সাদা পোশাকে তারা ঘিরে রেখেছে গোটা এলাকা।’

সকালের দিকে আনসার সদস্যরা অস্ত্রসহ আসেন অনুষ্ঠানস্থলে। তাদের বলা হয় গার্ড অব অনারের প্রস্তুতি নিতে। সকাল নয়টায় আম্রকাননে অতিথিরা আসতে থাকেন। আশপাশের হাজার হাজার মানুষও জড়ো হয়। উপস্থিত হন দেশি-বিদেশি সাংবাদিকরা।

অনুষ্ঠান শুরু হয় বেলা ১১টায়। জাতীয় নেতারা মঞ্চে উঠতেই শুরু হয় কোরআন তেলাওয়াত আর জাতীয় সংগীত। আসাদুল হক, শাহাবুদ্দিন আহমেদ সেন্টু, পিন্টু বিশ্বাস, আইয়ুব প্রমুখ জাতীয় সংগীতে কণ্ঠ দেন। আর কোরআন তেলাওয়াত করেন বারেক। দলের হুইপ আবদুল মান্নান অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন। চিফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলী স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। শপথ করান সৈয়দ নজরুল ইসলাম। শপথের পরই অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ভাষণ দেন। এরপরই শুরু হয় গার্ড অব অনার পর্বটি।

প্রথমে আমাদের কমান্ডে ছিলেন আনসার ইয়াদ আলী। পেছনের লাইনে ছিলাম আমরা ১১ জন। ইয়াদ আলীকে লাইনে পাঠিয়ে কমান্ড করলেন মাহাবুব উদ্দিন আহমেদ। তিনি ছিলেন মাগুরা মহকুমার পুলিশ কর্মকর্তা (এসডিপিও)। পেছনে আমরা ১২ জন গার্ড অব অনার প্রদান ও সশস্ত্র সালাম দিই। অন্য আনসার সদস্যরা হলেন- ফকির মোহাম্মদ, নজরুল ইসলাম, মফিজ উদ্দিন, অস্থির মল্লিক, মহিম শেখ, কিসমত আলী, সাহেব আলী এবং ইয়াদ আলী।

সেদিনের অনুষ্ঠানের বর্ণনা করেন আজিমুদ্দিন শেখ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনসহ মন্ত্রিপরিষদের অন্য সদস্যদের পরিচয় করিয়ে দেন। সেনাপতি হিসেবে ঘোষণা করা হয় আতাউল গনি ওসমানীর নাম। সেদিনই বৈদ্যনাথতলার নামকরণ করা হয় মুজিবনগর।

মূলত এই শপথ অনুষ্ঠানের পরেই স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের নাম সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। এই অস্থায়ী সরকারের মাধ্যমেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয় এবং বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র জন্ম নেয়। তাই ১৭ এপ্রিল জাতীয় ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ দিন।

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!