১৪ এপ্রিল রোজা শুরুর পর থেকে ইফতারকে কেন্দ্র করে এক ঘণ্টার ছুটি চেয়ে আন্দোলন করে আসছিলেন তারা।
আন্দোলনরত শ্রমিক ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বকেয়া বেতন ও ইফতারের ছুটি নিশ্চিত করতে কয়েকদিন ধরে আন্দোলন করছিলেন শ্রমিকরা।
শনিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মিছিল নিয়ে চীনা কোম্পানি সেপকো থ্রির সাইট অফিসে যাওয়ার পথে পুলিশের গুলিতে পাঁচজন শ্রমিক নিহত হন।
এই ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত আরও ১২ জনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে বলে জানান বাঁশখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা শফিউর রহমান মজুমদার।
পুলিশ গুলি করার আগে উত্তেজিত শ্রমিকরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল ছুড়েছিল যাতে কয়েকজন পুলিশ সদস্যও আহত হয়েছেন।
বাঁশখালী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আজিজুল ইসলাম বিদ্যুৎকেন্দ্রে সংঘর্ষের কথা নিশ্চিত করে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ ঘটনায় আমাদের ছয় পুলিশ সদস্যও আহত হয়েছেন।”
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী প্রকল্পের এক শ্রমিক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এই প্রকল্পের শ্রমিকরা সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত কাজ করে থাকেন। রোযা শুরু হওয়ার আগ থেকেই শ্রমিকরা ইফতারের জন্য এক ঘণ্টার বিরতি চেয়ে আসছিলেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ তা মঞ্জুর করেনি।
“এছাড়া প্রতিমাসের ১০ তারিখের মধ্যে শ্রমিকরা আগের মাসের বেতন চেয়ে আসলেও বেতন পরিশোধে ২০ তারিখেরও বেশি সময় পার হয়ে যাচ্ছিল। ”
তিনি বলেন, শনিবার মিছিল নিয়ে চীনা কোম্পানির সাইট অফিসের দিকে রওনা দিলে পুলিশ শ্রমিকদের বাধা দেয়। কিছুক্ষণ বাগবিতণ্ডার পর কিছু শ্রমিক পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট ছুড়তে থাকে। পুলিশ কিছুটা পিছু হটে ৫ থেকে ৭ মিনিটের মধ্যেই গুলি করতে করতে এগুতে থাকে।
শরিফ হোসেন নামের আরেকজন শ্রমিক বলেন, “প্রকল্পের অধিকাংশ শ্রমিকই রোজা রাখছেন। সে কারণে ইফতারের আগে একঘণ্টার ছুটির কথা আমরা বার বার বলে আসছিলাম। সেই ছুটি মূল নয় ঘণ্টা থেকে কেটে রাখার প্রস্তাব দিয়েছিলেন শ্রমিকরা। তা সম্ভব না হলে ইফতারের পর কাজ করে পুষিয়ে দেওয়ার প্রস্তাবও ছিল।
“কিন্তু চীনা মালিকপক্ষ কোনোটাই মানছিলনা। বাংলাদেশি কন্ট্রাকটররাও ঠিক সময়ে বেতন দিচ্ছিলনা। তারা এই ক্ষেত্রে চীনা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে টাকা সময় মতো না পাওয়ার আজুহাত দিচ্ছিল।”
চীনের ইপিসি কোম্পানিগুলোর বেশ কয়েকটি বাংলাদেশি সাব কন্ট্রাক্টরের মধ্যে একটি হচ্ছে আদিবা এন্টারপ্রাইজ।
এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সাইট ম্যানেজার উজ্জল মোল্যা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ইফতারের সময় নিয়ে শ্রমিকরা যেই দাবি জানিয়েছিল তা একেবারেই যৌক্তিক। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ইফতারের আগে ছুটি দেওয়া অবশ্যই প্রয়োজন ছিল। আমরাও চীনা লোকজনকে বুঝাচ্ছিলাম। তারা অনুমোদন না দিলে তো আমরা সেটা করতে পারি না।”
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, “শ্রমিকদের দাবির বিষয়টি ভেবে দেখা হবে বলে শুক্রবারই চীনা প্রতিষ্ঠানের লোকজন বলেছিল। শনিবার শ্রমিকরা আবার বিক্ষোভ শুরু করলে এস আলম গ্রুপের সাইট অফিসের লোকজন শ্রকিদের পক্ষ থেকে ১৫/১৬ জনকে ডেকে নিয়ে সেপকো থ্রির কার্যালয়ে বৈঠকে বসে। আমিও সেই বৈঠকে ছিলাম।
“এমন সময় শ্রমিকদের হোস্টেল এলাকা থেকে হই চই শুরু হয়। উত্তেজিত শ্রমিকরা পুলিশ পোস্টে, পুলিশে ভ্যানে আগুন ধরিয়ে দেয়। কয়েকজন পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট ছোড়ে। এর পরে পুলিশের দিক থেকে উপুর্যুপুরি গুলি আসতে থাকে।”
চীনের কর্মকর্তাদের ওপর শ্রমিকরা বিরক্ত ছিল মন্তব্য করে তিনি বলেন, ওরা (চীনারা) শ্রমিকদের সঙ্গে কথায় কথায় দুর্ব্যবহার করতো। কাজে একটু ত্রুটি পেলে দুর্ব্যবহার করতো। এমনকি কোনো শ্রমিক কর্মক্ষেত্রে আহত হলে তার কোনো ক্ষতিপূরণ তারা দেয় না। এসব কারণে শ্রমিকরা তাদের ওপর খুবই ক্ষিপ্ত।
ঘটনার দিন শ্রমিকদের সঙ্গে স্থানীয় কিছুলোকজনও যুক্ত হতে পারে বলে সন্দেহ প্রকাশ করে উজ্জল বলেন, “শান্ত পরিস্থিতি কয়েক মিনিটের মধ্যে অশান্ত হয়ে উঠলে ঘটনা কাছাকাছি থেকেও আমি বুঝতে পারিনি।“
বাঁশখালী উপজেলার গণ্ডামারা ইউনিয়নে ১৩২০ মেগাওয়াটের এসএস পাওয়ার প্ল্যান্টে বাংলাদেশি কোম্পানি এস আলম গ্রুপের ছয়টি প্রতিষ্ঠানের ৭০ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। চীনের প্রতিষ্ঠান সেপকোথ্রি ইলেক্ট্রিক পাওয়ার কনস্ট্রাকশন কোম্পানি ও এইচটিজি ডেভেলপমেন্ট গ্রুপ মিলে একটি জয়েন্ট ভেঞ্চার করে বৃহৎ এই বেসরকারি প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
বিদ্যুতের একক ক্রেতা বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সদস্য (কোম্পানি অ্যাফেয়ার্স) মাহবুবুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এসআলম গ্রুপের এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের ইপিসি ঠিকাদার একটি চায়নিজ কোম্পানি। তাদের আবার এদেশিয় সাব কন্ট্রাকটর রয়েছেন। লোকাল শ্রমিকও সেখানে কাজ করেন।
“সেখানে বেতন, ওভার টাইম, রমজানের সময় সূচি নিয়ে একটা ইস্যু ও বদানুবাদ থেকে জটিলতাটা উদ্ভব হয়েছে। চায়নিজরা পুলিশকে খবর দিলে পুলিশের সঙ্গে স্থানীয় শ্রমিক জনতার সংঘর্ষ হয়, পুলিশ এক পর্যায়ে গুলি চালায়,” বলেন মাহবুব।
পিডিবির এই কর্মকর্তা আরও জানান, প্রকল্পের মালিকপক্ষের সঙ্গে সমস্যা না হলেও চীনা ইপিসি (ইঞ্চিনিয়ারিং, প্রকিউরমেন্ট অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন) ঠিকাদার ও তাদের লোকাল এজেন্টেদের সঙ্গে শ্রমিকদের বিরোধটা বেঁধেছে। শ্রমিকরা যেই ইস্যুগুলো তুলেছে তা লোকাল সাব কন্ট্রাকটরের পক্ষে সমাধান দেওয়া সম্ভব ছিলনা। ওটার সমাধান চাইনিজদের হাতেই ছিল। কখন ছুটি দেবে না দেবে চাইনিজরাই ছিল সেটার অথরিটি।
বাঁশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাইদুজ্জামান চৌধুরী বলেন, শ্রমকিদের বেশকিছু দাবি-দাওয়য়া ছিল। এসব তারা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাতে চাচ্ছিলেন। শনিবার সকালে অসন্তোষ বাড়তে থাকে এবং পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে স্থানীয় লোকজনও জড়িয়ে পড়ে।
২০১৬ সালের ৪ এপ্রিল গণ্ডামারা ইউনিয়নের পশ্চিম বড়ঘোনা এলাকায় এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন এ কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জমি অধিগ্রহণ নিয়েও স্থানীয়দের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনায় চারজন নিহত হয়েছিলেন।