রাজধানীর শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শুক্রবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে তার মৃত্যু হয়।
হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. ফারুক আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কবরী লাইফ সাপোর্টে ছিলেন। কিছুক্ষণ আগে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়েছে।”
৭১ বছর বয়সী এ অভিনেত্রী দীর্ঘদিন ধরে কিডনির জটিলতায় ভুগছিলেন। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর তার ফুসফুসেরও মারাত্মক ক্ষতি হয়।
গত ৫ এপ্রিল করোনাভাইরাস ‘পজিটিভ’ আসার পর থেকে কবরী হাসপাতালে ছিলেন। বৃহস্পতিবার বিকালে তাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয় বলে তার ছেলে শাকের চিশতী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান।

কবরীর ‘স্মৃতিটুকু থাক’

ঢাকাই ছবির মিষ্টি মেয়ে কবরী
‘মেকআপ তুললেই তারকাখ্যাতি খসে পড়ে’
অবশেষে চলচ্চিত্রে অনুদান পেলেন কবরী
আত্মজীবনী’র দ্বিতীয় খণ্ড লিখবেন কবরী
গত শতকের ষাটের দশকে সেলুলয়েডের পর্দায় আবির্ভূত হয়ে ঢাকাই চলচ্চিত্রের মিষ্টি মেয়ে হিসেবে দর্শক হৃদয়ে স্থায়ী আসন করে নেওয়া কবরী পরের অর্ধশতকে দুই শতাধিক সিনেমায় আলো ছড়িয়েছেন। শীর্ষ পাঁচ ঢাকাই নায়কের অভিষেক ঘটেছে তার হাত ধরেই।
কিংবদন্তী এই অভিনেত্রীর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেছেন, “কবরী ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তার মৃত্যু দেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। বাংলা চলচ্চিত্রের বিকাশে তার অবদান মানুষ আজীবন শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে।”
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এই অভিনেত্রী, নির্মাতা ও সাবেক এমপির মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
১৯৫০ সালের ১৯ জুলাই চট্টগ্রামের বোয়ালখালীতে জন্ম নেওয়া মিনা পালের শৈশব ও কৈশোর কেটেছে চট্টগ্রামের ফিরিঙ্গি বাজারে। মাত্র ১৪ বছর বয়সে নির্মাতা সুভাষ দত্তের ‘সুতরাং’ চলচ্চিত্রে অভিষেকের মধ্য দিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন কবরী।

কবরী-রাজ্জাক জুটি ঢাকাই চলচ্চিত্রের পর্দা কাঁপিয়েছে দীর্ঘদিন

নিজের লেখা ‘স্মৃতিটুকু থাক’ জড়িয়ে কবরী
সুতরাংয়ের সেটে প্রথম শটেই চড় খেয়ে কেঁদে ভাসানো সেই মেয়েটির সঙ্গে পরে নায়ক রাজ হয়ে ওঠা রাজ্জাকের জুটির রসায়ন ঢাকাই ছবির ইতিহাসে আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা পায়।
‘নীল আকাশের নিচে’, ‘ময়নামতি’, ‘ঢেউয়ের পর ঢেউ’, ‘পরিচয়’, ‘অধিকার’, ‘বেঈমান’, ‘অবাক পৃথিবী’, ‘সোনালী আকাশ’, ‘অনির্বাণ’, ‘দীপ নেভে নাই’সহ অর্ধশতাধিক সিনেমার এই জুটিকে পরে ‘আমাদের সন্তান’ চলচ্চিত্রে বয়স্ক বাবা-মায়ের ভূমিকাতেও দর্শকরা দেখেছেন।
১৯৭৩ সালে ‘রংবাজ’ সিনেমায় দর্শক এক লাস্যময়ী কবরীকে আবিষ্কার করে। সেই চলচ্চিত্রের ‘সে যে কেন এল না, কিছু ভালো লাগে না’ গানটি এখনও বহু দর্শকের বুকে বাজে।
‘সাত ভাই চম্পা’, ‘যে আগুনে পুড়ি’, ‘দীপ নেভে নাই’, ‘ক খ গ ঘ ঙ’, কিংবা পরে ‘সুজন সখী’, ‘স্মৃতিটুকু থাক’, ‘সারেং বউ’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’সিনেমায় পর্দা মাতানো কবরীর ভাষায়, “জীবন হচ্ছে একটি চলচ্চিত্র। জীবন কিন্তু স্থিরচিত্র নয়।”
সেই জীবন-চলচ্চিত্রের বাঁকে বাঁকে নানা ঘটনার কথা কবরী নিজেই গ্রন্থিত করে কেরে গেছেন তার আত্মজৈবনিক রচনায়। ‘স্মৃতিটুকু থাক’ শিরোনামে কবরীর লেখা সেই বইটি ২০১৭ সালের একুশে বইমেলায় প্রকাশ করে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর পাবলিশিং লিমিটেড- বিপিএল।
আমার প্রায় সব ছবির নায়ক, বন্ধু রাজ্জাক: কবরী
‘কী পেলাম আর কী পেলাম না এসব ভাবি না’

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ১৪২৪ বাংলা বর্ষবরণের আয়োজনে এ কালের দুই তারকা নুসরাত ইমরোজ তিশা ও মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর সঙ্গে কিংবদন্তী অভিনেত্রী কবরী।

নিউ ইয়র্ক টাইমসের সঙ্গে মিলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম প্রকাশিত ম্যাগাজিন ‘টার্নিং পয়েন্টস: গ্লোবাল এজেন্ডা ২০১৬’ এর মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানেও সঙ্গী ছিলেন অভিনেত্রী কবরী।
উত্তাল একাত্তরে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে ভারতের বড় বড় শহরে জনমত সংগঠন, সেলুলয়েডের বাইরে রাজনীতি জীবনের টুকরো টুকরো স্মৃতি, ঢাকাই সিনেমার সদর-অন্দরের পাশাপাশি এ শিল্পের উপর যুদ্ধ ও যুদ্ধ পরবর্তী রাজনীতির অভিঘাতের কথাও সেখানে দুই মলাটে বেঁধেছেন কিংবদন্তী এই অভিনেত্রী।
সেই বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে ষাটের দশকে ডাকসু ভিপি হিসেবে রাজপথ কাঁপানো ছাত্রনেতা, যিনি পরে মন্ত্রীও হয়েছিলেন, সেই রাশেদ খান মেনন বলেছিলেন, “কবরী আমাদের সময়কার হার্টথ্রব। তার সেই স্মৃতি এখনও আমাদের মধ্যে।”
ষাট আর সত্তরের দশকের অনেক তরুণের ‘স্বপ্ন’ কবরীর স্বপ্ন কী ছিল? বালিকাবেলায় ভেবেছিলেন- বড় হয়ে সাদা শাড়ি পরে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে স্কুলে ‘মাস্টারি’ করবেন। কিন্তু ‘লাইট-অ্যাকশন-কাটের’ আলো ঝলমলে জীবন তাকে নিয়ে যায় তারকালোকে।
তারুণ্যের সেই দিনগুলোতেই এল বাঙালির ইতিহাস বদলে দেওয়া একাত্তর। অভিনেত্রী কবরী কলকাতায় গিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। সেখানে বিভিন্ন সভা-সমিতি ও অনুষ্ঠানে বক্তৃতার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করেন। পরে দেশে ফিরে পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন সিনেমায়।
কবরীর ‘স্মৃতিটুকু থাক’ ভাষা শহীদদের নিবেদন
জীবন হচ্ছে একটি চলচ্চিত্র: কবরী
বইমেলায় এল কবরীর ‘না বলা গল্প’

২০১১ সালের নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভীর পক্ষে গণসংযোগ করেন তখনকার আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য সারাহ বেগম কবরী।

২০০৯ সালে এক বিশেষ মুহূর্তে অভিনেত্রী কবরী। আইনপ্রণেতা হিসেবে শপথ নিতে তিনি চলেছেন জাতীয় সংসদে।
সেলুলয়েডের সেই রঙিন জীবন শেষে কবরীর পরের জীবন-চলচ্চিত্রও কম বর্ণময় ছিল না। রাজনীতিতে নেমে জীবনের আরেক চলচ্চিত্রের মুখোমুখি তাকে হতে হয়েছিল বিচ্ছেদের মধ্য দিয়ে।
এক সময় নারায়ণগঞ্জের প্রভাবশালী ওসমান পরিবারের বধূ কবরীকে ভোটের মাঠে সেই নারায়ণগঞ্জেই নানা তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। সব জয় করেই নবম সংসদে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে আওয়ামী লীগের সাংসদ হয়েছিলেন তিনি।
২০০৬ সালে মুক্তি পায় কবরীর পরিচালার প্রথম চলচ্চিত্র ‘আয়না’। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি শিক্ষক হিসেবেও যোগ দিয়েছিলেন।
২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে সরকারি অনুদানে ‘এই তুমি সেই তুমি’ নামে দ্বিতীয় চলচ্চিত্র নির্মাণে হাত দিয়েছিলেন তিনি। সে কাজ আর তার শেষ হল না।