ক্যাটাগরি

তরমুজ এবার কার জন্য কতটা ‘মিষ্টি’?

রোজার দিনে শরীরে পানির চাহিদা পূরণে ইফতারে তরমুজ অনেকেরই পছন্দ। ফলন ভালো হওয়ায় এবার বাজারে এ ফলের সরবরাহও প্রচুর।

ফল বিক্রেতারা বলছেন, চৈত্র মাসের ২০ তারিখে শুরু হওয়া রোজা শেষ হবে বৈশাখের শেষভাগে। আম-লিচুর মৌসুম শুরু হতে দেরি থাকায় ইফতারের টেবিলে তরমুজ, আনারস, বাঙ্গির মতো ফল মাসজুড়েই থাকবে।

বাংলাদেশ গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ফারাহ মাসুদা বলেন, মৌসুমি ফল তরমুজ গরমে পানির চাহিদা মেটানোর জন্য ভালো। এতে আছে বিটা ক্যারটিন, ভিটামিন বি-১ ও বি-২ এবং বিভিন্ন খনিজ উপাদান, যা দেহকে সতেজ রাখতে সাহায্য করে।

দ্রুত পচনশীল বলে মাঠ থেকে তরমুজ তোলার পরপরই বিক্রির চাপ থাকে চাষির মাথায়। তবে এ মৌসুমে চাহিদা নিয়ে সংশয় না থাকায় ভালো লাভের আশায় আছেন কৃষক, ব্যাপারী ও খুচরা বিক্রেতারা।

অর্থনীতির নিয়মে সরবরাহ বেশি হলে দাম কমার কথা। কিন্তু এবার তা হয়নি। রাজধানীর বাজারে মোটামুটি গতবারের দরেই তরমুজ বিক্রি হচ্ছে।

সাধারণত তরমুজ বেশি মেলে এপ্রিল-মে মাসে। এবার ঢাকার বাজারে মার্চের মাঝামাঝি থেকেই আসতে শুরু করেছে আগাম মৌসুমের তরমুজ।

ঢাকার কারওয়ান বাজারের ফল বিক্রেতা মহসীন আলী বললেন, এখন ৫/৬ কেজি ওজনের একটি তরমুজ বিক্রি হচ্ছে ২৫০ টাকা থেকে ৩০০ টাকায়। প্রতি কেজির দাম পড়ছে ৫০ টাকার বেশি। গত বছরও দাম এরকমই ছিল।

“এ বছর তরমুজের সরবরাহের মূল সময়টা জুড়ে রোজা থাকবে। ফলে ভালো দাম পাওয়া যাবে বলে আশা করছি।”

তবে তরমুজ কেজি দরে না আকার অনুযায়ী বিক্রি হওয়া উচিত, তা নিয়ে বিক্রেতাদের সঙ্গে মতভেদ আছে ক্রেতাদের। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও লিখছেন অনেকে। 

দেশের দক্ষিণাঞ্চল থেকে আসা তরমুজ আড়তে বিক্রির সময় দাম নির্ধারণ হয় আকার অনুযায়ী। প্রতি ১০০ তরমুজের পাইকারি দাম এখন আকারভেদে ৬ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

দেশের দক্ষিণাঞ্চল থেকে আসা তরমুজ আড়তে বিক্রির সময় দাম নির্ধারণ হয় আকার অনুযায়ী। প্রতি ১০০ তরমুজের পাইকারি দাম এখন আকারভেদে ৬ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

লক্ষ্মীবাজার এলাকার বাসিন্দা বোরহান উদ্দিন বলেন, “পিস হিসেবে কিনে কেজি দরে বিক্রি শুরু হয়েছে। খুচরা বিক্রেতারা বাদামতলী ঘাট থেকে সবচেয়ে বড় সাইজের (৮ কেজি) একটা তরমুজ সর্বোচ্চ ৩০০ টাকায় কিনে বিক্রির সময় কেজি দরে বিক্রি করেন। প্রতি কেজি ৫০ টাকা থেকে ৬০ টাকা বিক্রি করে তারা পান ৪৮০ টাকা। মানুষকে ঠকাতে, বেশি লাভের আশায় কেজি দরে তরমুজ বিক্রি শুরু হয়েছে।”

তরমুজ বিক্রির এই কৌশল নিয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ইমরুল মহসিনও ‘অবাক’।

“দুই-তিন বছর আগে যে তরমুজ ২০০ টাকায় কিনে খেয়েছি, সেটা এখন ৪০০ টাকা থেকে ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তরমুজ তো আগে কেজিতে বিক্রি হত না। এখন কেজির মাপে বিক্রির প্রচলন হওয়ায় প্রতি কেজির দাম ৪০/৫০ টাকার নিচে নামছেই না। অথচ আগের হিসাবে দাম ছিল কেজি ২০/২৫ টাকা।”

বেড়েছে উৎপাদন

আগের বছর ভালো দাম পেয়ে এবার তরমুজের আবাদ দেড়গুণ বেড়েছে, ফলনও হয়েছে ভালো। ঢাকায় যেসব তরমুজ আসে, তার বড় অংশ আসে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলা ভোলা, বরগুনা, পটুয়াখালী ও বরিশাল থেকে। নাটোর, সিরাজগঞ্জ, পাবনাসহ অন্যান্য জেলাতেও তরমুজের আবাদ হয়।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হর্টিকালচার বিভাগের পরিচালক মনোজিত কুমার মল্লিক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, চলতি মৌসুমে ৬৭ হাজার ৯৫২ হেক্টর জমিতে তরমুজের চাষাবাদ হয়েছে।

গত মৌসুমে ৪৩ হাজার ৩৪৭ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছিল, ফলন উঠেছিল ১৭ লাখ ৭৮ হাজার ৯৮৯ টন। তার আগের বছর ৩৮ হাজার ৮২৪ হেক্টর জমিতে ১৪ লাখ ৫২ হাজার ৫০০ টন তরমুজ উৎপাদিত হয়েছিল।

নাটোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক সাইফুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তার জেলায় গত বছরের তুলনায় এবার তরমুজের আবাদ প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। গত বছর ৬২১ হেক্টর জমিতে আবাদ হলেও এবার হয়েছে ১৪০৮ হেক্টর জমিতে।

“বিশেষ করে গুরুদাসপুরের বিল অঞ্চলে তরমুজের আবাদ বেশি হয়েছে। সেখানে রসুনের সঙ্গে মিলিয়ে তরমুজ আবাদ করেছেন অধিকাংশ কৃষক। ফলে উৎপাদন খরচ কিছুটা কম হচ্ছে, তবে ওই তরমুজ আসবে কিছুটা দেরিতে।”

এপ্রিলের ১০ তারিখের দিকে নাটোর অঞ্চলের তরমুজ ওঠা শুরু হবে বলে আশা করছেন এই কৃষি কর্মকর্তা।

একই কথা বলেন পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান। তিনি জানান, গত বছর এ উপজেলায় সাড়ে সাত হাজার হেক্টর জমিতে তরমুজের আবাদ হয়েছিল। এবার সেটা বেড়ে ১০ হাজার হেক্টর হয়েছে।

ভোলা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে জানানো হয়েছে, জেলায় চলতি মৌসুমে ১১ হাজার ২৪৯ হেক্টর জমিতে তরমুজের আবাদ হয়েছে। গত বছর আবাদ হয়েছিল ৫ হাজার ৬১৮ হেক্টর জমিতে। সেই হিসাবে এবার জেলায় প্রায় দ্বিগুণ জমিতে তরমুজের আবাদ হয়েছে।

ভোলায় মূল মৌসুমে জাম্বো জাগোয়া এবং সারা বছরের অন্যান্য মৌসুমে ব্লাক টাইগার জাতের তরমুজ চাষ হয়। গত মৌসুমে হেক্টর প্রতি উৎপাদন হয়েছিল ২২ টন তরমুজ।

পুরান ঢাকার ওয়াইজঘাটে সারি সারি তরমুজের নৌকা। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

পুরান ঢাকার ওয়াইজঘাটে সারি সারি তরমুজের নৌকা। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

রাজধানীতে এলেই দাম দ্বিগুণ

রাজধানীতে কেজি দরে তরমুজ বিক্রি নিয়ে যেমন ক্রেতাদের আপত্তি আছে, তেমনি উৎপাদনের জেলা থেকে ঢাকায় এলেই তরমুজের দাম কেন দ্বিগুণ হয়ে যায়, সেই প্রশ্নও থাকছে।

সরকারি কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের এক হিসাবে দেখা যাচ্ছে, ২০২০-২০২১ অর্থবছরে সারাদেশে তরমুজের গড় উৎপাদন ব্যয় হয়েছে কেজি প্রতি ৮ টাকা ৬৮ পয়সা। একর প্রতি উৎপাদন খরচ ৯২ হাজার ৮৬৯ টাকা।

কেজি প্রতি কৃষকের বিক্রি মূল্য ২৬ টাকা হিসাবে একরে ১০ হাজার ৭০০ কেজি তরমুজের দাম দাঁড়ায় ২ লাখ ৮১ হাজার ৬২৫ টাকা।

খরচ বাদ দেওয়ার পর প্রতি একরে কৃষকের এক লাখ ৮৮ হাজার ৭৫৫ টাকা মুনাফা থাকে বলে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর জানাচ্ছে।

অধিদপ্তরের এক হিসাবে দেখা যায়, বর্তমান উৎপাদন খরচ বিবেচনায় নিয়ে কৃষকের ৩০ শতাংশ লভ্যাংশ, পাইকারি বিক্রেতার ১০ শতাংশ লভ্যাংশ এবং খুচরা বিক্রেতার ২০ শতাংশ লভ্যাংশ ধরলেও ক্রেতা পর্যায়ে প্রতি কেজি তরমুজের দাম ২০ টাকার আশেপাশে থাকার কথা। কিন্তু ঢাকায় তা বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকায়।  

রাঙ্গাবালীর কৃষি কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান বলেন, গত সপ্তাহে আবুল কালাম নামে একজন কৃষক ২৫০০টি তরমুজ (প্রতিটি গড়ে ১০ কেজি ওজন) হাটে নিয়ে এসেছিলেন। তিনি পাঁচ লাখ টাকা দাম চাইলেও ব্যাপারী চার লাখ টাকার বেশি দিতে রাজি হননি।

“তাহলে দেখা যাচ্ছে- এই তরমুজগুলোর দাম ২০০ টাকা করেও দেওয়া হচ্ছে না। অথচ ঢাকায় বিক্রি হচ্ছে ৪০০ টাকা থেকে ৫০০ টাকায়।”

তিনি বলেন, রাঙ্গাবালী অঞ্চলে যে জমি থেকে আড়াই হাজার তরমুজ বাজারে তোলা হয়েছে, সেখানে কৃষকের খরচ হয়েছে দেড় লাখ টাকা। সেই হিসাবে প্রতিকেজি তরমুজের উৎপাদন খরচ দাঁড়াচ্ছে ৬ থেকে ৭ টাকা। তবে ফলন কম হলে সেটা হয়ত ১০ টাকার দিকে যেতে পারে।

নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা জহিরুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, গত বছর গুরুদাসপুর এলাকায় ৮ কেজি ওজনের একটি তরমুজ ২০০ টাকা থেকে ২৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। সেই তরমুজ ঢাকায় বিক্রি হয়েছে ৪০০ টাকার বেশি দামে।

বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তরমুজ এক সময় মৌসুমি ফল ছিল, তবে এখন সারা বছরই কমবেশি পাওয়া যায়। ২/৩ বছর আগেও ভারত ও থাইল্যান্ড থেকে কিছু তরমুজ আমদানি করা হত; এখন আর হচ্ছে না।

“ভারতের চেয়ে কম দামে দেশে উৎপাদিত তরমুজগুলো সারাবছর পাওয়া যায়। সবুজ ও হলুদ রঙয়ের রকমেলন নামের এক ধরনের তরমুজ এখন দেশেই উৎপাদন হয়।”

অতি মুনাফার অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, “তরমুজ পরিবহন ও হাতবদলের সময় অন্তত ৩০ শতাংশ পণ্য নষ্ট হয়ে যায়, যা অন্যান্য ফলের ক্ষেত্রে এতটা হয় না। তাছাড়া বরগুনা থেকে এক ট্রাক তরমুজ ঢাকায় পরিবহনের ক্ষেত্রে ৩০ হাজার টাকার মত খরচ হচ্ছে, যা আগে ১৫/২০ হাজার টাকার মধ্যে ছিল। তরমুজের দাম নিয়ে পর্যালোচনার ক্ষেত্রে এই বিষয়গুলো বিবেচনায় নিতে হবে।”